ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আব্দুর রাজ্জাকের প্রত্যাশিত মৃত্যু!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১১
আব্দুর রাজ্জাকের প্রত্যাশিত মৃত্যু!

আব্দুর রাজ্জাকের প্রত্যাশিত মৃত্যু হয়েছে! কারণ তিনি সংস্কারবাদী ছিলেন! দুনিয়ায় সংস্কারক বা রিফরমার মানে বিশেষ কোনো ব্যক্তিত্ব। বিপ্লবী চরিত্র।

বাংলাদেশে এটি গালি। খুব খারাপ প্রজাতির মানুষ মানে সংস্কারবাদী! দেশের কোনো লেভেলের লোকজন এভাবে সারাদিন দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সিনিয়র নেতাদের সংস্কারবাদী বলে গালি দেয়, মুণ্ডপাত করে তা কে-না জানে? এটাকে কী একটি সুস্থ, গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার প্রকাশ বলা চলে? তুমি খালি জিন্দাবাদ দাও। আর সব কিছুতে নিঃশর্ত সারাক্ষণ অন্ধভাবে ‘হ্যাঁ’ আর ‘আহা বেশ বেশ’ বলো। কাঁচা কথায় খালি চামচাগিরি করো। তাহলে তোমার চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রজাতির আর কেউ নাই রে! এদের কাছে আব্দুর রাজ্জাক তেমন একজন নিকৃষ্ট প্রজাতির ছিলেন! তার মৃত্যুতে দুনিয়া থেকে আরেকটি সংস্কারবাদী বিদায় হলো।
 
এর আগে আমরা এমন আরেকজন সংস্কারবাদী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার করুণ মৃত্যু দেখেছি। সংস্কারের কথাবার্তা বলার অপরাধে তিনি বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হন। তিনি যখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তখন বিএনপির অনেক নেতা তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অন্তত যাতে তিনি বিএনপির পরিচয় নিয়ে মরতে পারেন। কিন্তু খালেদা জিয়া রাজি হননি। খালেদা জিয়ার মতো নিষ্ঠুর নন শেখ হাসিনা। তাই খালেদা জিয়ার মতো এদের বহিষ্কার করেননি। দিয়েছেন অবহেলার যন্ত্রনা! প্রেসিডিয়াম থেকে সরিয়ে দিয়ে উপদেষ্টা মণ্ডলীতে হিযরত করিয়েছেন। আবুলদের মন্ত্রী করেছেন। কিন্তু আটবারের এমপি আব্দুর রাজ্জাককে নয়। একজন কর্ম পাগল মানুষকে এক রকম নিষ্ক্রিয়, নো’হয়ার করে দেওয়া কী এক রকম তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া নয়? এর উত্তর দেওয়া লাগবে।
 
আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর একখানি লম্বা শোকবাণী দিয়েছেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক হানিফ। অনেক গুণকীর্তন সেখানে আছে। জাতি এ ধরনের বাণীর অপেক্ষায় ছিল। বাণীখানি পড়লেই মনে হবে যথেষ্ট সময় নিয়ে আগাম তৈরি করা ছিল। অপেক্ষা ছিল মৃত্যু নিশ্চিতের। যেমন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেত্রীর শোকবাণী মিডিয়ায় প্রচারের পর জানা গেল, আব্দুর রাজ্জাক এখনও মরেন নাই। লন্ডনের হাসপাতাল থেকে একজন সাংবাদিক জানালেন, আব্দুর রাজ্জাকের পরিবার আক্ষেপ করে বলছিলেন, তিনি মারা যাওয়ার আগেই দেশে তাকে মেরে ফেলা হলো? অনেকে দোষ দিতে চেয়েছেন মিডিয়াকে। এটিতো সবচেয়ে সহজ পন্থা! যখন কিছু মনমতো হলো না, তখন মিডিয়ার দোষ, অথবা মিসলিড করেছে মিডিয়া! যে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেত্রী একজনের মৃত্যু নিশ্চিত করে শোকবাণী দেন, মিডিয়া তাদের বিশ্বাস করবে নাতো কাকে করবে? রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের এ ধরনের নিষ্ঠুর আগাম শোকবাণী কি করে মিডিয়ায় চলে এলো, তা জানতে শনিবারের জাতীয় পত্রিকাগুলো খুঁজে কোন উত্তর পেলাম না।
 
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের শোকবাণীর একটি তথ্য ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর দলের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভানেত্রী আর আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এমন আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সেখানে আছে। যা নেই তাহলো, এমন একজন নেতার গুরুতর অসুস্থতার সময় দলের নিশ্চুপ ভূমিকার কারণ। আমরা মিডিয়ায় লিখেই চলেছি আওয়ামী লীগ কেন এই নেতার শারীরিক অবস্থা নিয়ে একটি বুলেটিন বা কোন তথ্যও দেশের মানুষকে দিচ্ছে না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা। একটি পার্লামেন্টারি কমিটির সভাপতি। তার চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবে না কেন? কেন তার চিকিৎসার জন্য বাড়ি-জমি এসব বিক্রি-বন্ধক দিতে হবে? আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ব্যাংক ঋণসহ নানাভাবে বেশকিছু টাকা জোগাড় করে দিয়েছেন। সেদিন আওয়ামী লীগে ঝুপ করে ঢুকে মন্ত্রী হয়ে যাওয়া নুরুল ইসলাম নাহিদ তার চিকিৎসা নিয়ে কি আপত্তিকর ধৃষ্ট একটি মন্তব্য করেছিলেন মনে নেই? লন্ডনে বসবাসরত শেখ রেহানা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে হাসপাতালে যাওয়া আসা করলেতো পরিবারটি ভরসা পেতো। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এ ধরনের ভরসা যে কত দরকারি তা কেনা বোঝে!
 
তোফায়েল আহমদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আমির হোসেন আমু, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, এমনকি জাতীয় পার্টির রুহুল আমিন হাওলাদার তাকে লন্ডনের হাসপাতালে দেখতে গেলেন। গেলেন না সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কেউ। গত তিন মাসে এত মন্ত্রী লন্ডন গেলেন, তাদের কেউ গেলেন না! এই জাতের মন্ত্রীরা গেলে আব্দুর রাজ্জাক সুস্থ বা কোন বিশেষায়িত হয়ে যেতেন না। তাকে একটু সম্মান-মর্যাদা দেওয়া হতো। মরার আগে দলের কাছে সেটিও তিনি পেলেন না! তার মৃত্যুর পর আমরা জানলাম প্রধানমন্ত্রী ফোন করে মিসেস ফরিদা রাজ্জাককে শোক জানিয়েছেন। তার অসহায় ছেলেরা মিডিয়াকে বলেছেন, তাদের বাবার চিকিৎসা নিয়ে প্রধাননন্ত্রী, সরকার আর দলের ভূমিকায় তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু ‘সে সব ভূমিকা’ কী গোপন রাখা হয়েছিল? কেন? লন্ডনের ব্যয়বহুল হাসপাতালের তিন মাসের খরচ, সেখানে পরিবারটির অবস্থানের খরচ, এসব বহনে দল আর সরকারের কী ভূমিকা ছিল তা জাতিকে জানাতে সমস্যাটা কী? বা এখনওতো তা জানানো যায়। সার্বিক নানা পরিস্থিতি দেখেশুনে কেউ যদি বলে ‘বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ অনুসারী’ আব্দুর রাজ্জাককেতো এভাবে আগাম মানসিকভাবেই মেরে ফেলা হয়েছে, এর কী কোন জবাব আছে?
 
পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ব্রাসেলস যাবেন, এ নিয়ে লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনার সাইদুর রহমান খান মহাব্যস্ত! কিন্তু তিনি সেখানকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আব্দুর রাজ্জাককে দেখতে যেতে সময় পান না! ধৃষ্টতারতো একটা সীমা-পরিসীমা থাকা চাই! এ নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনার পর জানা গেল সরকারের হাইকমান্ড অসন্তুষ্ট হয়েছে! এরপরতো আর কারও বুঝতে বাকি থাকে না, হাইকমিশনারের হাসপাতালে যেতে সমস্যা কোথায়! বেচারাতো চাকরি করে। চাকরি রাখাইতো চাকরের মূল কাজ। তা হাইকমিশনার কখন গেলেন হাসপাতালে? যেদিন আব্দুর রাজ্জাক মারা গেলেন সেদিন! সংস্কারবাদী নেতার মৃত্যু হয়েছে বলে অ্যাডভান্স বাণী দিয়ে ফেলাতে সরকার বিপাকে পড়ায় তার লাইফ সাপোর্ট খুলে দিতে জনাব রাজ্জাকের স্ত্রী আর ডাক্তারদের রাজি করাতে? যাতে সরকারের মুশকিল আসান হয়? যদি এ প্রশ্ন ওঠে কী জবাব দেবেন হাইকমিশনার? মুক্তিযুদ্ধের নেতার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর দেখা গেল হাইকমিশনার সেখানে ভীষণ ব্যস্ত! কিভাবে লন্ডনের কোথায় প্রথম জানাজা করতে হবে, কিভাবে লাশ পাঠাতে হবে দেশে! এখন হয়ত সেখানে কোরানখানি, রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া মাহফিলও হবে। কিন্তু কে না জানে শুরুতে হাইকমিশন  গ্যারান্টার হতে রাজি না হওয়ায় সেখানে আব্দুর রাজ্জাকের চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়েছে! বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের নেতা আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি এসব অবহেলার কোন ক্ষমা নেই।
 
এখন তার মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর শোকের ধুম পড়েছে। দিস্তা দিস্তা কাগজের প্রেস রিলিজের মিছিলে দফায় দফায় শেষ হয়ে যাচ্ছে মিডিয়া অফিসগুলোর ফ্যাক্স মেশিনের কাগজ! তার লাশ দেশে আসার পর আরও অনেক কিছু হবে। গান স্যালুটসহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন, অনেক কান্নাকাটি, শোকসভার ধুম চলবে কিছুদিন। কিন্তু ক্ষতি যা হবার তাতো হয়েছে দেশের মানুষজন, শরীয়তপুরের মানুষজন আর তার পরিবারের। এই ক্ষতি সৃষ্টির হোতা তার প্রতি ক্ষমাহীন রাষ্ট্রীয় আর আওয়ামী লীগের অবহেলা! যার কিছুটা আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখাতে আছে। তোফায়েল আহমদের প্রতিক্রিয়ায় আছে। এ  প্রশ্নগুলো যখন উঠল, আরও উঠবে তার তাড়া থেকে কিন্তু দায়িত্বশীল যে যেখানে দায়ী তাদের পার পাবার কোন সুযোগ নেই। পাবলিকের গালি, আল্লাহ’র মাইরতো আছেই। আমরা আর কী করতে পারি? ভালবাসতাম তাকে, একজন সজ্জন, লড়াকু, গুণী মানুষ হিসাবে। আমরা শুধু কাঁদবই না, এসব  প্রশ্নের উত্তর চাইতেই থাকব। উত্তর দিতেই হবে।

কোন পলিটিক্যাল চোর-ছেঁচড় না, একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কারবাদী হিসাবেই তোমার মৃত্যু হলো রাজ্জাক ভাই। রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিকে আরও শানিত করবে তোমার মহান মৃত্যু! কারণ এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। উপেক্ষাবাদীরা সাময়িক শক্তিশালী। আমরা তোমাকে ভুলব না রাজ্জাক ভাই। এ যে আমাদের চোখের জল তা দিয়ে লিখব তোমার এফিটাফের হরফ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর্বে পর্বে তোমাকে মনে পড়বে। এ বিচার ছিল তোমার স্বপ্ন। এ বিচার হবেই। তোমার কসম। আমাদের সবার প্রিয় রাজ্জাক ভাইকে বেহেস্ত নসিব করো আল্লাহ।

ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।      

বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।