http://ec.europa.eu/immigration নামে গত নভেম্বর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অভিবাসনের নয়া নিয়ম-নীতিসহ একটি ওয়েবসাইট প্রকাশ করেছে। অভিবাসীদের জন্য ভিসা পাওয়া সহজীকরণ এবং ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশে যাতায়াত সহজ সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা সমেত অভিবাসন কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নয়া কৌশলপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে কর্মী আনা অথবা ভিসা পেতে সহজ হবে কি না, তা এখনো পরিষ্কারভাবে কিছুই বলা হয়নি, তবে সম্প্রতি পর্তুগালসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক উদারনীতি গ্রহণ করেছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্ত ইইউর কেন্দ্রস্থল বলে খ্যাত ব্রিটেন এসব শিক্ষার্থীর জন্য অনেক কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে।
ইইউর হোম অ্যাফেয়ার্স কমিশনার সেসিলিয়া মাল্মস্টার্ম তাদের নয়া কৌশলপত্র সম্পর্কে বলেন, ‘গ্লোবাল অ্যাপ্রোচ টু মাইগ্রেশন আন্ড মোবিলিটির (সংক্ষেপে জিএএমএম) নবায়ন কিছু সংযুক্তি হিসেবেই এসেছে। এই জিএএমএমের আওতায় ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে এর বাইরের দেশগুলোর মধ্যে কমন মাইগ্রেশন নীতির ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ’
সেসিলিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম উল্লেখ করেছে, যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্মিলিত বেকারত্বের হার ৯ দশমিক ৫ শতাংশ, তথাপি এই অঞ্চলের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বয়স্ক হয়ে পড়াতে কিছু কিছু সেক্টরে কর্মীর অভাব দেখা যাচ্ছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের ব্যবধানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুধু স্বাস্থ্যখাতেই অন্তত ২০ লাখ কর্মীর দরকার হবে বলে এরই মধ্যে ইউনিয়নই আভাস দিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এখনই আগাম আভাস দিয়ে রেখেছে, কোনও কোনও সদস্য রাষ্ট্রে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আইটি ক্ষেত্রে দক্ষ লোকের অভাব দেখা দিতে পারে।
সদ্য ঘোষিত জিএএমএমের আওতায় দুটি বিষয়ে সবিশেষ গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, আর তা হলো মোবিলিটি পার্টনারশিপ এবং মাইগ্রেশন অ্যান্ড মোবিলিটি রিসোর্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা। এই সম্পর্কে ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ সলিসিটার ফার্ম বেনহুর অ্যান্ড কোম্পানির মিঃ ডেভিড বলেন, মোবিলিটি পার্টনারশিপের আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে তিউনিসিয়া, মরক্কো ও মিশর তাদের নাগরিকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ভিসা এবং এর আনুষঙ্গিক বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ইস্যুতে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা হবে।
তিনি আরো বলেন, মাইগ্রেশন অ্যান্ড মোবিলিটি রিসোর্স সেন্টার প্রতিষ্ঠার ফলে দক্ষতা এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অংশীদার দেশগুলোর কর্মীদের জন্য চাকরি খুঁজে দেওয়ার র্নির্ধারিত কাজ করা হবে।
এদিকে, মজার ব্যাপার হলো, অনেক দেন-দরবারের পর ফ্রান্স সরকার অবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলো থেকে সদস্যভুক্ত দেশগুলোয় আগমনের সুবিধার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রণীত ব্লু-কার্ড স্কিমে অংশ নিতে সম্মত হয়েছে। ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী ২০১২ সাল থেকে ফ্রান্স সরকার ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলোর নাগরিকদের এই ব্লু-কার্ড স্কিমের সুযোগ দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্লু-কার্ড স্কিম চালুর ফলে হয়তো ফ্রান্স পরবর্তীতে ওয়ার্ক পারমিটের ক্যাটাগরিও বাড়াতে পারে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ইউরোপের বাইরের দেশ থেকে দক্ষ কর্মীদের আকৃষ্ট করতে ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর জন্য ২০০৯-এর মে মাস থেকে ইইউ ব্লু-কার্ডের নির্দেশনা দেয় ইউনিয়ন। নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০১১-এর জুন মাস পর্যন্ত এই ব্লু-কার্ড স্কিম চালু করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলো ইউনিয়ন। কিন্তু ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ব্রিটেন, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড শুরু থেকেই এর বিপরীতে নিজস্ব অভিবাসন নীতি অনুসরণের কথা জানিয়ে আসছিলো, যা ব্রিটেন এখনো তা বহাল রেখেছে। বাকি ২৮টি দেশের মধ্যে এখনো বেশ কয়েকটি দেশ এই ব্লু-কার্ড স্কিম বাস্তবায়ন করেনি।
ওয়েবসাইট ঘেঁটে ব্লু-কার্ড পেতে যে সব যোগ্যতা লাগবে বলে জানা যায়, তা হচ্ছে, ১) কোনো বিদেশি নাগরিকের কমপক্ষে এক বছরের চুক্তি থাকতে হবে। ২) এই স্কিমের আওতায় আবেদন করতে হলে দেশটির সর্বনিম্ন যে বেতন কাঠামো রয়েছে, তার থেকে দেড় গুণ বেশি বেতন পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। ৩) একই সঙ্গে সর্বনিম্ন তিন বছরের ডিগ্রি কোর্সের সমমর্যাদার পড়াশুনা অথবা সংশ্লিষ্ট কাজে কম পক্ষে পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ৪) এই কার্ডের বিষয়ে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফ্রান্সে প্রবেশের এক মাসের মধ্যে ওয়ার্ক পারমিটধারী ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের নাগরিককে আবেদন করতে হবে। ব্লু-কার্ডের অনুমোদনের মেয়াদ নির্ভর করবে প্রস্তাবিত ওয়ার্কপারমিটের মেয়াদের ওপর, যার সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে তিন বছর।
এই বিষয়ে প্রখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার এ. আলী ব্যাখ্যা করে বলেন, ব্লু-কার্ড নবায়নযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্লু-কার্ডধারী ব্যক্তির স্পাউসের(স্ত্রী বা স্বামী) জন্য প্রাইভেট এবং ফ্যামিলি লাইফ ক্যাটাগরিতে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করা হবে। তিনি বলেন, তবে এ ধরনের ওয়ার্ক পারমিটের প্রাথমিক মেয়াদ হবে এক বছর, যা নবায়নযোগ্য। ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ অনুমান করছে, ব্লু-কার্ড প্রক্রিয়ার আবেদনের সিদ্ধান্ত আবেদনের নব্বই দিনের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। আর স্পাউসের ক্ষেত্রে আবেদনের দিন থেকে সর্বোচ্চ ১৮০ দিন পর্যন্ত লাগতে পারে।
এখানে উল্লেখ্য, যে সব বিদেশি নাগরিক এরই মধ্যে ইউনিয়নের যে কোনো দেশে এই কার্ডের আওতায় আঠারো মাস অবস্থান করছেন, তারা আপনা-আপনিই ফ্রান্সের এই কার্ডের অধিকারী হয়ে যাবেন। ব্লু-কার্ড এবং তার ডিপেন্ডেন্ট ইউরোপীয় ইউনিয়নে পাঁচ বছর অবস্থান করা সাপেক্ষে দীর্ঘমেয়াদী রেসিডেন্সি পাবেন।
এদিকে, লন্ডনের বাংলানিউজ এবং ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার বিভিন্ন খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, অ্যাসাইলাম প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুড়ে উন্নত এবং সমন্বিত নীতি চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
জানা গেছে, ২০১২ সালের মধ্যে চালুর উদ্দেশ্যে কমন ইউরোপীয় এসাইলাম সিস্টেম এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে।
ব্যতিক্রম শুধু ব্রিটেন, অভিবাসনের ব্যাপারে আরও কড়াকড়ি শুরু করেছে। আগামী বছর থেকে ব্রিটেনে কর্মীর ভিসা স্ট্যাটাস অনলাইনে শনাক্ত বা চেক করার জন্য চাকরিদাতাদের জন্য সুযোগ সংবলিত ব্যবস্থার কথা এখনই আলোচনা শুরু করেছে। যার লক্ষ্য হলো অবৈধদের জন্য ব্রিটেনে থাকা ও কাজের পথ বন্ধ করা। এরই মধ্যে বর্ডার এজেন্সি ব্রিটেনের অনেক জায়গায় ধরপাকড় শুরু করেছে। অনেককে ধরেই সরাসরি নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে, নিয়োগদাতাকে স্পষ্ট জরিমানাসহ নানা আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ভিসা স্ট্যাটাস পরীক্ষার অনলাইন প্রক্রিয়া শুরু করাকে স্বাগত জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
(ইউরোপীয় ইউনিয়নের বুলেটিন, বিভিন্ন অনলাইন নিউজ এজেন্সি, ইউনিয়নের ওয়েবসাইট এবং ইমিগ্রেশন আইনজ্ঞদের সহায়তা ও পরমর্শক্রমে নিবন্ধটি প্রণীত)
লেখক: ব্রিটেন প্রবাসী, যোগাযোগ: Salim932@googlemail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১১