সোমবার বাংলানিউজে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শীর্ষ সংগঠক ও আওয়ামী লীগ উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের লন্ডনে হাসপাতালের বেডে জীবনের শেষ তিনটি মাস নিয়ে ‘ভালোবাসার সুনামিতে ভেসে গেছে অবহেলা’ শীর্ষক একটি ফিচার লিখেছিলাম। ফিচারটি প্রচারের পর ফেসবুকের মেসেজ বক্স, টেলিফোন ও অন্যান্য মাধ্যমে এতো প্রতিক্রিয়া পেয়েছি যে, সাংবাদিকতা জীবনে এটি আমার জন্যে একটি বিরাট অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক ‘মানবজমিন’ও বাংলানিউজের সৌজন্যে প্রাপ্ত ফিচারটি তাদের এক্সক্লুসিভ পেইজে প্রচার করে। মানবজমিনে প্রকাশের খবরটিও আমাকে একজন পাঠক ফোন করে জানিয়েছেন। লেখাটির প্রতিক্রিয়া নিতে গিয়ে আরও অনেক বিষয় জানতে পারি, যা বিগত তিন মাস রাজ্জাক ভাইয়ের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট করার সময় ছিল আমার অজানা।
প্রয়াত জননেতা আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর পর জাতির ভালোবাসার যে সুনামি আমরা দেখেছি এর বিপরীতে আব্দুর রাজ্জাকের রাজনৈতিক দর্শনের চরম শত্রু, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির মনুষ্য নামধারী কিছু নিকৃষ্ট জীবের মৃত্যুপথযাত্রী রাজ্জাক ভাইয়ের পরিবারকে মানসিক যন্ত্রণা দেয়ার অপচেষ্টাও যে ছিল, এটি গতকাল পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি।
একজন সাংবাদিক হিসেবে সব তথ্য জানতে না পারার এই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করছি আমি বাংলানিউজের পাঠকদের কাছে। এজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আব্দুর রাজ্জাকের বিধবা স্ত্রী ফারিদা রাজ্জাক এখন আর লন্ডনে নেই। এই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার কোন সুযোগও নেই আমার।
কিন্তু বাঙালির বীর মুক্তিসেনা আব্দুর রাজ্জাকের জীবনের সর্বশেষ সময়ে তাঁর প্রতি অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির যথাযথ দায়িত্ব পালনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা মূখর হবো, আর মৃত্যুর দুয়ারে উপস্থিত একজন জাতীয় নেতাকে মৌলবাদীদের করা মানসিক টর্চারের প্রতিবাদ করবো না, তাতো হয় না।
২৯ সেপ্টেম্বর চ্যানেল আই এর স্ক্রলে আব্দুর রাজ্জাকের জন্যে লিভার চেয়ে আবেদনের বিষয়টি সোমবারের লেখায় উল্লেখ করেছিলাম। বলেছিলাম, এই স্ক্রলটি রাজ্জাক ভাইয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। লেখাটি প্রচার হওয়ার পর যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একজন নেতা আব্দুল ওয়াদুদ মুকুল টেলিফোন করে এ বিষয়টি সম্পর্কে দিলেন বিস্তারিত তথ্য। তিনিই প্রথম জানালেন মৃত্যুশয্যায়ও আব্দুর রাজ্জাককে মৌলবাদীদের মানসিক টর্চার সহ্য করতে হয়েছে ।
মুকুল বললেন, ২৫ সেপ্টেম্বর লন্ডন ব্রিজ হাসপাতালের ডাক্তাররা যখন বললেন, লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া আব্দুর রাজ্জাককে বাঁচানো যাবে না, তখন অনেকটা ভেঙ্গে পড়েন রাজ্জাক ভাইয়ের স্ত্রী ফরিদা রাজ্জাক। বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কি করবেন।
লন্ডনের কেমব্রিজের একটি হাসপাতালে কর্মরত কার্ডিয়াক সার্জন, বঙ্গবন্ধু সরকারের সাবেক মন্ত্রী সোহরাব হোসেনের ছেলে ডাক্তার রকিব আনোয়ার অরুণ, খুবই ঘনিষ্ট আব্দুর রাজ্জাকের পরিবারের সঙ্গে। রাজ্জাক ভাইয়ের জীবনের সর্বশেষ তিন মাসের হাসপাতাল জীবনের সবকিছু কো-অর্ডিনেট করেছেন তিনি। চিকিৎসাকালীন তিন মাস অরুণ ছিলেন সব সময় রাজ্জাক ভাইয়ের কাছাকাছি।
ফরিদা ভাবির মানসিক অবস্থা দেখে ডা. অরুণসহ অন্যরা সিদ্ধান্ত নিলেন, লিভার চেয়ে টেলিভিশনে আবেদন জানানো হবে। এ সময় হাসপাতালে অন্যান্যের মধ্যে সাবেক আওয়ামী লীগ সাংসদ ও জাতীয় নেতা মনসুর আলীর ছেলে ড. সেলিম, বঙ্গবন্ধু পরিষদের
ডা. ফয়জুল ইসলাম, আব্দুল ওয়াদুদ মুকুলসহ আরও কয়েকজন রাজ্জাকভক্ত উপস্থিত ছিলেন। টেলিভিশন স্ক্রলে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ফরিদা রাজ্জাকের ফোন নং ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়।
স্ক্রলে ফরিদা ভাবির ফোন নং যাওয়ার পরই শুরু হয় মৌলবাদীদের মানসিক টর্চারের তাণ্ডব। ফরিদা
রাজ্জাককে ফোন করে মৌলবাদীরা অকথ্য ভাষায় কথাবার্তা বলতে থাকে।
‘এখন লিভারের প্রয়োজন, হাসিনা, রেহানা লিভার দেয় না
কেন’, ‘তোফায়েলকে বল লিভার দিতে’, ‘ফিরিসতার মত আলেম গোলাম আযমের বিচার করে গণআদালতে, এর শাস্তি বুঝুক এবার’, ‘দেড় কোটি টাকা এখনই ক্যাশ দিলে লিভার দেবো’ আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রীর নাম্বারে
ফোন করে এইভাবেই অমানবিক মন্তব্য করতে থাকে মৌলবাদী পাষণ্ডরা।
বাধ্য হয়ে ফরিদা রাজ্জাক স্ক্রল থেকে তাঁর ফোন নং উঠিয়ে নিতে বলেন এবং এর স্থলে আওয়ামী লীগের আব্দুল ওয়াদুদ মুকুলের ফোন নং বসানো হয়। কিন্তু মৌলবাদীদের টেলিফোন সন্ত্রাসে লন্ডন সময় রাত ১.৩০
মিনিটে পুরো স্ক্রলটিই সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হন স্ক্রলদাতারা।
মুকুলের দেওয়া এই তথ্যটি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ফোন করেছিলাম সিলেট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আওয়ামী লীগের অ্যাকটিভিস্ট লস্কর ভাইকে। রাজ্জাক ভাইয়ের জীবনের শেষ তিন মাস তিনিও ছিলেন প্রয়াত নেতার খুব কাছাকাছি।
মৌলবাদীদের টেলিফোন টর্চারের কথা তিনিও স্বীকার করলেন, বললেন এগুলো প্রচার করে ভীতি সঞ্চার না করতে রাজ্জাক ভাইয়ের স্ত্রীই নাকি অনুরোধ করেছিলেন। আরেক জন কর্মী, যিনি জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত,শামিম লোদি, রাজ্জাক ভাইয়ের শেষ সময়ে তিনিও ছিলেন তাঁর পরিবারের কাছাকাছি। শামিমও জানালেন ঘটনা সত্যি।
ঘটনাটি সত্যি হবে এটি বুঝতে পারলাম রাজ্জাক ভাইয়ের মৃত্যুর দুই দিন আগের আরেকটি ঘটনা স্মরণ করতে গিয়ে। শুক্রবার শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন রাজ্জাক ভাই। এর আগে বুধবার লন্ডনে প্রজন্ম-৭১ এর একটি কনভেনশন ছিলো। ডেপুটি স্পিকার কর্ণেল(অব.) শওকত আলী ছিলেন এতে প্রধান অতিথি।
ওই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আব্দুর রাজ্জাক। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে গণ-আদালতে ৭১ এর ঘাতককূল শিরোমণি গোলাম আযমের ফাঁসির রায় হয়েছিলো, সেই আদালতের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। সুতরাং, আজ যখন আইনের আদালতে ওই
ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তেমনি মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি শীর্ষ সংগঠক তো এটি না দেখে চলে যেতে পারেন না। ’
বক্তৃতায় প্রার্থনা করেছিলাম, অন্তত যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির রায় দেখে যাওয়ার মত আয়ু যেন সৃষ্টিকর্তা আব্দুর রাজ্জাককে দেন।
বলেছিলাম, ‘রাজ্জাক ভাই, বাংলাদেশের মাটিতে আইনের আদালতে ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির রায় হবে, তা কার্যকর হবে, অথচ আপনি দেখে যাবেন না, এটি হয় না। আপনাকে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেই হবে’।
রাজ্জাক ভাইয়ের মৃত্যুর পর নাম্বারবিহীন একটি টেলিফোন থেকে আমাকে ফোন করে বলা হলো, ‘বুধবারের বক্তৃতায় করা তোমার প্রার্থনা তো আল্লাহ শুনলেন না, রাজ্জাকও শুনলো না। আল্লার পেয়ারা বান্দাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া থেকে এখনও বিরত হও’।
মনে করলাম, ফোনটি আমাদের মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কিছু সাংবাদিকের প্রতি মৌলবাদীদের নিয়মিত টেলিফোন টর্চারের একটি অংশ। খুব গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু ফরিদা রাজ্জাকের প্রতি মৌলবাদীদের এই টেলিফোন টর্চারের খবর পাওয়ার পর
বুঝলাম, মৌলবাদী পাষণ্ডরা অপেক্ষায়ই ছিল, কখন আব্দুর রাজ্জাকের মতো মৌলবাদ বিরোধী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিভে যাবে চিরতরে।
তারা ভেবেছিলো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বাঙালির নতুন প্রজন্মের শিরায় শিরায় যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উস্কে দিয়েছিলেন আব্দুর রাজ্জাক, তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গও হয়তো নিভে যাবে। কিন্তু তারা জানে না, মুক্তিযুদ্ধের চল্লিশ বছর কেন, চারশ’ বছর পরও এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিভে যাওয়ার নয়।
‘ভালোবাসার সুনামিতে ভেসে গেছে অবহেলা’ শীর্ষক লেখাটি প্রচার হওয়ার পর প্রচুর প্রশংসার পাশাপাশি কিছু তথ্য ঘাটতির কথাও বলতে চেয়েছেন একজন পাঠক।
সাবেক কাউন্সিলার শাহাব উদ্দিন আহমদ বেলাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের হাসপাতালে যাওয়ার অপেক্ষা সর্ম্পকিত তথ্য সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হলেই আশরাফুল ইসলাম হাসপাতালে যাবেন, এই তথ্যটি ঠিক নয়। আমি বেলাল ভাইকে বলেছি, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হাসপাতালে যাওয়ার পর আমাকে এই কথাটি বলেছেন। বিষয়টি যদি সত্যি হয়, তাহলে অবশ্যই এটি একটি নিন্দনীয় বিষয়। একজন কর্মীর কাছে এই তথ্যটি জেনে আমি নিজের বুকে যে কষ্ট অনুভব করেছি তা সবার সঙ্গে শেয়ার করে এই কষ্টটি কিছুটা হলেও লাঘব করার চেষ্টা করেছি আমার লেখার মাধ্যমে।
আমি নিজেও আন্তরিকভাবে কামনা করি, মৃত্যু হলেই হাসপাতালে যাবেন, আশরাফ ভাইয়ের এই মনোভাবের
খবরটি যেন মিথ্যা হয়। তবে মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ হাসপাতালে গিয়ে রাজ্জাক ভাইকে শেষ দেখার চেষ্টা করেছেন। হাসপাতালে এই মানুষের ভিড়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন কি, না এটি কেউই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলতে পারেননি আমাকে।
লস্কর ভাই, যিনি সার্বক্ষণিক আব্দুর রাজ্জাকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, সোমবারের ফিচার প্রকাশের পর তিনি অবশ্য বললেন, চিকিৎসাকালীন দুই দুইবার সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হাসপাতালে গিয়েছেন আব্দুর রাজ্জাককে দেখতে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের অন্যতম নীতি নির্ধারক সৈয়দ আশরাফের এই হাসপাতালে যাওয়ার খবরটির কোনো মিডিয়া কাভারেজ আমাদের অনেকের চোখে পড়েনি।
মৌলবাদীরা মৃত্যুপথযাত্রী রাজ্জাক ভাই ও তাঁর পরিবারকে যেভাবে টেলিফোন টর্চার করেছে, তা যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে একটি প্রশ্নই এখন আমাদের সামনে উঠে আসবে, তা হলো রাজ্জাক ভাইয়ের প্রতি সরকার, তাঁর দল বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির দায়িত্ব পালনে সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তা কি আরও অব্যাহত রাখবো না, রাজ্জাক ভাইয়ের শেষ ইচ্ছে যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান করে মাঠে নামবো।
বিষয়টি নিয়ে সকলেরই এখনই ভাবতে বসা উচিত বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘন্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১১