ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

তুমি বাংলাদেশি বলেই জিজ্ঞেস করছি

শাখাওয়াৎ নয়ন, সিডনি থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১১
তুমি বাংলাদেশি বলেই জিজ্ঞেস করছি

কয়েকদিন আগে সিডনির এক ক্রিসমাস পার্টিতে রয়টারের একজন সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন সম্পর্কে তোমার ধারণা কেমন?’

‘কিছু ধারণা আছে। কিন্তু কেন?’

‘তুমি যেহেতু বাংলাদেশি তাই জিজ্ঞেস করছি।



আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। সাধারণত এ ধরনের আলোচনায় কোনো বিদেশির সাথে অংশগ্রহণ করতে আমার ভালো লাগে না। কারণ তাদের একটা মাইন্ড সেট থাকে। একটা প‍ূর্ব-ধারণা নিয়েই আলোচনা শুরু করে এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে যত নেতিবাচক কথা আছে, তা বলে। যুক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করলেও নানা রকম তথ্য দিয়ে যুক্তি খন্ডন করে। আমার গা জ্বলতে থাকে। নিজের দেশ সম্পর্কে কেউ খারাপ বললে ভালো লাগে? একদম ভালো লাগে না। মনে মনে তার দেশের খারাপ দিকগুলি খুঁজতে থাকি। উচ্চ শব্দে বলার চেষ্টা করি, সমস্যা নাই কোথায়? তোমার দেশেও আছে। বিশ-ত্রিশ বছর আগে চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের অবস্থা এমন ভালো কিছু ছিল না। অপেক্ষা করো। একদিন আমরাও ...।

আবার পরক্ষণেই ভাবতে থাকি, এই বিদেশি সাংবাদিকেরই দোষ কি? আমাদের দেশের এক শ্রেণির লোকই তো এদের কাছে নানা রকম উপাত্ত, অর্ধ-সত্য, মিথ্যা, ডাহা-মিথ্যা তুলে দেয়। বিরোধীদলগুলো ফলাও করে ঘোষণা দেয়, দাতাগোষ্ঠী, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য দেশের কাছে সরকারকে ভাবমূর্তি সংকটে ফেলতে হবে। কখনও ওমরাহ, কখনও চিকিৎসা, কখনও পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎসহ নানারকম ছুতোনাতা দেখিয়ে, দফায় দফায় বিদেশ সফর করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে আসে। বাংলাদেশে কোনো দেশের সরকারপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রদূত এলেও বিরোধীদল তাদের কাছে নালিশ করতে যারপরনাই তৎপরতা চালায়। এইসব রাজনীতিকরা গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়েই ওই বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে যায়। এরা দেশ গেল বলে হাঁক দেয়! সার্বভৌমত্ব রক্ষার ডাক দেয়! কী অদ্ভূত দেশপ্রেম! কী নির্লজ্জ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড! যে কোনো সরকার ক্ষমতায় বসার এক বছরের মাথায় একই কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। দলের কলামিস্ট অঙ্গসংগঠনটি (বুদ্ধিজীবীমহল) খাস চামচার মতো তার পক্ষে লেখালেখি শুরু করে দেয়।

স্বাধীনতার পর থেকেই এই নিরলস প্রচেষ্টা চলছে। সেই লেখালেখিই এসব বিদেশি সাংবাদিকদের পুঁজি। সরকার যাতে কোনো সাহায্য না পায়, বড় ধরনের কোনো উন্নয়নমূলক কাজ যাতে করতে না পারে। সেই জন্য আজকাল আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ভারতের বড় বড় পত্রিকায় টাকা খরচ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক নিবন্ধ, প্রবন্ধ লেখানো হয়। সরকারের ভাবমূর্তির নামে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার কী আধুনিক ব্যবস্থা!

সাংবাদিক বন্ধুটি আমার নীরবতাকে অনুবাদ করার চেষ্টা করছে। অথবা মাইন্ড রিড করছে। যা-ই করুক, আমার দেশ সম্পর্কে খারাপ কিছু বললে যে আমার ভালো লাগবে না, তা বুঝতে পারলেই হলো। এবার একটু হেসে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাংলাদেশ কি উন্নয়নে নতুন যুগে প্রবেশ করছে?’

‘তোমার কি তাই মনে হচ্ছে?’ উল্টো প্রশ্ন করলাম। একটু মারমুখী মনোভাবেই ছিলাম।

‘এখনও পুরোপুরি মনে হচ্ছে না। বাট দেয়ার ইজ এ সাইন ... হুম ... লাইট ইন দ্য টানেল। ’

‘কি দেখে তোমার তা মনে হলো?’

‘বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় তোমাদের দেশের ওপর একটা ডকুমেন্টারি দেখেছি। সম্ভবত‍ আইসিসি করেছে। চমৎকার! ওটা তোমাদের দেশকে পৃথিবীর কাছে নতুন করে পরিচিত করতে সাহায্য করেছে। এ ছাড়া ...। ’

‘এ ছাড়া কি?’

‘সম্প্রতি টাইমসে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ক্রোড়পত্র প্রচার হয়েছে। সেটা একটা পজিটিভ ইমেজ তৈরি করবে। ’

‘তাই নাকি?’

‘হুম। বন্যা, দ‍ুর্নীতি, রাজনৈতিক সহিংসতা ছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তোমাদের দেশ সম্পর্কে তেমন কোনো খবর দেখা যায় না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট এবং সুন্দরবন নিয়ে অনলাইনে তোমাদের দেশ সম্পর্কে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য এসেছে। ’

আমি এবার আরেকটু জোর দিয়ে বললাম- ‘তাই নাকি?’

‘হুম। ইন্টারনেটে তোমাদের ট্যুরিজম সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বেশিরভাগই বেসরকারি
উদ্যোগ। আগে তো এসব ছিল না। তুমি কি জানো, পৃথিবীতে ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি আইটির চেয়ে কয়েকগুণ বড়?’

‘না। জানতাম না। ধন্যবাদ। আমার দেশ সম্পর্কে তোমার আর কি মনে হয়?’

‘গত এক দশকে তোমরা নোবেল পেয়েছো, মাথাপিছু আয় বেড়েছে হু হু করে; রেমিট্যান্স বেড়েছে; সামাজিক উন্নয়ন সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে তোমাদের। ’

‘কী রকম?

‘দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকার পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। ’

‘হুম। তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু আমাদের একটা বিশাল পরিমাণ রেমিট্যান্স চলে যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের পিছনে। এরই মধ্যে একটা কোম্পানি ইলেকট্রনিক সামগ্রী বানাচ্ছে, সরকারি উদ্যোগে কম্পিউটার তৈরি হচ্ছে, শিগগিরই বাংলাদেশ গাড়ি উৎপাদন করবে। আশা করছি, বড় বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলবে। বিরাট বাজার। সস্তা শ্রম। ’

‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে তোমাদের কাউকে ডাকতে হবে না। ’

কেমন জানি একটা ভালোলাগায় মনটা ভরে উঠলো। একটু পরে আমার সাংবাদিক বন্ধু বিদায় নিলেন। এই প্রথম কোনো বিদেশির মুখে বিদেশে বসে বাংলাদেশের সম্পর্কে দু’একটা ভালো কথা শুনলাম। বাংলাদেশে গিয়ে যেসব বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে, সেমিনারে কথা বলে, তা সাধারণত মুখরক্ষা টাইপের হয়। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে কথা বলে। এই লোকের ক্ষেত্রে অন্তত‍ঃ সেই সম্ভাবনা নেই।

কিন্তু কয়েকদিন আগে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমসহ কয়েকটি পত্রিকায় কতিপয় কলামিস্টের লেখা পড়ে বিস্মিত হয়েছি। তারা প্রাণান্ত চেষ্টায় বলতে, লিখতে এবং বোঝাতে চেয়েছেন, বাংলাদেশে ভালো কিছু হচ্ছে না। টাইমসে ক্রোড়পত্র প্রচার করে নাকি বিজ্ঞাপনের নামে টাকাগুলো পানিতে ফেলা হয়েছে। কানাডাপ্রবাসী একজন তো বলেছেন, প্রবাসীদের দিয়েই নাকি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এর চেয়ে অনেক বেশি উজ্জল করা যেত (!)। অ্যাডিলেইড থেকে একজন পয়েন্ট মুখস্থ করে গরু রচনা লেখার মতো করে রচনা বিরচন করেছেন। যে যেখান থেকে যা-ই লিখুন, সামগ্রিকভাবে একবার চিন্তা করে দেখুন। আপনার লেখাটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লিখেছেন কিনা? আপনারা যদি সৎ উদ্দেশ্যে লিখে থাকেন, তাহলে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রিটেন, আমেরিকার বড় বড় পত্রিকায় সরকারের চেয়ে ভালোভাবে লিখে দেশের মানুষকে দেখান। দেশবিরোধী প্রচারণায় শামিল হচ্ছেন কেন?

সরকার কিংবা বিরোধীদলের সব কিছুই খারাপ হতে পারে না। সব বিষয়েই বিরোধিতা করা শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। ‘সরকারবিরোধী কলাম লিখতে পারলেই বুদ্ধিজীবী হওয়া যায়’ গত দেড় দশকে এই ধারাটি চালু হয়েছে। এদেরকে গণমাধ্যমগুলো লালন করছে অথবা উসকে দিচ্ছে। সরকারের ‘অ্যাকমপ্লিশমেন্ট বিয়ন্ড এক্সপেক্টশন’ ক্রোড়পত্রটির ক্ষেত্রে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একমাত্র ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন পজিটিভ মনোভাবে লিখেছেন। ড. মিল্টনের কিছু কিছু লেখার সাথে আমি কষ্ট করেও একমত
হতে পারি না। কিন্তু এই লেখাটির জন্য তাকে ধন্যবাদ।

ই-মেইল: somalochona@yahoo.com.au

লেখক সিডনিপ্রবাসী

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।