জাতীয় প্রেসক্লাব। তোপখানা রোড, ঢাকা।
পরে দেখি তরুণ সাংবাদিক, নির্মাতা, সাংস্কৃতিককর্মী শহিদুল ইসলাম মিন্টু! মিন্টু কীভাবে এতো জনপ্রিয় হলো? তার জনপ্রিয়তার কারণ একটু পরেই বুঝতে পারলাম। সদ্য সমাপ্ত ঈদে বাংলাদেশের প্রথম বেটা ফরমেটের ফিল্ম ‘দেবদাস’ বানিয়ে মাৎ করেছেন। সেটা ঈদের বিশেষ আয়োজন হিসেবে প্রচার হয়েছে চ্যানেল আইতে। তাই অভিনন্দনের আনন্দ ও বিড়ম্বনা। আবার তখন সে বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টও। ঢাকায় এভাবেই মিন্টুকে দূর থেকে, কাছ থেকে দেখা? মাঝে মধ্যে বাংলা একাডেমীর বইমেলার আড্ডায় কিংবা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অথবা আজকের কাগজ অফিসে কখনো কখনো মুদ্রিত অবস্থায় গল্পের মাধ্যমে পত্রিকার পাতায় মিন্টুকে পেয়েছি। হঠাৎ একদিন শুনি, মিন্টু নেই। সব ছেড়ে-ছুড়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। যেহেতু প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করি, সেহেতু তার প্রতি আমার একটু আগ্রহ বাড়ল। কিন্তু নাটাই ছিঁড়ে হারিয়ে যাওয়া মিন্টুকে আর পেলাম না।
২০০৬-এর জুনে আমি অটোয়ার একটি চার্চের চমৎকার চাকরি ছেড়ে টরন্টোতে এসে সাপ্তাহিক বাংলা রিপোর্টার-এ যোগ দিলাম। হঠাৎ এক বিকেলে ৪১৬-৬৯০-৫০২২ ফোন এলো। ‘দুলাল ভাই, আমি মিন্টু। অফিসে আছেন তো? আমি ১০ মিনিটের মধ্যে আসছি!’
নাটাই ছেঁড়া ঘুড়ি উড়ে যেন আটকে পড়লো ২৭৭০ জনফোর্থ এভিনিউস্থ বাংলা রিপোর্টারের ছাদে। বাহ! এই শহরে আরো একজন কথাশিল্পী, সাংবাদিক, নির্মাতা! আনন্দে মনটা ভরে গেলো। প্রবাসে একজন ভালো অনুজ বন্ধু পেলাম। মিন্টু অবশ্য তখন ব্যস্ত টরন্টো ফিল্ম স্কুলের পড়াশুনা নিয়ে।
কানাডা থেকে প্রচুর বাংলা পত্রিকা বের হয়েছে এবং হচ্ছে। যেমন: সাপ্তাহিক প্রবাস বাংলা, মাসিক বাংলাদেশ, সাপ্তাহিক দেশে বিদেশে, সাপ্তাহিক দেশ দিগন্ত, সাপ্তাহিক পত্রিকা, ইংরেজি সাপ্তাহিক মিরর, সাপ্তাহিক দূরদেশ, সাপ্তাহিক ড্যানফোর্থ, সাপ্তাহিক বসুন্ধরা, সুবর্ণ স্বদেশ, সাপ্তাহিক সময়, সাপ্তাহিক বাংলা রিপোর্টার, সাপ্তাহিক বাংলা নিউজ প্রভৃতি অধুনালুপ্ত। এখন প্রকাশ পাচ্ছে সাপ্তাহিক বাংলা কাগজ, দেশের আলো, আজকাল, যোগাযোগ এবং একমাত্র সাহিত্য পত্রিকা বাংলা জর্নাল।
যা হোক, ‘আমার হলো সারা তোমার হলো শুরুর মতো বন্ধ হয়ে গেলো বাংলা রিপোর্টার। যাত্রা শুরু করলো দ্য বেঙ্গলি টাইমস ডটকম। এক বছর যাবৎ নিয়মিত অনলাইন সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস দেশে বিদেশে পরিচিত লাভ করেছে, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শুনি। হিট হচ্ছে ৫০ হাজার কিন্তু দেখা হয় না। কারণ এখন এতো রঙ বেরঙের অনলাইন কাগজ বের হয় যে ভয়ঙ্কর অবস্থা!
এদিকে কবি অনন্ত আহমেদ কবিতা চাইতে চাইতে মহা বিরক্ত, তবে কখনোই প্রকাশ করেননি। (কিন্তু তা-ই হওয়ার কথা)। হাল ছেড়ে দিলেন অনন্ত। এবার মিন্টুর পালা! ফোনে, সাক্ষাতে সেই একই অনুরোধ, একটা লেখা দিন!
বাংলা কাগজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলা মিডিয়ায় কাজ করি। মিন্টু প্রায়ই এসে আড্ডা দেন আর বিনয়ের সাথে একই আবদার।
আমি বললাম, আমি তো লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছি। এখানে বিবিসির আফসান চৌধুরী, ইত্তেফাকের ইকবাল হাসান, দৈনিক বাংলার সুমন রহমান, ছোটদের কাগজের লুৎফর রহমান রিটন, নিউ নেশানের সেলিম সামাদ এমন কী আমাদের সময়-এর সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানও আসছেন। তাদের কাছে লেখা চাও। নাছোড়বান্দার মতো মিন্টু বললো, আমি সেই ছোটবেলা অর্থাৎ হাফপ্যান্ট পরা বয়স থেকে আপনার লেখা পড়ি। ... প্লিজ, দুলাল ভাই ...।
একদিন প্রয়াত আলাউদ্দিন আল আজাদের স্মৃতিচারণ করছিলাম। মিন্টু বললো, এটাই একস্লিপ লিখে দিন। এভাবেই মিন্টু খবরের কাগজের জন্য ইমদাদুল হক মিলনের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন ‘নূরজাহান’ উপন্যাসটি। (তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১১, ঢাকা)
অবশেষে আমি পরাজিত হলাম, জয় হলো মিন্টুর। আমার যাত্রা শুরু হলো বেঙ্গলি টাইমস-এ।
‘ভাষা সেনাপতি’ আলাউদ্দিন আল আজাদের ওপর লেখাটি নাকি অনেকেই পড়েছেন এবং প্রশংসা করেছেন। তাই আমাকে নিয়মিত লিখতে হবে। তারপর গত বছর থেকে লিখছি। মিন্টু তো প্রায়ই বলেন, দুলাল ভাই, আপনার প্রতিটি লেখা সর্বাধিক পঠিত টপ টেনের শীর্ষে থাকে। পাঠকের মধ্যে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া পাই। তারা আপনার লেখা পছন্দ করেন, কেউ কেউ অপছন্দও করেন। গালাগালি দেন। টের পাই।
বেঙ্গলি টাইমস এখন আমার প্রিয় পত্রিকা। বেঙ্গলি টাইমস-এর কাছে আমি কৃতজ্ঞ! কারণ এখন ঢাকার ৪/৫ টি দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখছি বেঙ্গলি টাইমসের কারণেই। নইলে হয়তো লেখা হতো না। সেইজন্য আগে বেঙ্গলি টাইমসে যায়, পরে তা দেশের দৈনিকগুলোতে পাঠাই।
বেঙ্গলি টাইমসের কিছু নেতিবাচক (!) দিক আছে। যেমন- তারা কখনোই নেগেটিভ নিউজ উপস্থাপন করতে চান না। মিন্টুর মতে, আমরা সবসময় পজিটিভ থাকতে চাই। জানি এটা তাদের নীতিমালা। কিন্তু নেগেটিভ হলেও তো সেটা সাংবাদ। যেমন-
১। একটি পরিবার নতুন ইমিগ্রেন্ট হয়ে এসে কানাডার ভয়াবহ চাকরির চিত্র দেখে তিন মাসের মাথায় ব্যাক টু দ্য প্যাভেলিয়ান। কিন্তু বেঙ্গলি টাইমস এই খবর ছাপতে রাজি না।
২। অন্যমেলার ২০১০-এ টরন্টো বইমেলা ৯৯.৬৬% ব্যর্থ। এই বিষয়ে বেঙ্গলি টাইমসের কাছ থেকে একটি রিপোর্ট আশা করেছিলাম।
৩। আমার লেখার নাম- শিরোনাম পাল্টানোর জন্য প্রায়ই সম্পাদকের অনুরোধ থাকে। মাঝে মধ্যে প্রাসঙ্গিক ছবিও বাদ দেওয়া হয়া হয়। বেঙ্গলি টাইমস নাকি পাঠকদের আহত করতে চায় না। কারণ মিন্টুর ভালোবাসা বুক ভর্তি! এ রকম আরো অনেক বিষয় আছে, যা নিয়ে মিন্টুর সাথে প্রায়ই দ্বিমত পোষণ করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলি আলাপও হয়। তবে বুঝি বেঙ্গলি টাইমস যে গতি ও নীতিমালা নিয়ে এগুচ্ছে, তাতে গ্রহণযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ছে দ্রুত।
আর সাফল্য? সে তালিকা দীর্ঘ। যেমন-
ক. অনলাইনে এই প্রথম একটি নিয়মিত এবং ব্যতিক্রমধর্মী পূর্ণাঙ্গ বাংলা সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস।
খ. দু’বছরের মাথায় সাপ্তাহিকটি পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৭৫ হাজার পাঠক তৈরি করেছে।
গ. লেখা নির্বাচন, সম্পাদনা, বস্তুনিষ্ঠতা, উপস্থাপনা অত্যন্ত রুচিশীল। এই কারণে বেঙ্গলি টাইমস সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে।
ঘ. বেঙ্গলি টাইমসের বেশ কিছু সংবাদ জাতীয় পর্যায়ে নাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টিভি চ্যানেলে বেঙ্গলি টাইমসকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে অসংখ্য সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচার করেছে। এ রকম একটি খবর হলো- ঘাপটি মেরে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর চৌধুরীকে কানাডায় আবিষ্কার। আর ডালিমের কানাডায় ঘুরে যাওয়া।
ঙ. বেঙ্গলি টাইমসের বড় কৃতিত্ব কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশের মূলধারার লেখকদের সম্মিলন ঘটানো। আরেকটি কথা না বললেই নয়। সেটা হলো বেঙ্গলি টাইমস কোন দলকে সমর্থক করে? কনজারভেটিভ, লিবারেল নাকি এনডিপি? আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি? না, গত দুই বছরে আমি সেটা আবিষ্কার করতে পারিনি। এক্ষেত্রে বেঙ্গলি টাইমস পুরোপুরি নিরপেক্ষ। তবে প্রগতি, আধুনিকতা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এই পত্রিকাটি সবসময় সচেতন ও সচেষ্ট।
তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, নাটাই ছেঁড়া মিন্টু এখন ওড়াচ্ছেন অন লাইনের রঙিন ঘুড়ি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৫, ২০১১