শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস চুপচাপ পার করে ১৮ ডিসেম্বর দেশে হঠাৎ যে পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে, এর নানা বৃত্তান্ত দেশের নানা মিডিয়ায় পড়ে পড়ে ভয় ধরেছে মনে। দেশে মন্দের ভালো একটি সংসদীয় সরকার ক্ষমতায় আছে।
আটক যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার খালেদা জিয়া করতে দেবেন না, এটি তিনি এবং তার পারিষদবর্গ আগেই বলেছেন। তাদের সম্পদ আইনজীবী ব্যক্তিত্ব(!) ব্যারিস্টার মওদুদকে দিয়ে প্রেস কনফারেন্স করিয়ে হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, এ বিচার বন্ধ করতে হবে। এ বিচার তারা মানেন না। বিলাতে ব্যারিস্টারি বিদ্যা অর্জন করলেও মওদুদ গং’এর মানটি লোকাল। কাজেই শুধুমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক উকিল লাগবে! আবার ঈমানের কমজোরির কারণে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবসের সময়ে সারা দেশজুড়ে যখন চিহ্নিত এসব ঘাতক যুদ্ধাপরাধীর দ্রুত বিচারের বুলন্দ আওয়াজ চলেছে, তখন বিষয়টি নিয়ে তারা কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন! একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি! যে দলটি ক্ষমতায় থাকতে চিহ্নিত ঘাতকদের মন্ত্রী করেছে, আবার ক্ষমতায় যেতে পারলেও তা-ই করবে, সে দলটির এখনই যেনতেন প্রকারে সরকার ফেলে দেয়ার নিয়ত কী এ বিচার বন্ধের উদ্দেশে নয়? পত্রিকায় এসেছে তিনটি কারণে তারা এখন সরকার ফেলে দিতে চান। সরকার মেয়াদ শেষ করতে পারলে যুদ্ধাপরাধীদের আর খালেদা-তারেকের দুর্নীতির মামলার বিচার শেষ করে ফেলবে। অতএব এখনই এদের ফেলে দাও। দিতে হবে। দেশের মানুষ একশ সমস্যায় জর্জরিত। এই তিন প্রকারের বিচার বিঘ্নিত করার সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির তথা খালেদা জিয়ার পরিবারের স্বার্থ জড়িত আছে সত্যি। কিন্তু এসবের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক কী?
মিসর স্টাইল গণবিপ্লবের খোয়াবনামা শুনে অনেকের হাসিও পেয়েছে। বাঙ্গালির এত আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, সেই ভাষা আন্দোলন, উনসত্তুর, একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, ১৯৯৬ সালের পনের ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন, ২০০৬ সালে ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচন প্রতিহত করার অভিজ্ঞতা আছে। আন্দোলনে ৭২, ৯৬ ঘন্টার হরতাল, গণকার্ফু, গণবিপ্লবের মুখে সচিবালয়সহ সব সরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস ফেলে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন, রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে সৃষ্টি হয় শহীদ নূর হোসেন, ডা মিলনদের আত্মত্যাগের আখ্যান। বা সর্বশেষ ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের সময় অনলাইনের ব্লগারদের শক্তিমত্তার স্ফূরণও দেখা হয়েছে। তেমন আন্দোলনের ভ্যানগার্ড আসিফ মহিউদ্দিনকে ধরে নিয়ে গিয়ে নামাজ পড়েন কীনা, শুকরের মাংস খান কীনা জাতীয় প্রশ্নকারী, এসব ব্লগিং বাদ দিয়ে বিবাহ করে ঘরসংসার করার পরামর্শদাতা উর্বর মস্তিষ্কের (!) ডিবি পুলিশের অস্তিত্বও জানা গিয়েছিল।
এমন আন্দোলন-সংগ্রামে চ্যাম্পিয়ন দেশের তথা বুড়িগঙ্গাপাড়ের বাঙ্গালির কী আন্দোলন শেখার জন্যে যাওয়া লাগে নীলনদের দেশ মিসরে? যেখানে তিন যুগের বেশি সময় ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল হোসনি মোবারকের মতো মার্কিনিদের পা চাটা এক স্বৈরাচারী! আর হোসনি মোবারকের ক্ষমতার প্রায় সমান সময়ের বিগত তিন যুগে আমাদের খালেদা জিয়া তিনবার, শেখ হাসিনা দু’বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। উনি এবং ইনি ক্ষমতা পেয়ে কী করেছেন এবং করছেন, তাতো দেখেছে-দেখছে দেশের মানুষ। খালেদা জিয়া বারবার করে বলছেন শেখ হাসিনা দেশটারে ফোকলা করে ফেলেছেন। তিনি ক্ষমতায় থাকতে দেশটা কোন বেহেস্তে চলে গিয়েছিল, তাও কী দেশের মানুষকে জোর করে বিশ্বাস করতে বলতে হবে? গত নির্বাচনে মানুষ কেন এভাবে একতরফা রায় দিয়ে এই ক্ষমতাসীনদের মাথা নষ্ট করেছে, সে কথা মানুষকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। কিন্তু এটাতো জোর করে বলানো যাবে না যে হাওয়াভবন শাসিত বাংলাদেশ বেহেস্তে ঢুকে গিয়েছিল, এখন সেটি পুরা ঢুকে গেছে গণভবনে!
একজন স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আমাদের হাসিনা-খালেদা দু’জনেরই বিকাশ। এর জন্যেই তারা হয়ত আন্দোলনপ্রিয়। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরও তাদের আন্দোলনের অভ্যাস যায়নি বা তা না করলে বা না ঠেকালে তাদের যেন ভালোও লাগে না! দু’জনেরই আবার শুধু ক্ষমতা ভালো লাগে! ক্ষমতায় যেতে না পারার দূঃখে বিরোধীদলের নেত্রী হয়ে যাবার পর তারা আর সংসদে যান না। কিন্তু বেতন-ভাতা সবই নেন। সুযোগ-সুবিধার এক পাই-পয়সাও কোথাও মিস করেন না! আর ও’ দেশটারে ফোকলা করে দিল বলে পাঁচবছর ধরে এরা আন্দোলন আন্দোলন খেলেন। নারী হবার কারণে তাদের আরেকটি সুবিধা আন্দোলন-আন্দোলন খেলাতে তাদের কোন কষ্ট-পরিশ্রমও করতে হয় না। আন্দোলনের পুলিশের লাঠির বাড়ি, টিয়ার গ্যাস সব খায় দলের কিছু নেতাকর্মী। উনারা একটু কষ্ট করে শুধু রেডিমেট মিটিং’এ গিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। যেটা আগে করেছেন শেখ হাসিনা। এখন করছেন খালেদা জিয়া। এভাবে উভয়ে মিলে যে গত তিনযুগে দেশটাকে শুধু ফোকলা করেছেন, সে হিসাব কে কার কাছ থেকে নেবে?
আজ খালেদা জিয়া পাঁচবছর মেয়াদের আগে শেখ হাসিনাকে ফেলে দেবার নিয়ত করেছেন। কিন্তু নিজে কিন্তু কখনো পাঁচ বছরের একদিন আগে কখনো ক্ষমতা ছাড়েননি। আওয়ামী লীগের মতো আন্দোলন চ্যাম্পিয়ন দলের বহুরূপী কর্মসূচিতেও না। ১৯৯৬’র পনের ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবার দৃষ্টান্ত নিশ্চয় তিনি দেশের মানুষকে মনে করতে বলবেন না। শেখ হাসিনার অনেক বদনাম আছে। কিন্তু এরশাদ-খালেদার মতো তেমন একদলীয় নির্বাচন করার বদনাম এখনো নেই। সেটি যদি হাসিনা অর্জন করেন তাহলে কিন্তু দেশের মানুষকে খালেদার পিছনে লাইন দিতে দাওয়াত করে বলতে হবে না। খালেদা বলেছেন তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া হাসিনাকে নির্বাচন করতে দেবেনই না। কিন্তু হাসিনার গোপনে পাঠানো তত্ত্বাবধায়ক ফর্মূলাটি যে তার হাতে তা তিনি চেপে আছেন কেন? এটি এখনই প্রকাশ-প্রচার হয়ে গেলে তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনটি মাঠে মারা পড়বে সে কারণে? নিজেদের পারিবারিক দুর্নীতি আড়াল করতে দেশের মানুষের দুর্বিষহ মূল ইস্যুগুলো এড়িয়ে আন্দোলন আন্দোলন খেলা আর কত? আজ পর্যন্ততো বলা হলো না যে সিঙ্গাপুরের ব্যাংকে ধরা পড়া টাকার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক তারেক-কোকোর! বা ওগুলো এফবিআই’র তৈরি করা জাল অ্যাকাউন্ট! খালেদা এবং বিএনপি নেতারা যুদ্ধাপরাধীদেরর জন্যে আন্তর্জাতিক মানের সবকিছু চান। তা তারেকের মামলায় এফবিআই’র আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত কর্মকর্তার বিরোধিতা করা কেন?
বিএনপি দাবি করে দেশের সবচেয়ে বেশি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা তাদের আছেন। সত্যি কথা। দল গঠন করতে জিয়া রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা সুবিধাবাদী যাকে যেখানে পেয়েছেন তাদেরকেই নিয়েছেন। কিন্তু তেলে-জলে যেমন মেশে না তেমন স্বাধীনতার শত্রু রাজাকারদের সঙ্গে কী আত্মস্থ-ধাতস্থ হতে পারেন একদল সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা? এমন দাবি যদি কেউ করেন তাকে বা তাদেরকে কি অলি আহমদের মতো জ্ঞানপাপী বলা যাবে না? যিনি একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও সম্প্রতি কিছু সুন্দরী নারী চেয়েছেন! আর সর্বশেষ বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে বলেছেন, একাত্তরে কলকাতার থিয়েটার রোডের নেতারা মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকতেন! থিয়েটার রোড থাকতেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন। তার নেতৃত্বের সরকার ভারত সরকার থেকে যেসব অস্ত্রশস্ত্র-সুবিধাদি আদায় করতে পেরেছে সেগুলো অলি আহমদদের হাতে তুলে দিতে পেরেছে বলে তারা যুদ্ধ করে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হতে পেরেছেন। আর সেই খেতাবটিও দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতৃ্ত্বাধীন রাজনৈতিক সরকার। আর এখন অলি আহমদের কাছে তারা মাতাল? মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের কাছ থেকে অস্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের পর খেতাব নিয়েছেন! অলি’র দাবিটি সঠিক হলে কেউ যদি বলে বসে যে, একাত্তরের নেতারা এমন ভুল করে ভুল মানুষকে এসব অস্ত্র-খেতাব দিয়েছিল, বিষয়টি কেমন দাঁড়াবে? অথবা যদি একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর সিলেটের তামাবিল সীমান্তের ভিতর পৌঁছলেও ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার কাজকর্মের খবর কেন নেয়নি তখনকার অথবা পরবর্তী সরকার? জিয়ার সেই সময়ের ভূমিকার গুরুত্বপূর্ণ একজন সাক্ষীতো এখনও জীবিত আছেন।
বেশি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দলের নেত্রী ১৮ ডিসেম্বরের সমাবেশে তাদের ট্রেনিংকে কাজে লাগাতে বলেছেন। মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং কাজে লাগানো মানেতো আবার অস্ত্র হাতে নেওয়া। তাদের জন্য বড় বিব্রতকর এক আহবান। কারণ যে দলটি তারা এখন করেন সে দলটির এখন মূল এজেন্ডা স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানো। চিহ্নিত সেসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করতে নেত্রীর কথা রাখতে তাদের কী আবার হাতে অস্ত্র নেওয়া সম্ভব? দলীয় কারণে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা গোলাম আযম বা মতিউর রহমান নিজামির পাশেও অনেক বসেছেন। মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার এমন অনেক ছবি আছে। কিন্তু ঢাকায় মেয়র খোকা যত মুক্তিযোদ্ধার নামে সড়ক করেছেন, গোলাম আযম বা নিজামীর নামে কোন সড়কের নামকরণ করেছেন কী? না তা সম্ভব ছিল? স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার ঠেকাতে এখন কীভাবে ট্রেনিং কাজে লাগাবেন খোকা সাহেব?
আবার বেশি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দলের মতো বিএনপিতো বেশি উকিল-ব্যারিস্টারদের দল সেটিওতো সত্য। সুপ্রিমকোর্ট বারের মতো দেশের বার সংগঠনগুলোর বেশিরভাগ যে সংগঠনের দখলে সে সংগঠনের নেত্রীরতো এক-দুটি মামলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগার কথা না। যদি কেউ প্রশ্ন তুলে বলে মামলা কোর্টে ফয়সালায় ঈমানি জোরের অভাবেই নেত্রী সরকারকে আগাম ফেলে দিতে চাইছেন, এর কী জবাব হবে?
বিএনপি প্রতিদিন বলছে সরকার তাদের শান্তিতে আন্দোলন করতে দিচ্ছে না, পুলিশ দিয়ে পেটাচ্ছে, হয়রানি করছে, এসব অভিযোগতো সত্যি। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিও এটা করত। তারেক রহমান নবীজির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতেন শান্তির জন্যে শক্তি প্রয়োগের দরকার আছে। আমাদের দেশে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে পুলিশ ‘ক্যাথলিক মোর দ্যান দ্য পোপ’-এর মতোও আচরণ করে। আমাদের বিরোধীদলগুলোকে এসব সমস্যা মোকাবেলা করেই আন্দোলন করতে হয়। আগে এমন আওয়ামী লীগ করেছে এখন বিএনপি করছে। আন্দোলনের সময় বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আদর করে কথা বলেনি, তা ফেস করেই আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছে, মতিয়া চৌধুরী, অপু উকিলদের পিটিয়ে বারবার রাস্তায় শুইয়ে দেয়া সত্ত্বেও তারা যদি মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে পারেন, বিএনপি লোকেরা পারবে না কেন?
রোডমার্চে এত নেতাকর্মী-সমর্থকের ঢল নামাতে পারলে আন্দোলনে কেন পারে না তা বিএনপি খতিয়ে দেখেছে কী? না, এদলের নেতা-কর্মীরা এমন ভ্রমণ বা পিকনিক-পিকনিক কর্মসূচি বেশি পছন্দ করেন? দলের প্রেস কনফারেন্সের মঞ্চে যেসব মোটাতাজা নেতারা ভিড় করেন, হরতালসহ অন্য কর্মসূচির দিনগুলোতে তারা কোথায় আত্মগোপন করেন? বা পাবলিক এত সমস্যায় থাকলেও কেন বিএনপির এসব চিহ্নিত মোটাতাজা নেতাদের পিছনে আন্দোলনে আসে না—দল কি এর উত্তর জানার চেষ্টা করেছে? রোড মার্চতো শুধু খালেদা জিয়া না এরশাদও করতে পারেন, এটা সাবেক স্বৈরাচারী তার সিলেট কর্মসূচিতে দেখিয়েছেন। এরশাদের সিলেট মার্চ কর্মসূচির পর লন্ডন প্রবাসী বাংলানিউজের অতিথি লেখক ফারুক যোশী লিখেছেন, বিএনপি-জাপা এই দলগুলো কিন্তু মার্কিন কোম্পানির কাছে দেশের তেল-গ্যাস সম্পদ তুলে দেবার প্রতিবাদে এ ধরণের কর্মসূচি দেয় না। তাই তাদের এসব কর্মসূচি গ্ল্যামারের গুণে মিডিয়া কভারেজ পেলেও দেশের আমজনতার কাছে গণমুখী হিসাবে চিহ্নিত-সমাদৃত হয় না। মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকায় বিএনপির লম্বা অবস্থানের গোপন কর্মসূচির ফাঁস হওয়া খবর পড়ে ফারুক যোশীর লেখাটির কথা খুব মনে পড়েছে।
একটি সরকার কী তাকে ফেলে দেবার নিয়তের এসব বিষয়াদি আগাম জেনে ফেললে তা কাউকে করতে দেয়? অস্ট্রেলিয়ার মতো উদার গণতান্ত্রিক দেশের সিডনি মহানগরীতেও ‘অকুপাই’ আন্দোলনকারীর শহরটির মার্টিনপ্লেস এলাকায় অবস্থান নেবার কিছু সময়ের মধ্যে অভাবিত শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পুলিশ তাদের তুলে দিয়েছে। এর সমালোচনার জবাবে পুলিশ বলেছে, সমাবেশে লোক সমাবেশ বাড়ার পর তুলে দিতে গেলে সমালোচনা আরও বেশি হতো। তখন বেশি লোককে জখমের অভিযোগ উঠত।
বিএনপি আরেক বিবেচনায় তাদের গোপন কর্মসূচি মোতাবেক কাজ করতে না দেয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ দিতে পারে। কারণ সত্যি সত্যি পুলিশ যদি তাদের সচিবালয়ের আশেপাশে বসে পড়তে দিত তাহলে কী উপায় হতো এসব নাদুসনুদুস নেতাদের? যারা থ্রী পিস স্যুট বা কড়কড়ে ইস্ত্রি করা পাজামা-পাঞ্জাবি বা সাফারি ছাড়া কোনও কর্মসূচিতে যান না! ছবির বৈচিত্র্যের জন্য সকালে-বিকালে যারা কয়েকদফা পোশাক বদলান, তাদের কী উপায় হতো? মাওলানা ভাসানির চিড়া-গুড়ের পুটলি সঙ্গে করে ফারাক্কা মার্চে রওয়ানা হওয়া দলতো আজকের বিএনপি না। সেখান থেকে যেসব নেতা আজকের বিএনপিতে এসেছেন তারাতো চিড়া-মুড়ি আর খাবেন না বলেই ওসব সেখানে ফেলে এখানে ঢুকে সাফারি পরা শিখেছেন।
অতএব কল্পনা করুন বিএনপি সত্যি সত্যি তেমন বসতে পারলে কী অবস্থা দাঁড়াত এরা নেতাদের! অনশন কর্মসূচির সময়ও যাদেরকে মাঝে মাঝে মঞ্চের পিছনে গিয়ে খাওয়া লাগে, টয়লেট সহ নানা নামে কতবার প্রেসক্লাবসহ কতদিকে ছুটতে হতো তাদেরকে! এত মানুষের ব্যবহারে কী দুর্গন্ধই না ছড়াত জাতীয় প্রেসক্লাবের আশেপাশে! এর নেতারা যে প্রতিষ্ঠানটিকে এর মাঝে যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী, তাদের দোসর আণ্ডাবাচ্চাদের অভয়াশ্রম বানিয়েছেন! তাহরির স্কোয়ার বা ‘অকুপাই’ মুভমেন্টের কর্মীরা কিন্তু ওই এলাকায় নিজেদের পোর্টেবল টয়লেটও গড়ে নিয়েছিলেন বা নেন। কোনও অজুহাতে এক মুহুর্তের জন্যে রাজপথের দখল ছেড়ে যাননি।
কাজেই সত্যি সত্যি তেমন একটি কর্মসূচি চাইলে খালেদা জিয়া বা বিএনপি নেতারা এসবের গ্রাউন্ডওয়ার্ক কী করেছিলেন? না কোনভাবে কোথাও একটু বসতে পারলে সেখান থেকে তুলে দেবার প্রতিবাদে আরেকটি হরতালের কর্মসূচির কথা ভেবে রাখা হয়েছিল? বিএনপি নেতারা এর সঠিক জবাব দিতে পারবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব অবশ্য কর্মসূচিটির কথা স্বীকার করেননি। তাই যদি না হবে তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের মহাসমাবেশে কেন ঢাকার আশেপাশের জেলাগুলো থেকে নেতাকর্মীদের আনা হচ্ছিল? সড়কে বাধা পেয়ে কেন ট্রেনে ঢাকা আসার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিলেন নারায়নগঞ্জের নেতাকর্মীরা? একটি গণতান্ত্রিক দল হিসাবে যেকোনও গণতান্ত্রিক কর্মূচির অধিকার বিএনপির আছে। কিন্তু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তাদের নিজস্ব গাড়ি-সম্পদ নিরাপদ থাকলেও পাবলিকেরগুলো যে পুড়ছে, মতিঝিলে যে আরিফ মারা গেলেন, সিলেটে যে বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হলো এক মহিলাকে, প্রতিটি কর্মসূচির আগের দিন তাদের ভয়ে ফাঁকা হয়ে যাওয়া রাজপথে গাড়ি কমে যাওয়াতে পাবলিকের যে কষ্ট-ভোগান্তি হচ্ছে, এসবের দায়দায়িত্বওতো তাদেরই নিতে হবে। আমাদের বিরোধী দলগুলো অবশ্য যেন সব দায়দায়িত্বের উর্ধ্বে! সব দায়দায়িত্ব সরকারকে দিয়ে খালাস পেতে চায়। কিন্তু বিএনপির কারণে যদি দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুল হয়, তরতর করে জেল থেকে বেরিয়ে যায় নখ-দাঁত উঁচু সব ঘাতক রাজাকারের দল, বিচারের অপেক্ষায় অপেক্ষমান শহীদমাতা-জায়াদের চোখ থেকে যে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়বে, সে দায়-অভিশাপ থেকে দলটি আর কখনো কোনও দিন বেরুতে পারবে কী? প্রশ্নটি খালেদা জিয়া, যুদ্ধাপরাধীদের উকিল মওদুদ বা রাজাকার পিতার সন্তান মির্জা ফখরুল না, দলটির দাবিকৃত সবচেয়ে বেশি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে থাকল।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক