একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ! কফিন যেখানে গেল সেখানেই শুধু মানুষ আর মানুষ। আছড়ে পড়ল মানুষ এয়ারপোর্টের টারমাকে, গুলশানের বাড়িতে, সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়, জাতীয় ঈদগায়, কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে, শরীয়তপুরের ডামুড্যায়।
সব জায়গায় শুধু মানুষের সমুদ্র! অনেকদিন এমন দেখছে কী বাংলাদেশ? না তাদের সেখানে দাওয়াত করে আনা হয়েছে? অথচ সবশেষ তিনিতো কোন মন্ত্রী জাতীয় কিছু ছিলেন না! তিন বছর ধরে সাইজ-হয়ে-ঘরে-বসে-থাকা অপাংক্তেয় বিধবস্ত একজন! ঢাকায় তার যে কফিন এসেছে সেতো প্রাণহীন একজনের। আজকাল মিডিয়ায় তার যে সব ছবি ছাপা হচ্ছে সেগুলোর সঙ্গে ছবিটির কোনও মিল নেই। অথচ তার কফিন ঘিরে এত মানুষ আর মানুষের ঢল, কাঁদল মানুষ, লম্বা লাইনে হেঁটে অনেক সংগ্রামে কফিনের পাশে পৌঁছে ফুলের পাপড়ির মাঝে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে থাকা প্রিয় মানুষটির মলিন মুখখানি এক নজর দেখে প্রিয়জন হারানোর বিয়োগ ব্যথায় বুক চাপড়ে ডুকরে কাঁদল শুধু।
অথবা দূর থেকে মানুষের সমুদ্রের সঙ্গে হেঁটে চোখ মুছতে মুছতে বিড়বিড় বলে গেল মনের বেদনার কথা, তোমাকে ভুলব না রাজ্জাক ভাই। কী চমৎকার স্বাধীন একটি বাংলাদেশ তুমি আমাদের এনে দিয়ে গেলে! সেখানেই আকস্মিক অবাঞ্ছিত অবস্থায় অভিমানে চলে গেলে তুমি। যে যাই করুক অথবা বলুক আমরা তোমাকে ভুলবনা রাজ্জাক ভাই। তোমাকে যে ভুলে যাবার নয়। তোমার সঙ্গে অন্যায়কারীদের ছাড়ব না। এসব কী আওয়ামী লীগের হেড কোয়ার্টারে কোন বার্তা পৌঁছাতে পেরেছে? না আব্দুর রাজ্জাক মন্ত্রী ছিলেন না, সরকারের কেউ ছিলেন না বলেই কী তার প্রতি এমন এভাবে বিরল নিঃসংকোচ শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছে সব মতপথের মানুষ?
তার নিথর কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে ক্রন্দনরত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ছবি ছাপা হয়েছে বাংলানিউজের পাতায়। দীর্ঘ সংগ্রামে দু’জনে পাশাপাশি হেঁটেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে বর্তমান রাষ্ট্রপতি সেই কেবিনেটের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আর আব্দুর রাজ্জাক পানিসম্পদমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। আর দল এবার ক্ষমতায় ফিরলে তিনি রাষ্ট্রপতি আর আটবারের নিরবছিন্ন এমপি আব্দুর রাজ্জাককে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় নো-ম্যানসল্যান্ডে! এমনকি দলের মূলধারার কোথাও যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে না পারেন সে নিয়তে প্রেসিডিয়াম থেকে সরিয়ে দিয়ে খাগড়াছড়ি পোস্টিং’এর মতো তাকে গুরুত্বহীন অলংকারিক উপদেষ্টা পরিষদে হিজরত করানো হয়। লন্ডনের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দীর্ঘদিনের সংগ্রামের সহযাত্রী আব্দুর রাজ্জাকের জন্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান কিছু করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন, এমন কোন খবরও বেরোয়নি। এ নিয়ে কোন অনুতাপ বা অপরাধবোধ কী কাজ করছিল রাষ্ট্রপতির মনে? জানা গেল না।
খবরে বেরিয়েছে আব্দুর রাজ্জাকের পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে গিয়ে তার সঙ্গে নিজের রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণ করে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আব্দুর রাজ্জাক যেহেতু বঙ্গবন্ধুর হাতে দু’দফায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব আর গোটা পরিবারটির ঘনিষ্ঠ ছিলেন, আওয়ামী স্বেচ্ছাসবক লীগের নেতা হিসাবে একাত্তরের অসহযোগের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী ছিলেন। এমনকি একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্সের ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অমর কবিতাখানি বলার মহাসমুদ্রেও তাকে আনা-নেয়ার দায়িত্ব পালনও করেছেন। তাই শৈশব-কৈশোর থেকে কাছে থেকে দেখা স্বাধীনতার এই অন্যতম নিউক্লিয়াস চরিত্রটির তথা প্রিয় রাজ্জাক ভাই’র সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি থাকা স্বাভাবিক।
আর শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখনরাতো বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিবের কাছেতো শেখ কামাল, শেখ জামালের চেয়ে বেশি আপন-ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দলের সভানেত্রী করার পিছনে যাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আব্দুর রাজ্জাক তাদের অন্যতম। সেই কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী, আব্দুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এরপর থেকে কেন শুধুই ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার শিকার হতে থাকল বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ! বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ড কামাল, আব্দুর রাজ্জাকরা দলে থাকতে পারলেন না। আব্দুর রাজ্জাকরা পরে দলে ফিরলেও ফিরতে পারলেন না বঙ্গবন্ধুর বিশেষ ঘনিষ্ঠ ড কামালরা।
সেই আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা কেন আওয়ামী লীগে গণতান্ত্রিক সংস্কারের চিন্তা বা প্রস্তাব করবেন, তা কী কখনও ভাবা হয়েছে? বা এবার ভূমিধস বিজয়ের পর আব্দুর রাজ্জাকদের সাইজ দেবার কারণে আওয়ামী লীগ বা দেশের কোনও উপকার হয়েছে কী? ভূমিধস বিজয়ের তিনবছরের মধ্যে কী চেহারা এখন সরকারের? লন্ডনবাসিনী কার ভয়ে সেখানকার প্রবাসী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নিউক্লিয়াস চরিত্র গুরুতর অসুস্থ আব্দুর রাজ্জাকের হাসপাতালের আশেপাশে ভেড়ার সাহস পাননি? সর্বশেষ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত লন্ডনের হাসপাতালে তাকে দেখতে যাওয়ায়-তাকে সময় দেয়ার অপরাধে লন্ডনে কার চাকরির সমস্যা করা হয়েছে? বা ভিন্নমতের কারণে আব্দুর রাজ্জাকদের মতো নেতাদের এমন সাইজ দেয়া যায় কী? তাহলে কী মুক্তিযুদ্ধের নেতৃ্ত্বের সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগের তকমাটি নিষ্কলুস অক্ষুন্ন থাকে আর? বা এতে বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিবের সম্মান কী বাড়ে? একজন নেত্রীরতো সকল অনুরাগ-বিরাগের উর্ধ্বে থেকে দলের যোগ্য-অযোগ্যদের মূল্যায়ন করার কথা। প্রধানমন্ত্রীর শপথটাওতো সে রকম। আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর পর বিশেষ ফ্লাইট দিয়ে তার মরদেহ এনে প্রয়াত নেতাকে তার প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেবার ব্যবস্থার জন্য প্রশংসা পাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তার সঙ্গে যেসব অন্যায় করা হয়েছে তাতো স্বীকার করতে হবে আগে। নিরবে লুকিয়ে নয়। প্রকাশ্যে। এমন খবর দেশের মানুষ জানলে আখেরে ভালো হবে আওয়ামী লীগের।
ঢাকায় তার কফিনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বিএনপি নেতারাসহ দেশের নানান মতপথের মানুষ। মুফতি আমিনী বা তাদের কোন মোল্লা সংগঠন খুব স্বাভাবিকভাবেই আসেনি। বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্য পাকিস্তানি তালিবানি ভাবধারার এসব মোল্লা সংগঠনের কোন ভূমিকাও নেই। যারা বাংলাদেশে থাকে-খায় কিন্তু স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি এসব পালন করে না, জাতীয় সঙ্গীত গায় না, মুক্তিযুদ্ধের নেতা আব্দুর রাজ্জাকের কফিনের পাশে বা জানাজায় তারা আসবে তা কেউ ভাবেও না। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শোকবাণীতে মুক্তিযুদ্ধের নেতা হিসাবে তার প্রতি সম্মান জানিয়েছেন। সংসদ প্লাজায়, জাতীয় ঈদগায় তার জানাজায় গেছেন বিএনপির নেতৃবৃন্দ। তার কফিনে দিয়েছেন শ্রদ্ধার্ঘের পুষ্পস্তবক। সম্ভবত এর কারণে সে রাতে চারদলীয় বিজেপি নেতা আন্দালিব রহমান পার্থ’র ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতেও খালেদা জিয়া যাননি। এমন শোকের রাতে তেমন একটি খালেদা জিয়ার ছবি ভালো দেখাতোও না। প্রয়াত নেতার প্রতি এসব সম্মাননা অনন্য। কিন্তু এদিন কী একইভাবে তার সম্মানে বিএনপি নেতাদের অন্যসব খুচরো বক্তৃতা বন্ধ রাখা যেতো না? এসব বক্তৃতার আয়োজনতো মিডিয়া প্রচারের জন্যে হয়। যেমন প্রয়াত নেতার জানাজায় শরীক না হয়ে সরকারের একজন মন্ত্রী এদিন তার এলাকার একটি সার গুদাম উদ্বোধনের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন! অথচ এসবতো কান্ডজ্ঞানের বিষয়!
তার জানাজায় শরিক হতে ঢাকায় ছুটে এসেছেন সিলেট আর রাজশাহীর মেয়র সহ নানান জেলা-উপজেলার নেতারা। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে গায়েবানা জানাজা পড়ে তার বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করেছেন। অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি ব্যারিস্টার সিরাজুল হক, সহসভাপতি রবিন বনিক সহ নেতারা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় সিডনির শোকসভায় প্রার্থনার আগে প্রয়াত নেতার নানান কীর্তির স্মৃতিচারণ করেন। এভাবে সারা বাংলাদেশের নানান প্রান্তের মতো দুনিয়ার নানান শহর থেকে স্বজন হারানোর বেদনায় প্রবাসী বাঙ্গালিদের কান্নাভেজা সব প্রতিক্রিয়া আসছে। এসবের কোন বার্তা কী পাচ্ছে আওয়ামী লীগের হেড কোয়ার্টার? পেয়ে থাকলে তা বুঝে থাকলে ভালো। না থাকলে কিন্তু খবর আছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ক্ষমতার দাপটে ভিন্নমতের কারণে আক্রোশ দেখানোর সুযোগ নেই। এসবতো পুরনো এনালগ অভ্যাস! ডিজিটাল নেতানেত্রীদের তা মানায় না। এসব বেহিসেবি আচার-নকশা গোপনও থাকে না বেশিক্ষণ। এসবের আউটবার্স্ট ঘটলে কিন্তু আমছালা দুই-ই যায়। রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কর্মচারী ভাবার দিন শেষ।
সোমবারের জনকন্ঠে প্রয়াত নেতার স্মৃতিচারণমূলক একটি লেখা ছাপা হয়েছে। বন্ধু সাংবাদিক ওবায়দুল কবিরের সে লেখায় শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় শিকদার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রণাকাতর সময়ে আব্দুর রাজ্জাকের বলা কিছু কথা আছে। সারা শরীরে গ্রেনেডের স্প্রিন্টার বিদ্ধ অবস্থাতেও ঘনিষ্ঠ একজন সাংবাদিককে কাছে পেয়ে তিনি নিজের কথা না বারবার করে বলছিলেন দেশের ভবিষ্যত আর শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে তার উদ্বেগের কথা! এ কথা বলতে বলতে তিনি তার চেতনা হারান। কথা আর শেষ করতে পারেননি। লন্ডনের হাসপাতালে আব্দুল জলিল তাকে দেখতে যাবার পরও একই উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন নেত্রীর নিরাপত্তার দিকে তোরা খেয়াল রাখিস!
আর সেই নেতাকে নিয়ে লন্ডনের হাসপাতালে পাহারা বসানো হয় যাতে সেখানকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার কাছে না ভেড়ে! সেপ্টেম্বরে লন্ডনে পৌঁছবার সময় হাতে সব টাকা জোগাড় না থাকায় হাইকমিশন গ্যারান্টার হতে রাজি না হওয়ায় হাসপাতাল তার চিকিৎসা শুরু করতেও রাজি হয়নি! আর আমরা এখন কেঁদেকুটে আকাশপাতাল ফাটিয়ে দিচ্ছি! একেকজন এমন করে নাকি কান্না কাঁদছি যে তার সন্তানরাও যেন লজ্জা পাচ্ছেন! ওবায়দুল কবির লিখেছেন, জাতীয় ঈদগাহ’র জানাজায় একজন তার কাছে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলছিলেন ১/১১ সব ধবংস করে দিয়ে গেছে! এর মানে দাঁড়ায় ১/১১ পরবর্তী ভূমিকার কারণে হাইকমান্ডের আক্রোশের শিকার আব্দুর রাজ্জাককে যে এমন বঞ্চনা-অবহেলার শিকার হয়ে মরতে হয়েছে সে ধারণা দলের নেতাকর্মীদের মনের মধ্যেও শক্ত আছে। তা ১/১১ কী আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড অথবা একশ্রেণীর নেতাকর্মীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড় হয়ে গিয়েছিল? এমন ধারণার সৃষ্টি করেছে কে? কারা? মুক্তিযুদ্ধের নেতৃ্ত্বদানকারী সংগঠনের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে অন্য কিছু কী বড় হতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের নেতা আব্দুর রাজ্জাকের কফিনকে ঘিরে মানুষের সমুদ্রের কথা শুনে আওয়ামী লীগের নেতৃ্ত্ব যদি না শুধরায় না বদলায় তাহলে কিন্তু খবর আছে সামনে।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।