সময়টা ২০০৯ সাল। দৈনন্দিন নানা সংকটের মাঝেও দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রধান বিদ্যাপীঠ ব্রজমোহন কলেজে শুরু হলো ভিন্ন এক দাবির আন্দোলন।
যেভাবে গড়ে ওঠে আন্দোলন
২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিএম কলেজের অশ্বিনী কুমার হলের ৩০৪ নম্বর কক্ষে বৈঠক বসে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃরা। বিএম কলেজে কেন ভাস্কর্য হচ্ছে না কিভাবে এ বাঁধা টপকে দাবি আদায় করা যায় এসব নিয়ে চলে দীর্ঘ আলোচনা। এরপর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় আন্দোলন কমিটি গঠন করতে হবে। ওই রাতেই ২১ সদস্যবিশিষ্ট ভাস্কর্য নির্মাণ আন্দোলন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় আবদুলাহ মাহফুজ অভিকে এবং সদস্যসচিব করা হয় জাহিদ আবদুলাহ রাহাতকে। শুরুটা একটু রাখঢাক রেখে গোপনেই মাঠে নামে আন্দোলনকারীরা। নানা ধরনের বাধার কথা চিন্তা করে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন শুরু করার আগে তারা প্রচারণা ও জনসংযোগের কাজ চালিয়ে যায়। প্রতিরাতে ছাত্রাবাসগুলোতে চলতে প্রচারণা। আর দিনে ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া হতে থাকে। অল্প দিনেই গড়ে ওঠে ব্যাপক সমর্থন পাওয়া যায়।
৩ মার্চ কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ননী গোপাল দাসের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় আন্দোলন।
এক ভিন্ন ধারার আন্দোলন হিসেবে এর জনপ্রিয়তা ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে শহরে পৌঁছে যায়। প্রথম দিনই জাতীয় পতাকা নিয়ে গানের মিছিল বের হয় ক্যাম্পাসে। ছোট মিছিলটি ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে ওঠে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে। আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেয় সহিংস, ভাঙচুর নয় নিয়মতান্ত্রিকভাবেই দাবি আদায় করে নেওয়া হবে। একে একে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি, পতাকা মিছিল, গানের মিছিল, সংহতি সমাবেশ, গণসঙ্গীত ও প্রতিবাদ সমাবেশসহ প্রায় প্রতিদিনই চলত নানা কর্মসূচি।
এসব কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনের গণ্ডি ক্যাম্পাসের বাইরে পৌঁছে যায়। সংহতি সমাবেশে আসেন শহরের বিশিষ্টজনেরা। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধাসহ নানা পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আসেন বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতারা। বিভিন্ন কলেজের পক্ষ থেকেও শিক্ষার্থীরা এসে দাবির পক্ষে সংহতি জানিয়ে যান। সংহতি সমাবেশ শেষে নবীন প্রবীণরা মিলে বিএম কলেজে ভাস্কর্য নির্মাণের দাবিতে মিছিল বের করেন। যা বিএম কলেজে এক আরেক ইতিহাস তৈরি করে। এবাবেই আন্দোলনটি সর্বস্তরে ছড়িয়ে পরে।
যে কারণে গণদাবি বাস্তবায়ন হচ্ছে না
আন্দোলন কমিটির দাবি, বরিশাল প্রগতিশীল শহর হিসেবে পরিচিত হলেও এখানে মৌলবাদীরাও বেশ সংগঠিত হয়ে উঠেছে সবার অলক্ষে। তারা বেশ শক্তিশালী হিসেবে প্রমাণ করেছে নানা তৎপরতরায় মাধ্যমে। একই সঙ্গে অপরাজনীতিকেও দায়ী করা হয়েছে।
বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের নামে বাঁধা
ভাস্কর্য নির্মাণের দাবি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের নাম ব্যবহার করে ভাস্কর্য নির্মাণ না করার জন্য হুমকি দেওয়া হয়। কোরআন সুন্নাহ রক্ষা কমিটি নামে একটি গ্র“প কলেজে এসে কর্তৃপক্ষকে জানায়, ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হবে। এ ভাস্কর্য ভেঙে ফেলারও হুমকি দেয় তারা। ভাস্কর্য নির্মাণ আন্দোলন কমিটির আহবায়ক ও সদস্য সচিবকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে মৌলবাদী চক্রটি। ইমাম সমিতির একটি পক্ষ জুমার নামাজ শেষে শহরের মসজিদে মসজিদে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরুদ্ধে এবং আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের নামে ফতোয়া দিয়ে তাদের মুরতাদ ঘোষণা করে প্রতিহত করার আহবান জানায়।
বাধা সত্ত্বেও আন্দোলন জোরালো হয়
নানা বাঁধা সত্ত্বেও জোরালো হয় আন্দোলন। দাবির প্রতি একত্বতা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের কয়েক শিক্ষার্থী ছুটে আসে বিএম কলেজ। তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন কবি ও গীতিকার গায়ক কফিল আহমেদ, কবি অভিজিত দাস, ভিন্ন ধারার গানের দল চিৎকার ও মনোসরণী। তারা সেখানে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। টানা তিনমাস আন্দোলন চলার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে নেয়।
কৌশলে আন্দোলন ভাটায়
দাবি মেনে নেওয়ায় থেমে যায় আন্দোলন। কিন্তু দাবি মেনে নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে একমাস বিরতির পর আবার শুরু হয় আন্দোলন। এবার কলেজ একাডেমিক সভা করে দাবি মেনে নেওয়ার পক্ষে মত দেয়। দ্বিতীয় বারের মতো জানানো হয় এবার দাবি মানা হয়েছে। আবার থেমে যায় আন্দোলন। এবারও একই চিত্র। ভার্স্কয নির্মাণে শুরু হয় গড়িমসি। ততোদিনে আন্দোলনের বয়স একবছর অতিক্রম করেছে।
নির্মাণ করা হয় প্রতিবাদী ভাস্কর্য
আন্দোলনের এক বছর অতিক্রম কালে কমিটির পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয় প্রতিবাদী ভাস্কর্য। ভাস্কর্য কেন নির্মাণ করা হয় না তার প্রতিবাদে ওই প্রতিবাদী ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। ভাস্কর শিল্পী সাংবাদিক প্রাচুর্য রানা।
বাড়তে থাকে টালবাহনা
আন্দোলন দীর্ঘ হয় আর কলেজ কর্তৃপক্ষ দাবি মানতে নানা টালবাহানা করতে থাকে। কখনো মৌলবাদী গোষ্ঠীর দোহাই, কখনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দোহাই দিয়ে দাবি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে টালবাহানা চলতে থাকে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকেও আশ্বাস আসে তা বাস্তবায়ন আর হয়নি। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেননের কাছেও স্মারকলিপি দেওয়া হয়। কিন্তু দাবি আর বাস্তবায়ন হয়নি।
দেড় বছরের আন্দোলনের অপমৃত্যু
জনপ্রিয় আন্দোলনটি দীর্ঘ দেড় বছর চলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশ নেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু মাঝপথে কমিটি দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আন্দোলন কমিটি জনপ্রিয় হওয়ায় তা ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় ক্ষমতাসীন দলের কয়েক নেতা। কমিটিতে তাদের অনুসারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদ দখলের চেষ্টা চালায়। এ নিয়ে শুরু হয় জটিলতা। এ কারণে তৎকালীন কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন কমিটির নেতৃবৃন্দ। তারা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান কমিটিকে আদর্শচ্যুতভাবে অপব্যবহারের চেষ্টা চালানোর কারণে আমরা পদত্যাগ করলাম। কমিটির আহবায়ক, যুগ্ম-আহবায়ক, সদস্যসচিবসহ ১৯ জন একযোগে পদত্যাগ করায় কমিটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
অধ্যক্ষ যা বললেন
ভাস্কর্য নির্মাণ হোক তা আমরাও চাই। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
আন্দোলন কমিটির নেতৃবৃন্দ যা বললেন
কমিটির পদত্যাগী আহ্বায়ক আবদুলাহ মাহফুজ বলেন, আসলে আমরা একটা আদর্শিক জায়গা থেকে লড়াইটা শুরু করেছিলাম। আমরা আমাদের চেতনা থেকে লড়াই করেছি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্বাস থেকে আন্দোলনে যোগ দিয়ে তা গতিশীল করেছে। তাই আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করতে পারিনি বলেই পদত্যাগ করেছি। আসলে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা তাদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য এ কমিটিকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়া নিয়েছিল। তবে আমি বিশ্বাস করি, এ আন্দোলন থামেনি, চলছে। যে কোনো মুহুর্তে আবার গর্জন শোনা যাবে।
পদত্যাগী সদস্যসচিব জাহিদ আবদুলাহ রাহাত বলেন, ‘সবাই এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এটা ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের আন্দোলন। আমাদের ধমনিতে শহীদের রক্ত। সুতরাং এ লড়াই চলবে। আবার আন্দোলন হবে। ভাস্কর্য বিএম কলেজে নির্মাণ হবেই। ’
সাধারণ শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, ‘বাংলাদেশের সব বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাস্কর্য রয়েছে। কিন্তু কেন তাদের এ প্রতিষ্ঠানটি ভাস্কর্য নির্মাণ হচ্ছে না?’
লেখক: সংবাদকর্মী
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০১১