রাষ্ট্র, দর্শন বা সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন শ্রেণীর লোকগুলো চিন্তা করবে তা আমরা কল্পনায় ছবি এঁকে রেখেছি। এরা কালো স্যুট-টাই পরে।
প্রতিদিন জংধরা টিনের প্লেটে মরিচ পোড়া কচলে পান্তাভাত খেতে খেতে কেউ রাষ্ট্র, দর্শন বা ধর্ম সম্পর্কে গভীর বক্তব্য দিচ্ছে এমন কারো ছবি আমরা কল্পনায় আঁকি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে গরুর খোঁয়াড়ে গিয়ে নিজ হাত দিয়ে গোবর টুকরিতে ভরে মাথায় করে কাঁধে লাঙল নিয়ে বর্গা জমি চাষ করতে চলে যান, সন্ধ্যায় ক্লেদাক্ত লুঙ্গি পরে সংগীত নিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন এমন ছবি আঁকতে আমরা অপছন্দ করি। আমরা এই মানুষগুলোর চিন্তা নিচু স্তরের বলে জ্ঞান করি। তবুও তারা বসে নেই। টিনের প্লেটে ভাত খেয়েই আরজ আলী মাতুব্বর ধর্ম ও সমাজ সম্পর্কে দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন । তালি দেওয়া ভেজা লুঙ্গি পরে হারিকেনের আলোয় গান লিখেছেন শাহ আব্দুল করিম। তার গান শোনার জন্য ব্রিটেনের রানীর প্রাসাদে জলসার আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি গেয়েছেন, কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া ...।
যে যাই ভাবুক তৃণমূলে খেটে খাওয়া মানুষগুলো সম্পর্কে আমার উৎসাহ প্রচন্ড। ভিক্ষুক, ট্রাক ড্রাইভার, হোটেল বয়, মুদি দোকানদার, ফুটপাতের চায়ের দোকানদার এদের সাথে প্রায়ই রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলি। এরা সরকার বা দেশ নিয়ে কোটপরা ভদ্রলোকদের চাইতে বেশিই চিন্তিত। সরকার ব্যর্থ হলে বা কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিলে টিভি টকশোতে দৃশ্যমান বিদ্বান ব্যক্তিদের কিছু আসে যায় না। কিন্তু এসব তৃণমূল মানুষদের পেটে সরাসরি লাথি পড়ে। তাই তারা সরকার নিয়ে ভাবে। নিজের মতো করে সমালোচনা করে। নিজেদের সমস্যার আলোকে পরামর্শ দেয়। ডক্টরেটদের চাইতে তাদের পরামর্শ প্রায়শই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। তাই আমি চায়ের দোকানকে মিনি সংসদ বলি। মিনি সংসদ নিয়ে আমার একটি লেখা ইতিপূর্বে বাংলানিউজে প্রকাশিতও হয়েছে।
আমার লেখায় প্রায়ই চেষ্টা করি তৃণমূল মানুষের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরতে। তৃণমূলের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর দর্শন, চিন্তা ও কথা বলার শৈলী আমাকে অভিভুত করে। গত সন্ধ্যায় শহীদমিনার হয়ে পলাশীর দিকে যাচ্ছিলাম রিকশায়। ঠান্ডায় কাঁপছিলাম। রিকশাচালক জনাব আজাহার উদ্দিন বয়স ষাটের কাছাকাছি। জিজ্ঞেস করলাম- চাচা মিয়া, ঠান্ডায় রিকশা চালান। কষ্ট হয় না?
তিনি উত্তর দেন- হ । হয়ই তো। কি আর করমুরে বাপ!
বললাম, ছেলে মেয়ে নাই। এই বয়সে এত কষ্ট করেন!
- আছে। দুই পুলা। বড় পুলা এমএ পাস দিছে। বেকার। ছোট পুলা পলিটেকনিক পড়ে।
- যাক, তাহলে তো আপনার আর চিন্তার কোন কারণ নেই। বড় ছেলে চাকুরি পেলেই আপনার অবসর। রিকশা চালাতে হবে না।
রিকশাওয়ালা আজাহার মিয়া কিঞ্চিৎ হাসলেন। তীর্যক রসিকতার সুরে বললেন, আগের চাইতে বরং দুই বছর বেশি রিকশা চালান লাগবে।
আমি জিজ্ঞেস করি- কেন ?
- আমার মতো বুড়োগুলার চাকুরির মেয়াদ সরকার দু বছর বাড়াই দিছে। তাই আমারও দু বছর বেশি রিকশা চালাইতে হবে। রিকশা না চালাইয়া যামু কই।
বৃদ্ধ আজাহার মিয়ার কথার মারপ্যাঁচে আমি অবাক হই না। যিনি রিকশা চালিয়ে দুটি ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন তার এই চিন্তা ভাবনা আর উচ্চ মাত্রার রসিকতা আমার কাছে যথেষ্ট স্বাভাবিক। তিনি আবার বলা শুরু করেন-
- আমার মতো বুড়াগুলার চাকুরির মেয়াদ বাড়াইয়া সরকারের কি লাভ? এখন দরকার ইয়ং পোলাপান। কম্পুটার, মোবাইল এগুলা বুড়া মানুষগুলা চালাইতে পারে না। একদিন জনতা ব্যাংকে গেছি। দেখি, একটা বুড়ামানুষ কম্পুটারে খালি গুতায়। আধা ঘণ্টা পরে একটা পোলা বয়সী লোক আইসা কিভাবে চালায় তারে বুঝাইয়া দিয়া গেছে। তারপরও ব্যাডা খালি গুতায় আর গুতায়। কিচ্চু বুঝে না তো। না গুতাইয়া করবোটা কি? আপনে বলেন স্যার, এই লোকগুলার চাকুরি দুই বছর বাড়াইয়া কোনো লাভ আছে? দেশের কি উন্নতি এরা করবো?
- আমার বয়সী লোকের চাকুরি না বাড়াইয়া আমার পুলার বয়সী লোকগুলার চাকুরি দিলে তো ছেলেগুলো আর বেকার ঘুরে না। কাজ কামে স্পিড বাড়তো ...
বৃদ্ধ আজাহার মিয়ার উক্তিগুলো হয়তো ঠিকমতো আমি লিখতে পেরেছি। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা আর তীর্যকতা লেখায় প্রকাশ করার ক্ষমতা স্রষ্টা আমাকে দেননি। দিলে আপনারা এর উত্তাপ টের পেতেন। সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরির মেয়াদ দু’বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত তার কাছে হঠকারিতা মনে হয়েছে। আমার কাছেও তাই।
পত্রিকায় দেখলাম সচিবালয়ে সচিব, উপসচিব এবং এদের কাছাকাছি পদ মর্যাদার ১০৮ জন কর্মকর্তা এতে লাভবান হয়েছেন। তারাই সরকারকে প্রভাবিত করেছেন এ সিদ্ধান্তে। রাষ্ট্র কতটুকু লাভবান হয়েছে, বেকার পুত্রদায়গ্রস্ত পিতা আজহার মিয়ারা কতটুকু লাভবান হয়েছে তা আমরা জানি না। এই চাকরিজীবী অকেজো বুড়াগুলোর শেষ বয়সে বুড়ির কাছে সোনার ডিমপাড়া হাঁসের মতো একটু আদর-সোহাগ বাড়বে বৈ কোন সুবিধা আমি দেখছি না।
লেখকঃ মনোয়ার রুবেল
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও ব্লগার।
ই-মেইল: monowarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১১