ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এটা কিন্তু আম

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১১
এটা কিন্তু আম

লিখতে চেয়েছিলাম ‘দ্য টাইমস’  ম্যাগাজিনে বাংলাদেশ সরকারের ক্রোড়পত্র নিয়ে। কিন্তু এ ধরনের অপচয়তো সরকারের পক্ষ থেকে অহরহ ঘটেই চলেছে।

তারপরেও উপেক্ষা করাটা কি তাদের বেহিসাবী পথকে আরো খোলাসা করে দেওয়া নয় কি? প্রকাশিত ক্রোড়পত্রের ওপরে এরই মধ্যে বেশ কিছু সুন্দর লেখা ছাপা হয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্রে। বাংলানিউজে অনেকগুলো বিশ্লেষণধর্মী লেখাও এসেছে। এখানে আমি ক্রোড়পত্রের বাইরেও প্রাসঙ্গিক কিছু জরুরি বিষয়ে আলোকপাতের সাথে সাথে আগের লেখাগুলোর না বলা জায়গাগুলোতে কলম ঘুরানোর চেষ্টা করবো।

গরীবের গৌরীসেন
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে যেভাবে বিদেশ সফর করেন, তাতে কে বলবে আমাদের অর্থের অভাব? প্রধানমন্ত্রীর ডিগ্রি লাভের বাতিকের কারণে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকে তড়িঘড়ি ছুটে যাওয়া দেখে কে বলবে এ দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে? রাষ্ট্রীয় সফরে যে বিশাল বহর এবং আত্মীয়-স্বজনের কাফেলা সরকারি অর্থের শ্রাদ্ধ করে, এই অপচয়ের জবাব কি?

বর্তমান সরকার প্রতিটা ক্ষেত্রেই চমক সৃষ্টি করতে ভালবাসে। নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তিতে তারা বেশ পারদর্শী। সরকারি অর্থের অপচয়ের নতুন সেক্টর টাইমস পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে আবারো মুন্সীয়ানার পরিচয় দিলেন (যদিও তা আমাদের দেশে হকারের মাধ্যমে পত্রিকার মধ্যে করে লিফলেট বিতরণ করার মতো)। সরকারি কোষাগারেরর কোটি কোটি টাকা পানিতে ফেলে দিয়ে তারা প্রমাণ করলেন, দেশের মানুষ গরীব হলেও সরকার অতোটা কৃপণ নয়। অকারণে টাকা ঢালায় তারা গৌরীসেন। উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে কোন মন্ত্রী বা সরকারপ্রধান সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণে গেলে তাকে জবাবদিহি করতে হয়। যে টাকা খরচ করে এলেন তার বিনিময়ে কতোটুকু দেশের স্বার্থ বয়ে এনেছেন, দিতে হয় তারও হিসাব। কিন্তু আমাদের বেলায়? সরকার কি কখনো বলেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ যাত্রার খরচের বিনিময়ে আমরা কি পেয়েছি? কিংবা ক্রোড়পত্র দ্বারা আমাদের দেশ কিভাবে, কতোটুকু উপকৃত হবে? বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে সরকারি অর্থের এই অপচয়ের কি বিচার হবে না কোনোদিন?

বাস্তবতা নাকি স্বপ্নের বর্ণনা
আমাদের স্বপ্নবাজ সরকার শুরু থেকেই স্বপ্ন ফেরি করে চলেছেন। কিন্তু দেশের জনগণ গুপ্তহত্যার দুঃস্বপ্নের কারণে সরকারের স্বপ্নে বিভোর থাকতে না পারায় স্বপ্ন ব্যাপারী সরকারপ্রধান, সাত সমুদ্র ডিঙিয়ে জাতিসংঘে তার বিশ্বশান্তির সওদা ফেরি করে এলেন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্বপ্নগাথা লেখালেন ক্রোড়পত্রে। সেখানে দেশের উন্নয়নের যে বিবরণ আছে বাস্তবতার সাথে টালি মেলালে তার দেখা মেলা ভার। যেখানে প্রতিদিন মানুষ অপহরণ, হত্যা, পুলিশি নির্যাতন, রাহাজানি এবং অন্যান্য অপরাধের অসহায় শিকার হচ্ছে সেখানে স্বপ্নের হাটে বেচাকেনায় মন্দা ভাব আসতেই পারে। সরকার সেই স্বপ্নের মন্দাভাব কাটাতেই হয়তো জাতিসংঘ এবং টাইমস পত্রিকার মাধ্যমে একটা চেষ্টা চালিয়েছেন। এতে অখুশী হবার কারণ কি? মিথ্যা হলেও স্বপ্নতো!
কোনটা সত্য?

এখন ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়’। বিদেশের এক প্রভাবশালীর ব্যক্তির এই মন্তব্যে দারুণ খুশী সরকার। হায়রে বোকা! তার অর্থ কি দাঁড়ালো? স্বীকার করে নেওয়া নয়কি যে, এক সময় বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি ছিল? এবং সেটা এই দলেরই শাসনামলে, স্বাধীনতার পরপর। কিন্তু এ যাবতকাল আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় সেটা অস্বীকার করে এসেছে। এবার কি বর্তমান সরকার সেটা স্বীকার করে নিলেন?

ক্রোড়পত্রে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দারিদ্র বিমোচনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সাগরতুল্য ব্যাপক সাফল্যের দাবি করা হয়েছে, সেটা কি এই সরকারের বিগত মাত্র ২/৩ বছরে সম্ভব? তাদের কাছে কি আলাদীনের প্রদীপ আছে? তাহলে নিশ্চয়ই সেখানে বিগত সরকারগুলোরও অবদান আছে। কিন্তু সে কথাতো সরকার কখনেই স্বীকার করে না। তাহলে মিথ্যা কোনটা? ক্রোড়পত্রে বর্ণিত তথ্য নাকি বিরোধী দল অর্থাত বিগত সরকারগুলো কিছুই করেনি বলে তারস্বরে সরকারের চিৎকার?

গরিবের টাকার রিসাইকেল
জান্ক মেইল কি জানতাম না। অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেশনের প্রথম দিকে কাজ না পেয়ে জান্ক মেইল বিলি করতাম। ‘দ্য মেসেঞ্জার’ নামে বিনা পয়সার পত্রিকা সে রকমই একটা জান্ক মেইল। লেটার বক্সে কিংবা ড্রাইভ ওয়েতে ছুড়ে ফেলতাম একদিকে, অন্যদিকে আমি দৃষ্টিসীমার বাইরে যাবার আগেই অনেকেই সেটা হাসি মুখে তাকিয়ে, কেউবা রাগান্বিত ভঙ্গিমায় ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতো। মাঝে মাঝে মনে হতো, আমাকেই ছুড়ে মারছে হলুদ বিনে। এখানকার মানুষ তিন রকমের বিন ব্যবহার করে, তিন রকম আবর্জনার জন্য। লাল বিন বাসাবাড়ির আবর্জনা ফেলার জন। যেমন তরকারি, এটো জিনিস ইত্যাদি। হলুদ বিন হচ্ছে রিসাইকেল জিনিসপত্র যেমন কাগজ, কাচ, প্লাষ্টিক ইত্যাদি ফেলার জন্য এবং সবুজ বিন হলো ঘাস, গাছের পাতা, ডালপালা ইত্যাদির জন্য। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, সরকারের সেই ক্রোড়পত্র বিলির পর অধিকাংশের প্রথম এবং শেষ গন্তব্যস্থল হয়েছে রিসাইকেল বিন। চোখের সামনে ভেসে ওঠা সেই মেসেঞ্জার ম্যাগাজিন সরে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি টাইমস পত্রিকার সাথে বিলিকৃত সেই ক্রোড়পত্রগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে বিনে ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বা বাংলাদেশে কি হচ্ছে, তা ব্রিটিশদের কাছে মোটেও আগ্রহের নয়। বিনে ছুড়ে ফেলা ক্রোড়পত্রগুলো নিছক কাগজ নয়। এদেশের গরিব মানুষের, খেটে খাওয়া মানুষের টাকা। আমাদের দেশের মানুষের কষ্টের টাকা কাগজ হয়ে বিদেশের মাটিতে রিসাইকেল হবে, ভাবতেই কুঁকড়ে ওঠে বুক!

বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে পরিচয়
যে উন্নয়নের কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটার সাথে যাদের কাতারে দাঁড়িয়ে একই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে, তাতেই বোঝা যায়, উন্নয়নের ধরনটা কেমন? আপর রিচ ২০১০ সালে প্রলুব্ধ করেছিল জাম্বিয়া, সিয়েরা লিওন, আজারবাইজান, দঃ কোরিয়া, আফ্রিকা, মালাউয়ি ও ঘানা এই ছয়টি দেশকে। কিন্তু আপার রিচের এই বিজ্ঞাপন ফলপ্রসূ না হওয়াতে ২০১১ দেশের সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র দুটোতে। এর একটি কেনিয়া এবং অপরটি আমরা। এর আগে যারা একই পথ অনুসরণ করেছিল, সে সব দেশের অর্থনীতি, জীবনযাত্রা এবং আইন শৃঙ্খলার অবস্থা কেমন সেটা নতুন করে পাঠকদের বলতে যাওয়া তাদের সময়ের অপচয় করানো। সত্যিকারের উন্নয়ন ঘটলে সেটা জানাতে কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতে হয় না। এমনিতেই লোকজন জানতে পারে। ফলের পরিচয়েই জানা যায় বৃক্ষের নাম।

খায় দায় মালেক, মোটা হয় সালেক

সারা বিশ্বে আপার রিচ কোন কোন দেশের পক্ষ হয়ে এসব কাজ করেছে, সেটা দেখলেই বোঝা যাবে এর গুরুত্ব এবং বস্তুনিষ্ঠতা। এই ক্রোড়পত্র নিয়ে নানামুখী ব্যবসা হয়েছে এবং আরো হবে। আপার রিচ তো এটা ছাপিয়ে প্রথম দফা কামিয়ে নিয়েছে। যে পত্রিকা সরকারের বিরুদ্ধে (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নয়) লিখেছে, সেই টাইমসও তার পুরস্কার হিসেবে ক্রোড়পত্র ছাপিয়ে কামিয়েছে। দেশের ভিতরে রাজনৈতিক ফায়দা নেবার পালা শুরু করবে সরকারি দল। গ্রামেগঞ্জে পত্রিকার খবর দেখিয়ে বলবে, দ্যাখ দ্যাখ যে পত্রিকা সরকারের বিরোধিতা করেছিল, তারাই এখন আপার ছবি দিয়ে সত্যি খবরটা ছাপিয়েছে। ক্রোড়পত্র আর পত্রিকার নিউজের মধ্যে যে বিশাল ফারাক সেটা সবাই নাও বুঝতে পারে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কে ছাড়ে! ওদিকে যার পকেটের টাকা সেই জনগণের কোনও মুনাফা নেই এই কোটি টাকার লগ্নিতে। কি তামাশা! খায় দায় মালেক, মোটা হয় সালেক! কার টাকা কে খরচ করে ফায়দা লোটে!

ছোট বেলায় আম আঁকলেও কেউ ধরতে পারতো না, ওটা কি আম নাকি কাঁঠাল। তাই নিচে আবার বড় করে লিখে দিতে হতো, ‘এটা কিন্তু আম’। আমাদের সরকারের উন্নয়নও এতো চোখা যে খালি চোখে সেটা ধরা যায় না। তাই বিদেশের পত্রিকায় কোটি টাকা ব্যয় করে  প্রচার করতে হয়। জাতীয় অর্থের অপচয়ের কি বিচার হবে না?

mahalom72@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।