একজন রাজনীতিকের জন্যে জনতার ভালোবাসাই যে সবচেয়ে বড় অর্জন, এটিই আবার প্রমান করলেন সদ্য প্রয়াত, মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী শীর্ষ সংগঠক জননেতা আব্দুর রাজ্জাক। মৃত্যুর পর তিনি যেভাবে জনতার ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় অভিসিক্ত হয়েছেন, এই বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের নিজের কর্মকান্ড নিয়ে নতুন করে ভাবার একটি সুযোগ করে দিয়েছে বলে আমার ধারণা।
ভেবে যে, আব্দুর রাজ্জাকের মত একজন জাতীয় নেতার জীবনের শেষ সময়টুকু বিদেশ বিভূঁইয়ে হাসাপাতালের বেডে কেমন কাটছে তা জানার অধিকার থেকেতো আর দেশবাসীকে বঞ্চিত করতে পারি না। একজন রাজনীতিকতো শুধু তাঁর
পরিবারেরই সম্পদ নন, তিনি পাবলিক প্রপার্টিও বটে।
আব্দুর রাজ্জাক লন্ডন কিংস কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে আছেন, বাংলাদেশের জনগণকে এই খবরটি সম্ভবত সর্বপ্রথম দেয় বাংলানিউজ২৪.কম। লন্ডন থেকে পাঠানো
আমার এই খবরটি ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা ৫ মিনিটে বাংলানিউজে আপলোড হয়। খবরটি জানার আগে আমি নিজেও জানতাম না রাজ্জাক ভাই লন্ডনে এসেছেন এবং অসুস্থ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কোন শীর্ষস্থানীয় নেতা লন্ডন এলে সাংবাদিকতা পেশার সুযোগে সাথে সাথেই খবর পাই। কিন্তু রাজ্জাক ভাইরা যেহেতু ‘সংস্কারবাদী’ সেহেতু দলীয় রাডারের ভেতরে তাঁর লন্ডনে আসার খবরের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সর্বপ্রথম খবর পাই যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একজন নেতা লস্কর ভাইয়ের কাছ থেকে। অবশ্য এরপর সাথে সাথেই লন্ডন থেকে প্রচারিত চ্যানেল আই এর একটি স্ক্রলে দেখতে পাই তিনি আইসিইউতে আছেন এবং তাঁর লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। টিভি স্ক্রলে লিভার চেয়ে ডোনারদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। টিভি স্ক্রলটি দেখেই তৎপর হই, খোঁজ খবর নেয়া শুরু করি। পরে জানতে পারি যে টিভিতে লিভার চেয়ে যে আবেদনটি করা হয়েছে তা রাজ্জাক পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। কোন একজন রাজ্জাক ভক্ত এই আবেদনটি করেছেন। এরপরই শুরু হয় রাজ্জাক ভাইকে নিয়ে মিডিয়ার সরবতা।
একই দিন ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে আমার পাঠানো দ্বিতীয় রিপোর্টটি আপলোড হয় বাংলানিউজে ‘রাজ্জাকের চিকিৎসার জন্যে দরকার ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা’ এই শিরোনামে। ঐ রিপোর্টে আমি উল্লেখ করি আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি দলীয় অবহেলার কথা। ‘সংস্কারবাদী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় রাজ্জাকের জীবন-মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণের সময়ও মানবিকতার চেয়ে রাজনীতির হিসেব নিকেশই বেশি করে কষা হচ্ছে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে। ’ এই বাক্যটি ছিল আমার ওই রিপোর্টের একটি অংশ। রিপোর্টে বলেছিলাম ‘রাজনীতিতে
সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই শীর্ষ সংগঠকের সারা জীবনের অর্জন যেন আজ নিঃশেষ হয়ে গেছে। দলীয় হাইকমান্ডের আশির্বাদ-বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় বঙ্গবন্ধুর এই ঘনিষ্ঠ শীর্ষ সহযোগীর এই চরম দুঃসময়েও কেউ কাছে ভিড়তে সাহস পাচ্ছেন না। ’ এই দ্বিতীয় রিপোর্টটি বাংলানিউজে আপলোড হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারী তাঁর তৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলানিউজেই লিখেন একটি কলাম। তিনি আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি সরকার ও দলের অবহেলার কঠোর সমালোচনা করেন তার লেখায়। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা আমাকে ফোন করে বললেন, এভাবে রিপোর্টটি না করলেও চলতো। তিনি জানালেন রাজ্জাক ভাইয়ের পরিবারও চাচ্ছেন না এই মুহূর্তে আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি সরকার ও দলের দায়িত্ব পালন নিয়ে কোনও বিতর্ক সৃষ্টি হোক। আরেকজন শীর্ষ নেতা বললেন, ‘আমরা সব সময়ই তাঁর খোঁজ খবর রাখছি। হাসপাতালে ভীড় করা রোগীর জন্য ক্ষতিকর, এইজন্য কাউকে হাসপাতালে যেতে উৎসাহিত করছি না’।
রাজ্জাক ভাইয়ের অত্যন্ত কাছের মানুষ, লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক প্রেস মিনিস্টার প্রবীণ সাংবাদিক আবু মুসা হাসান ফোন করে বললেন, ‘এই মুহূর্তে রাজ্জাক ভাইয়ের আশু চিকিৎসার ব্যয়ভার সংগ্রহই আসল কাজ। এমন কোন বিতর্ক সৃষ্টি করা উচিত নয়, যাতে এটি ব্যহত হয়। বাংলানিউজে ফজলুল বারী ভাইয়ের কড়া প্রতিক্রিয়াপূর্ণ লেখাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় লন্ডনে আমাদের কমিউনিটিতে। হাসান ভাইয়ের পরামর্শে যুক্তি আছে, মেনে নিয়ে ফেইসবুকে মেসেজ দিলাম বারী ভাইকে। বললাম এই মূহুর্তে রাজ্জাক ভাইয়ের চিকিৎসাব্যয় সংগ্রহের জরুরি আবশ্যকতার কথা। আমাদের রিপোর্টিং বা লেখালেখির জন্যে এটি যেন বাধাগ্রস্ত না হয় এই অনুরোধও করলাম। উত্তরে বারী ভাই একমত হলেন আমার সাথে, কিন্তু প্রশ্ন রাখলেন চিকিৎসা ব্যয়ের এত বড় অংক সংগ্রহের উপায় কি? উপায় তো আমারও জানা নেই, কি উত্তর দেবো বারী ভাইকে? আজ পর্যন্ত সেই উত্তর আমার আর দেওয়া হয়নি। রাজ্জাক ভাইয়ের অবস্থা নিয়ে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে থাকি। ভাবীকে মাঝে মধ্যে ফোন করি, ফোন করি রাজ্জাক ভাইয়ের শ্যালক ফুয়াদ লতিফকে। জানতে চাই অর্থ সংগ্রহের বিষয়ে। তাদের মাধ্যমেই জানি ব্যবস্থা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এবিষয়ে তৎপর রয়েছেন, রাজ্জাক ভাইয়ের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সহকর্মী তোফায়েল আহমদ, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুসহ অনেকেই চেষ্টা করছেন। নিজ সহায় সম্পত্তি যা আছে তা ব্যাংকে রেখেও টাকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। এও জানি যে লিভারদাতা পাওয়া গেছে তাঁর শারিরীক পরীক্ষা নীরিক্ষাও চলছে। এরই মধ্যে সাংবাদিক আবু মুসা হাসানকে নিয়ে একদিন দেখতে যাই রাজ্জাক ভাইকে। কিন্তু তাঁকে দেখেই আঁতকে উঠি। হাসপাতালের কেবিনে ঘুমিয়ে আছেন রাজ্জাক ভাই। শুধুমাত্র তাঁর মাথাটিই দেখা যাচ্ছে। বেডে যে আর কোন মনুষ্যশরীর আছে তা বোঝাই যায় না। থমকে যাই আমি, বুঝে নেই রাজ্জাক ভাইয়ের সময় শেষ হয়ে এসেছে। কারণ আজ থেকে চার বছর আগে একই রকমের রোগে আমার চাচী লন্ডনে মারা গিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৩/৪ মাস হাসপাতালে থাকার পর তিনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, তখন হাসপাতালের বেডে তাঁর শরীর বলতে তেমন কিছুই ছিল না। রাজ্জাক ভাইকে দেখে চাচীর কথা মনে হলো। কিন্তু লিভার, কিডনি সবকিছু তৈরি, প্রতিস্থাপন হবে এমন আশা নিয়ে আব্দুর রাজ্জাকের পরিবার যেখানে বসে আছেন, সেখানে আমি আমার এই আশঙ্কার কথা বলি কিভাবে? হাসান ভাই ও আমি রাজ্জাক ভাইয়ের মৃত্যুপরবর্তী দৃশ্য কল্পনা করতে করতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। আশা ছিল রাজ্জাক ভাইয়ের সাথে কিছু কথা বলবো, তাঁর একটি ছবি নিয়ে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্যে একটি আশা জাগানিয়া রিপোর্ট করবো, তার আর কিছুই হলো না। এটিই জীবিত রাজ্জাক ভাইকে আমার শেষ দেখা। এমন অবস্থায়ই ১১ ডিসেম্বর আব্দুর রাজ্জাকের অপারেশনের তারিখ ঠিক হয়। কিন্তু রাজ্জাক ভাইকে সর্বশেষ দেখার পর আমি যেন কোনভাবেই হিসেব মিলাতে পারছিলাম না, কেমন করে জনতার মাঝে আবার ফিরে আসবেন কিংবদন্তির জনপ্রিয় নেতা আব্দুর রাজ্জাক। আমার হিসেব না মিললেও পরিবার সদস্যদের সাথে রাজ্জাক ভাই নিজেও ভেবেছিলেন জনতার ভালোবাসার বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তা হয়তো আবার তাকে ফিরে যেতে দেবেন তাঁর জনগণের মাঝে। মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে নাইম রাজ্জাক তার বাবার এই আশাবাদের কথাই জানিয়েছেন সাংবাদিকদের। লিভারের সাথে কিডনিও একটি বদলাতে হবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ডাক্তাররা যখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তখনই আবার অনিশ্চিত হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মুক্তিযুদ্ধের এই শীর্ষ সংগঠকের লিভার ও কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার। কিডনিদাতার হৃৎপিেণ্ড
হঠাৎ করে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় অস্ত্রোপচার স্থগিত করা হয়। কিন্তু নতুন কিডনি ডোনার পেয়ে তাকে লন্ডন নিয়ে আসার সামগ্রিক আনুষ্ঠানিকতা পুরোদমে চললেও ততক্ষনে বেঁচে উঠার আশা হয়তো ছেড়ে দিয়েছিলেন রাজ্জাক ভাই। আর তাইতো দ্রুত তিনি ধাবিত হতে থাকেন মৃত্যুর দেশের দিকে। ১৮ ডিসেম্বর থেকে রাজ্জাক ভাইয়ের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিষ্টার রাশেদ চৌধুরী ও সাবেক কাউন্সিলার শাহাব উদ্দিন বেলালের কাছ থেকে খবরটি শুনেই ফোন করি আব্দুর রাজ্জাকের শ্যালক ফুয়াদ লতিফকে। তিনি জানালেন লাইফ সাপোর্ট মেশিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জননেতা আব্দুর রাজ্জাককে। টেলিফোন করলাম বাংলানিউজের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেননকে। জানালাম রাজ্জাক ভাইয়ের সর্বশেষ অবস্থা। তিনি বললেন তাড়াতাড়ি পাঠান রিপোর্ট। রিপোর্ট করলাম ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আব্দুর রাজ্জাক’। বলতে দ্বিধা নেই এই রিপোর্টের পর থেকেই শঙ্কিত অপেক্ষায় ছিলাম, কখন শোনতে হবে সেই শুনতে না চাওয়ার খবরটি। ক্রিসমাসের প্রারম্ভে পারিবারিক প্রয়োজনে নিয়ে ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল থেকেই ব্যস্থ ছিলাম। লন্ডন সময় দুপুর পরযন্ত রাজ্জাক ভাইয়ের খোঁজ নিতে পারিনি। ড্রাইভিং এ থাকা অবস্থায় হঠাৎ করে মাহমুদ মেনন ভাইয়ের ফোন, ‘রাজ্জাক ভাই নাকি মারা গেছেন?’ থমকে গেলাম কিছুক্ষণের জন্যে। জানালাম খবরটি আমার না জানার কথা। বললাম কিছুক্ষণের মধ্যেই জানাচ্ছি। ফরিদা ভাবীর ফোনে ডায়াল করবো, এমন সময় প্রেস মিনিস্টার রাশেদ চৌধুরীর ফোন, ‘রাজ্জাক ভাইয়ের অবস্থা খারাপ, কিছুক্ষণের মধ্যে লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলবে’। রাশেদ ভাই জানালেন তিনি এক্ষুনি রওয়ানা হচ্ছেন হাসপাতালের দিকে। মেনন ভাইকে ফোন করে জানালাম, না রাজ্জাক ভাই এখনও আমাদের ছেড়ে যাননি। তবে কোনও আশা নেই। সাথে সাথে আমিও রওয়ানা হলাম কিংস কলেজ অভিমুখে। ট্রেনে বসে মোবাইল ইন্টারনেটে বাংলানিউজ অপেন করতেই দেখি শীর্ষ নিউজ ‘আব্দুর রাজ্জাক আর নেই’। বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। মেনন ভাইকে ফোন করে বললাম ‘রাজ্জাক ভাই এখনও বেঁচে আছেন, এরপরও মৃত্যু সংবাদ দিয়ে নিউজ আপলোড করে ফেললেন?’ জানতে চাইলাম এটি কেমন করে হয়? জানালেন বাংলাদেশের সব মিডিয়া ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে আব্দুর রাজ্জাক মারা গেছেন। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর শোকবাণীও চলে এসেছে। তিনি বললেন, আপনি হাসপাতালে গিয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানান। দুপুর দেড়টায় কিংস কলেজ হাসপাতালে পৌছে দেখি ইতোমধ্যে হাইকমিশনার ড: সাইদুর রহমান খানসহ অনেকে এসে গেছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাজ্জাক ভাইয়ের বড় ছেলে নাইম রাজ্জাক এসে জানালেন, লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন ডাক্তাররা। ঘটনার পুরো বর্ণণা দিতে গিয়ে তিনি বললেন, কোন ঔষধই রেসপন্স করছে না আব্দুর রাজ্জাকের দেহে। এমন অবস্থায় তাকে লাইফ সাপোর্টে রেখে আর কষ্ট দিয়ে কোন লাভ নেই। পরিবারের পরামর্শ চাইলেন ডাক্তাররা। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হলো একজন মৌলভী নিয়ে এসে দোয়া দুরুদ করানো পর্যন্ত সময় নিতে চান তারা।
হাইকমিশনার ড. সাইদুর রহমান খান, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি সুলতান শরীফ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফারুক, যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীসহ মিডিয়াকর্মী ও বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাঙালি ইতোমধ্যে এসে ভীড় জমিয়েছেন হাসপাতালে। আমরা রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায়- কখন শুনতে হবে সেই না শুনতে চাওয়া মর্মস্পর্শী খবরটি। আওয়ামী লীগের একজন কর্মী এসে আমাকে বললেন, লন্ডনে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জেনেছেন আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর। সত্যি মিথ্যা জানতে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। সত্যি হলে তিনি আসবেন হাসপাতালে। অবাক হয়ে গেলাম তাঁর কথা শুনে। মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হলেই কেবল সৈয়দ আশরাফ আসবেন হাসপাতালে? আব্দুর রাজ্জাকদের শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নামের যে রাজনৈতিক বটবৃক্ষ আজ দাঁড়িয়ে আছে, যে দল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে করেছে স্বাধীন- সেই দলের সাধারণ সম্পাদক এমন বলতে পারেন!
এরই মধ্যে মৃত্যুর আগেই আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রচার হওয়ায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন। হাইকমিশনারও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন মিডিয়ার এই দায়িত্বহীনতা নজিরবিহীন। হাইকমিশনারকে পাশে রেখেই ফোন করলাম মাহমুদ মেননকে। বললাম রাজ্জাক ভাইতো এখনও আছেন। হি ইজ স্টিল অ্যালাইভ। তিনি বললেন সব মিডিয়া মৃত্যুর খবর প্রচার করছে, পরামর্শ চাইলেন কি করবেন এখন? বললাম যা সত্যি তাই রিপোর্ট করুন আবার। রাশেদ ভাইয়ের সাথেও কথা বললেন মেনন মাহমুদ। এর ৫ মিনিট পরই বাংলানিউজে খবর আসে ‘হি ইজ স্টিল এলাইভ-আব্দুর রাজ্জাকের চিকিৎসক’-এই শিরোনামে। সাথে প্রধানমন্ত্রীর সাথে হাইকমিশনারের যোগাযোগের টেলিফোন ডায়ালিংয়ের দৃশ্যসহ ছবি। বাংলানিউজে এই নিউজটি আপলোড করার বেশ আগেই অবশ্য আব্দুর রাজ্জাকের দেহ থেকে লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হয়। কিন্তু তখনও তিনি বেঁচে আছেন। অবশেষে শেষ হলো দীর্ঘ প্রতীক্ষার পালা। লন্ডন সময় ৩.৫৩ মিনিটে আমার পাশেই দাঁড়ানো হাইকমিশনার সাহেবকে ডাক্তার এসে পৌঁছে দিলেন রাজ্জাক ভাইয়ের শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের খবরটি। আমরা সবাই এক সাথে বলে উঠলাম (ইন্না—রাজিউন)। সাথে সাথেই হাইকমিশনার আনুষ্ঠানিকভাবে মিডিয়া কর্মীদের কাছে ঘোষণা করলেন মুক্তিযুদ্ধের শীর্ষ সংগঠক আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর। সবার আগে আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যু খবর প্রচারের মিডিয়ার
সেই নির্লজ্জ প্রতিযোগিতারও হলো অবসান।
বাংলানিউজে এবার রিপোর্ট হলো ‘অবশেষে মৃত্যুর দেশেই পাড়ি জমালেন আব্দুর রাজ্জাক’। রাজ্জাক ভাইয়ের মৃত্যুর পর দেখতে হলো আরেক নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। চিকিৎসাকালীন তিন মাসে ‘সংস্কারবাদী’ হওয়ার অপরাধে যে আব্দুর রাজ্জাকের কাছাকাছি আসতে সাহস করেননি কেউ, তাদেরই অনেকে এবার প্রতিযোগিতা শুরু করলেন সদ্য প্রয়াত এই নেতার মৃত্যুকে পুঁজি করে কিভাবে মিডিয়াকে আকৃষ্ট করা যায়। পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন মসজিদে প্রথম নামাজে জানাজায়ও দেখা যায় সেই একই দৃশ্য। টিভি ক্যামেরায় চেহারা দেখানোর নজিরবিহীন প্রতিযোগিতা, শোক বিহবল হওয়ার নিখুঁত অভিনয়, এমনকি আব্দুর রাজ্জাকের সবচেয়ে কাছের মানুষ সাজার নির্লজ্জ চেষ্টাও এসময় দেখতে হয় কমিউনিটিকে। জানাজার পর এই নজিরবিহীন প্রতিযোগিতায় ক্ষুব্ধ কমিউনিটির কয়েকজনতো এক পর্যায়ে হট্রগোলও শুরু করেন। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আব্দুর রাজ্জাকের চিকিৎসাকালীন তিন মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে রুগ্ন চেহারা চোখের সামনে প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হলেও বাংলানিউজে প্রকাশিত রিপোর্টগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া এই শঙ্কাকে কিন্তু গাঢ় হতে দেয়নি। আব্দুর রাজ্জাকের জন্যে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ উৎকন্ঠা, দলীয় অবহেলার বিরুদ্ধে ক্ষোভ মিশ্রিত মন্তব্য ছিল অনেক আশা জাগানিয়া। তবে মুক্তিযুদ্ধের এই শীর্ষ সংগঠকের মৃত্যুর পর লন্ডনে ও মিডিয়ার বদৌলতে ঢাকায় তাঁর শেষ যাত্রায় সাধারণ মানুষের যে ঢল দেখেছি, শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় রাজ্জাককে অভিষিক্ত করার যে হৃদয় নিংড়ানো চেষ্টা দেখেছি মানুষের মধ্যে, তাতে রাজ্জাক পরিবারকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছি যে, বাঙালির ক্ষণজন্মা পুরুষদের একজন আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি দলীয় ও সরকারী সব অবহেলা জনতার ভালবাসার সুনামিতে ভেসে গেছে। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনতার যে ঢল নেমেছিল আব্দুর রাজ্জাকের শেষ যাত্রায় এই ঢল যেন বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সবধরনের সংকীর্ণতা, হীনমন্যতা ও রুগ্নতা সুনামির মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায়, এটিই যেন হয় আমাদের সবার কামনা।
মৃত্যুর আগেই আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যু খবর নিয়ে মিডিয়ার প্রতিযোগিতা সম্পর্কে বাংলানিউজের হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন ইতোমধ্যে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নিজ মিডিয়া হাউস হলেও বাংলানিউজের একটি বিষয় প্রশংসা না করে পারছি না। তাহলো অকপটে ভুল স্বীকার করা। আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যু খবর নিয়ে মিডিয়া কেলেঙ্কারির বিষয়টির দায় স্বীকার করে মেনন মাহমুদ সাংবাদিকতা পেশাটিকেই সম্মানিত করলেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১১