দীর্ঘ দিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। ক’দিন ধরেই তিনি জন্ম-মৃত্যুর নো-ম্যানসল্যান্ডের সন্ধিক্ষণে।
৯১ নবাবপুর রোডের ৩ কিম্বা ৪ তলায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস। নীচে সাপ্তাহিক গণমুক্তির কার্যালয়। গণমুক্তিতে কাজ করি আমি আর কবি নাসির আহমেদ। সে সত্তর দশকের শেষ দিকের কথা। তখন থেকেই রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে হাই/হ্যালো, পরিচয়। একবার কোনো এক ১৫ আগস্টে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে খ ম জাহাঙ্গীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে আমাদের কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সাজেদা চৌধুরী মেজাজ খারাপ করে অনুষ্ঠানের মাঝে হঠাৎ কবিতা পাঠ বাতিল করে বক্তৃতা দেয়ার ঘোষণা দিলেন। আমরা বিব্রত হয়ে মঞ্চে মহাদেব সাহাকে রেখেই আমি আর ফারুক মাহমুদ নেমে আসি। মঞ্চে থেকে নীচে নামতেই বিনয়ের সাথে দুঃখ প্রকাশ করলেন আব্দুর রাজ্জাক ভাই। সাজেদা চৌধুরীদের সাথে এই হচ্ছে আব্দুর রাজ্জাকের মৌলিক পার্থক্য।
আমার লেখা গবেষণাগ্রন্থ ‘শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব’ তথ্যের ভান্ডার দেখে রাজ্জাক ভাই বলেছিলেন, এতো ইনফরমেশন কোথায় পেলে? বহুদিন পর তাঁর ধানমন্ডির ফ্ল্যাটে সাৎক্ষাকার নিতে গেলাম। সাথে ছিলেন অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজাদ। তখনও সেই বইটির কথা আবারো বললেন তিনি!
এই মহান মানুষটি ষাট দশকে ছাত্রনেতা থেকে ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ আন্দোলন, ৭০-এর মুক্তিযুদ্ধ সাংগঠনিক নেতৃত্ব, ৭৫-এ ববন্ধু হত্যার প্রতিবাদ, পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ’৯০-এর শুরুতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে তিনি নেতা নয়, একজন কর্মীর মতো রাজপথে লড়াই করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন অসংখ্যবার । ৬/৭ বার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া তিনি শান্তি আন্দোলনেও অবদান রেখেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এ ভাবেই অসাম্প্রদায়িক একটি বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন আব্দুর রাজ্জাক। বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে তাঁর নাম জড়িয়ে থাকবে গৌরবোজ্জ্বল ভাবে।
দেশের দুঃসময়ে, দুর্দিনে তিনি যে ভাবে দৃঢ়তার সাথে জেগে উঠতেন, অনেক বড় বড় নেতার ক্ষেত্রে তা দেখাই যায় না।
মনে পড়ছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ আদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ। মানুষের প্রচন্ড ভীড়, প্রচন্ড তপ্ত রোদ। তার মধ্যে তিনি ঘেমে একাকার। কপাল চুয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিটা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। ভীষণ ভীড়ের ভেতর পাঞ্জাবিটা ছিঁড়ে গেছে। গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে। সেই অবস্থায় উত্তাল জনতাকে তিনি ট্রাকের উপর থেকে ভাঙ্গা গলায় চিৎকার করে থামাচ্ছেন, নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেই দৃশ্য আমি কোনো দিনই ভুলতে পারবো না।
যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার তিনি দেখেছেন। কিন্তু গোলাম আযমদের প্রকৃত বিচার দেখে যেতে পারলেন না। এটাই আফসোস।
নানা কারণেই আজো রাজ্জাক ভাইয়ের বড্ড প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তাঁকে চিৎকিসার জন্য দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে হলো। আর বিদেশ থেকে চলে গেলেন চির পরবাসে। তিনি আর দেশে ফিরলেন না। সবাই বলছেন, খবরে জানাচ্ছে- আব্দুর রাজ্জাক আর নেই। নাহ, রাজ্জাক ভাই মরেন নি। আমি মনে করি, রাজ্জাক ভাই আছেন- বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে। রাজ্জাক ভাই থাকবেন- বাংলার মানুষের হৃদয়ে।
saifullahdulal@gmail.com