ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কিমদের আনাগোনা ও আমাদের সতর্কতা

অজয় দাশগুপ্ত, সিডনি থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১১
কিমদের আনাগোনা ও আমাদের সতর্কতা

এক কিম গেলেন তো আরেক কিম এলেন। দেশটি যেমন কিমের তেমনি কিম্ভূতেরও বটে।

কথিত বিপ্লবের নামে সেনা নিয়ন্ত্রিত শাসনে বছরের পর বছর পৃথিবী বিচ্যুত এক অবরুদ্ধ দেশ। পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো শহরে সরকারি চাকরির খাতিরে বা দূতাবাসকর্মী হবার সুবাদে বসবাসরত ভিন্ন অন্য কোনো উত্তর কোরিয়ান দেখেছেন কখনো? দেখবেনও না। জীবনের শেষার্ধ্বে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু দেশ ভ্রমণ করার পরও আমি দেখেছি মাত্র একজন, সেকি তাড়া তার! সন্দিগ্ধ দৃষ্টি, ভীতু আচরণ আর পালানোর জন্য মরিয়া। হতে পারে দেশ থেকে পালিয়ে এসেছেন, হতে পারে অন্য কোনো উপায়ে, তারপরও নিজেকে নিরাপদ মনে করছিলেন না। করার কথাও নয়। কিম জং ইল তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সিংহাসন দিলেন না তো এই কারণেই, পুত্র জাল পাসপোর্টে জাপান ভ্রমণ করেছিলেন তাই। রাজপুত্রের যেখানে এই হাল সাধারণ মানুষের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

অবরুদ্ধ দেশের মানুষগুলোর দিকে তাকালে মায়া হয়। অঝোর ধারায় কাঁদলেন তারা, বুক চাপড়াচ্ছেন, কিন্তু কার জন্যে? যিনি নিজে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন, ইচ্ছেমতো বায়স্কোপ দেখতেন, বায়স্কোপ নির্মাণের জন্য শত্রু দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক নায়িকাকে হাইজ্যাক করিয়েছেন, যোগাযোগ ও মিডিয়ার প্রতি অনুরক্ত কিম ইল তাঁর নাগরিকদের বেলায় ছিলেন উল্টো অবস্থানে। ভেবে দেখুন তো, ছবিগুলো মিলে যাচ্ছে কি না? এই যে কিম জং ইলের জন্মগ্রহণ রহস্য তাও কি খুব অচেনা? সে দেশের মিডিয়া পাহাড় চূড়ায় রংধনু ছুঁয়ে যাওয়ার স্বর্গীয় আশীর্বাদপুষ্ট নির্জন বাড়ি দেখিয়ে বলতো ‘দেবদূত’! কিম জং ইলের জন্ম নাকি সেখানে, অথচ রাশিয়ার রেকর্ডে তাঁর জন্ম আর্মি ক্যাম্পে, আরো এক বছর আগে পিতা যখন ট্রেনিং নিচ্ছিলেন। সব আর্মিরই এক রা, কারো পুত্র কারো পিতা কারো বা নিজের জন্ম তারিখ নিয়েই হট্টগোল। শুধু আর্মি কেন তাঁদের স্ত্রী, পুত্রদের বেলায়ও তো একই ঘটনা দেখছি আমরা।

কিম জং ইলের মৃত্যুর পর সে দেশের সরলপ্রাণ মানুষের কান্নাকাটি দেখে মনে পড়ছিল, আমাদের দেশের ‘বাম’ নামে পরিচিত রাজনীতির কিছু নেতার কথা, কোথায় গেলেন কাজী জাফর? কোথায় রাশেদ খান মেনন? উত্তর কোরিয়ার ‘বিপ্লব’ রপ্তানির খোয়াবে একদা অস্থির এদের চোখেও অশ্রু থাকার কথা। অকৃতজ্ঞ হলে যা হয়, এদের কোনো খবর বা প্রতিক্রিয়াও চোখে পড়েনি এখনো। অথচ উত্তর কোরিয়ার বিপ্লবের বঙ্গদেশ-আগমন নিয়ে ভালো অর্থ উপার্জন হয়েছিল বলেও শোনা যায়। তাই দুঃখ যতোটা, ক্ষোভ তার চেয়ে অধিক। কতোটা অদূরদর্শী, অগণতান্ত্রিক আর সেনাচাটা হলে এমন ধারার রাজনীতি করা সম্ভব।

এই সব তথাকথিত বিপ্লববাদী এখনো মাঠে আছেন, কেন তারা উত্তর কোরিয়াকে আদর্শ বা মডেল মনে করতেন তার ব্যাখ্যা নেই, ব্যাখ্যা নেই কেন সে ধারা থেকে সরে এলেন?

পরবর্তীকালে দেশজ সেনা সরকারের চাটুকারিতার ভেতরই এর উত্তর দিয়ে রেখেছেন তাঁরা। অবাক হই, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ, বিশ্বায়ন আর অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই কালেও এঁরা দেশের রাজনীতিতে আছেন, তাও বহাল তবিয়তে!

উত্তর কোরিয়া অচলায়তন, দেবতা প্রতিম কিম জং ইল গেছেন বটে, এসেছে অন্য দেব-সন্তান কিম উন। এরা জিডিপি, গড় আয়ু, প্রতিরক্ষা বা জীবন যাপনের সব কিছুতে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু আমরা গণতান্ত্রিক মুক্ত দুনিয়ার অধিবাসী, গরিব হলেও বাংলাদেশের পল্লী গাঁর কুঁড়েঘরেও চাঁদের আলোর সঙ্গে ঢুকে পড়ে স্যাটেলাইট টিভি, অবাধ তথ্যপ্রবাহ আর পাশ্চাত্যের আলোয় ভেসে ওঠা জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়েও আমরা সংস্কৃতিপ্রেমিক মুক্ত বিহঙ্গ।  

আমাদের দেশে অচলায়তন বা বংশানুক্রমিক রাজনীতি চলবে না, চলবে না দেবদূত কিংবা এক নায়কের শাসন। ইতিহাস আমাদের পক্ষে, ভবিষ্যৎ বলে দেবে উত্তর কোরিয়ার কি হবে? তবে এটা নিশ্চিত আমরা তা হবো না, সংগ্রামী মানুষ ওয়ান ইলেভেনেও তা হতে দেয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।