নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে, বড় ব্যথিত, বড় মর্মাহত হ্রদয়ে কলম ধরতে হচ্ছে। একরাশ কষ্ট বুকের ভিতর জগদ্দল পাথরের মতো একে একে বাসা বেঁধে বসেছে, বুকের সেই জগদ্দল পাথর প্রতিনিয়ত রক্ত জমাট বেঁধেই চলেছে।
আমাদের প্রতিনিয়ত সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-ভরসার মাঝে প্রতিনিয়তই যিনি বা যারা আমাদের সব সময়ই একটু আশার আলো, একটু উদ্দীপনা, ভালোবাসার কথা সততই শুনাতেন কিংবা চলার পথে আলোর দিশারি হয়ে দিকনির্দেশনা দিতেন, জীবন চলার পথের সঠিক পথ দেখাতেন-একে একে সেই সব জ্ঞানী-মহিয়সী, চলার পথের আলোর দিশারীরা জীবন চলার বাতি নিভিয়ে একে বারে পরপারে চলে যাচ্ছেন, যেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসে না। ভাবতেই অবেক লাগে, নিজেকে বড় একলা, বড় নিঃস্ব মনে হয়, জীবন চলার পথের সব সৃজনী শক্তি যেন আজ হারাতে বসেছি। প্রতিনিয়ত যারা আলোর পথ দেখাতেন, তারাই চলে গেছেন আজ অন্ধকারের মাটির ঘরের চিরস্থায়ী ঠিকানায়। আমাদের আর আলোর পথ কে এসে দেখাবে?
কেন জানি মনে হয়, আমাদের, মানে বাঙ্গালিদের আনন্দ খুব বেশি দীর্ঘায়িত হয় না। প্রতিনিয়ত ঝড়-ঝঞ্ঝ, খরা-বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের জন্য মনোগত কোনো কারণ কিনা, তা কেবল মনোবিজ্ঞানী এবং সমাজবিজ্ঞানীরাই বলতে পারবেন।
প্রিয় কবি, সাংবাদিক, লেখক, যে নামেই ডাকি না কেন, তাকে বরং ছোট করাই হয়। সদা হাস্যোজ্জ্বল আমার প্রিয় বন্ধু, প্রিয় ভাই আরজু আহমেদ--যে আমাদের সব সময় মাতিয়ে রাখতো, হঠাৎ করে সবার অগোচরে একে বারে বিনা নোটিশে চলে গেল। ভাবতে বড় অবাক লাগে একদিন আগে, এমনকি মৃর্ত্যুর কিছু সময় আগেও যে আমাকে এসএমএস করে কুশল জিজ্ঞেস করে ইমেইল চেক করতে বলেছিল।
আরজু আহমেদের শোক ভুলতে না ভুলতেই আচমকা এটিএনবাংলার পর্দায় আরও এক আচমকায় এক শোকের সংবাদ। যে সংবাদ গোটা জাতিকে স্তম্ভিত, হতবিহবল করেছিল। জাতি হিসেবে আমরা বড় লজ্জিত, অপমানিত হই। যখন দেখি জাতির শ্রেষ্ঠ দুই সন্তান মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে ঘাতক বেপরোয়া গাড়ির মুখোমুখী সংঘর্ষে সড়ক দুর্ঘটনায় শোচনীয়ভাবে নিহত হন।
ব্যক্তিগতভাবে মিশুক মুনীর ভাই ছিলেন আমার সহপাঠী বন্ধু আসীফ মুনীরের বড় ভাই, সেই হিসেবে বেশ কয়েকবার ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিলো। অল্প সাক্ষাতে দেখেছি, মুনীর ভাই কত কাজ পাগল লোক ছিলেন। খুব নম্র স্বভাবের লোক ছিলেন। কথা বলতেন এমনভাবে যেন আয়নায় নিজের ছবি আঁকছেন।
আর তারেক মাসুদ তো বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘের চলচ্চিত্র নির্মাণের এক দিকপাল, স্বল্প সময়ে দিয়েছেন বাংলাদেশকে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার, নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে তথা আরাম-আয়েস তুচ্ছ জ্ঞান মনে করে সর্বদা ব্যাপৃত থাকতেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি আর চলচ্চিত্রকে কিভাবে আরও উন্নত ও আরও পরিশীলিত করে বিশ্বসভায় নিয়ে যাওয়া যায়।
মিশুক মুনীর এবং তারেক মাসুদের অকাল মৃত্যৃর ঘা হ্রদয়-মন থেকে না মুছতেই ঝড়ের বেগে আরও এক শোকের খবর এলো। আমাদের প্রিয় শিক্ষক, অভিভাবক প্রফেসর নূর মোহাম্মদ মিঞা আর আমাদের মাঝে নেই। বয়ঃসন্ধিকালে ৮৯ বছর বয়সে গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। প্রফেসর মিঞা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর টালমাটাল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সময় প্রফেসর মোহাম্মদ মিঞা রাষ্ঠ্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে আলাদা করে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগের শুরু করেন। তার নিরলস এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে চার বছর মেয়াদী অনার্স কোর্স চালু হয়।
লেখক: ব্রিটেন প্রবাসী, প্রফেসর নূর মোহাম্মদ মিঞার প্রাক্তন ছাত্র।
যোগাযোগ: Salim932@googlemail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১১