ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মফস্বল সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন ও আমরা

আজহার মাহমুদ, সংবাদকর্মী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১১
মফস্বল সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন ও আমরা

একজন সংবাদকর্মী হিসেবে লিখার কোনো উপকরণ পেলে সাভাবিকভাবে লিখতে ইচ্ছে করে। মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃত মোনাজাতউদ্দিনকে নিয়ে মফস্বলেরই আরেক সংবাদিক মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের একটি লেখা (শ্রদ্ধাঞ্জলি: মোনাজাতউদ্দিন ও গ্রামীণ সাংবাদিকতা) পড়ে লিখতে ইচ্ছে হল।

লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। জানি না আমার এই লিখাটি প্রকাশিত হবে কি না। না হলেই বাহ কি! মফস্বলের সাংবাদিকরা তো প্রকাশের নিশ্চয়তা নিয়ে খুব একটা লিখতেও পারেন না। লেখে পাঠাই, প্রকাশ হলে খুশি। না হলে, কারণটুকু জানারও খুব একটা অধিকার নেই!

একজন মোনাজাতউদ্দিনের জন্ম হয়েছিল। চলেও গেছেন তিনি। কিন্তু রেখে গেছেন তার আদর্শ। আমি, আমরা, মফস্বলের অনেক সাংবাদিকই তার আদর্শ লালন করি। সৎ সাংবাদিকতার চেষ্টা করি। কিন্তু অনেক মফস্বল সাংবাদিক নিজেকে ‘সাংবাদিক’ হিসেবে জাহির করতে গিয়ে ভুলে যান আদর্শের কথা। ভুলে যান মহান এই পেশাটির অবমাননার কথা।

মোনাজাত উদ্দিনকে নিয়ে নাজিম উদ্দিনের রচনাটি পড়ার পর মনের মধ্যে দীর্ঘদিনের অব্যক্ত কিছু কথা যেন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। বেশিরভাগ মফস্বল সাংবাদিকেরই সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা থাকে না। তেমনি আমারও নেই। ২০০৪ সালের চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের স্থানীয় মাসিক পত্রিকা ‘চলমান মিরসরাই’-এর হাত ধরে সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। তারপর চট্টগ্রামের দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, দৈনিক ডেসটিনি হয়ে ২০০৮ সাল থেকে দৈনিক ভোরের কাগজের মিরসরাই প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি। চলতি বছরের ২৮ নভেম্বর থেকে কাজ করছি চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণেও।

অনেকটা ব্যক্তিগত ইচ্ছায় সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই অতি ঝঁকিপূর্ণ মফস্বল সাংবাদিকতায় প্রবেশ। যখন সাংবাদিকতায় প্রবেশ করি তখনো হাতে লেখার যুগ। তবে ফ্যাক্সে পাঠানো যেত সংবাদ। শুরু থেকে স্থানীয় অগ্রজ সাংবাদিকদের কাছ থেকে খুব উৎসাহ নিয়ে তাদের অতীত কাহিনি শুনতাম। শুনতাম নিকট অতীতেও কিভাবে তারা সংবাদ সংগ্রহ করে পাহাড়সম কষ্টে পত্রিকার প্রধান অফিসে পাঠাতেন। সংবাদ সংগ্রহ করে, ছবি প্রিন্ট করে কখনো ২৫ কিলোমিটার দূরে ফেনী শহর থেকে কিংবা ৩৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম শহর থেকে তারা কিভাবে সংবাদ পাঠাতেন। আবার কখনো উপজেলার একমাত্র টেলিফোন বুথ থেকে ফোনে সংবাদ পাঠানোর গল্প। আমাদের প্রজন্ম আসার অবশ্য কয়েক বছরের ব্যবধানে কম্পিউটার ব্যবহারের প্রচলন শুরু হল। ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হল। তখন অগ্রজরা বলতেন, ‘তোমরা অনেক ভালো আছ। ’ তাদের অতীত কষ্টের কথা চিন্তা করে তাদের সেই কথাটি সত্য মনে হত। ’

শুরুর দিকে যখন বাবার টাকায় সংবাদ সংগ্রহ কিংবা পাঠানোর কাজ করে যাচ্ছিলাম তখন অবশ্য মফস্বল সাংবাদিকদের কষ্টের কথা বোঝার সুযোগ হয়নি। সে চেষ্টাও করিনি কোনোদিন। তারপর আস্তে আস্তে যখন জীবনের নানা প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন বুঝতে পারি মফস্বল সাংবাদিকতার নানা রঙ। সন্মানি ভাতার নাম করে কতটা নিম্নমানের ‘অসন্মানি ভাতা’ মফস্বলের সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। অবশ্য বেশিরভাগ মফস্বল সাংবাদিকই সেই ‘অসন্মানি ভাতা’ টুকুও পান না। বলতে লজ্জা নেই। আমিও তাদের মধ্যে একজন। সাংবাদিকতা জীবনের এই সাত বছরে এক টাকাও কোনো পত্রিকা থেকে আমি পাইনি। যা হাস্যকরও বটে। অথচ পরিচিতজনদের ধারণা, আমরা অনেক টাকা পয়সা রোজগার করি। তবুও বুকে হাত রেখে বলতে পারি, এমন কোনো কিছু আজ পর্যন্ত করিনি, যা সাংবাদিকতা পেশার অবমাননা হয়। তবে সবাই পারে না। জীবনের প্রয়োজনে যাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় তারা আর এই পেশার সন্মান বা অবমাননা কোনটার কথা ভাবতে চাইলেও পারেন না। পারেন না মোনাজাত উদ্দিনের আদর্শকে বুকে লালন করতে।

সব মফস্বল এলাকার সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলি, মিরসরাই একটি উপজেলা হয়েও অনেক জেলা শহরের  সাংবাদিকদের লেখার মান থেকে এই এলাকার সাংবাদিকদের লেখার মান উন্নত বলা হয়। আর সেটা বলে থাকেন, ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের অনেক সিনিয়র সাংবাদিক। নিজেদের কাছেও তখন খুব গর্ব হয়। যখন ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের অগ্রজ কোনো সাংবাদিক বলেন, ‘তুমি ভালো লিখ। তোমাদের ওখানে অনেকেই তো ভালো লেখে। মফস্বলে পড়ে আছ কেন। এখানে চলে আস। ’ এমন কথা শুনে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাটা খুব বেড়ে যায়। হয়তো, ভবিষ্যতের কোনো একদিন প্রিয় মিরসরাইকে ছেড়ে চলেও যাব। কিন্তু ভুক্তভোগী এবং নিজ চোখে দেখে যাওয়া মফস্বল সাংবাদিকদের এহেন কষ্টের কথা কি কোনোদিন ভোলা যাবে? যাবে না। ভুলতে চাইও না। কেন ভুলবো? শেকড়ের টান যে ভুলে যায়, সে তো মানুষ নয়।

অনেক কষ্টের কথা বলছি। আবেগের কথা বলছি। ঢাকার কোনো সাংবাদিকের কাছে হয়তো এগুলো কিছুই নয়। বরং হাস্যরসের। এসব আবার ভাববার সময় তাদের আছে নাকি। যত্তসব ফাইজলামি। একটা গল্পের মতই হতে পারে তাদের এই বিষয়ক ভাবনাটা। গল্পটা বলেই ফেলি। ঢাকার কোনো এক মাম্মি-ড্যাডির ১৫ বছরের আদরের কিশোরী দাদার গ্রামের বাড়ি এল। এসে সে দাদার কাছে ধান গাছ দেখতে চাইলো। ‘যে ধান গাছের ধান থেকে তৈরি চাল দিয়ে আমরা ভাত খাই, আমি সেই ধান গাছ দেখবো’, বললো কিশোরীটি। তার ধারণা ছিল, ধান গাছে তক্তা হয়। দাদা তাকে ধান গাছ দেখাতে নিয়ে গেল। ধান গাছ দেখে সে রীতিমত অবাক! দাদার কথা বিশ্বাস করতে চায় না। দাদাকে বললো, ‘দাদুমনি, আমিতো শুনেছি ধান গাছে তক্তা হয়। কিন্তু এগুলো দিয়ে কিভাবে তক্তা হবে!’

ঠিক এমনটি মফস্বল সাংবাদিকদের প্রতি ঢাকার বেশিরভাগ সাংবাদিকদের ধারণা। তারা মফস্বল সাংবাদিকদের কষ্টের কথা জানেন না। জানতে চেষ্টা করেন না। করবেনই বা কেন? তারা তো বেশ আছেন। শুধু শুধু উটকো ঝামেলার কোনো মানে হয় নাকি! তবুও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাদের স্মরণ করতে চাই, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মফস্বল সাংবাদিকদের কষ্টের কথা বোঝেন। অন্তত সান্তনাটুকু হলেও দেন।

মোনাজাত উদ্দিনকে নিয়ে লিখার কথা ছিল। নাজিম উদ্দিনের রচনা নিয়ে কথা বলার কথা। কিন্তু আমি কি সরে এসেছি আমার প্রসঙ্গ থেকে? আমার মনে হয় না। মফস্বলে এখনো যারা মোনাজাত উদ্দিনকে স্মরণ করে, তার আদর্শের অনুস্মরণ করে, তাদের কথা বলা মানেই তো মোনাজাত উদ্দিনের কথাই বলা। এখনো এক একজন ‘মোনাজাত উদ্দিন’ অভিমানের বোঝা অন্তরে ধারণ করে মফস্বলে সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন। হয়তো সমাজের জন্য কাজ করতে গিয়ে ভাবছেন না নিজের ভাগ্যের পরিবর্তনের কথা।

তবে সেই দিনও বোধহয় খুব বেশি দূরে নেই। যেদিন মফস্বলের সব সাংবাদিক এক হবে তাদের অধিকার আদায়ে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামষ্টিক আন্দোলনের মাধ্যমে পথে-প্রান্তরে, মাঠে ঘাটের এই সাংবাদিকরা নিজেদের অধিকার আদায় করবে। এমন একটি দিনের প্রতীক্ষায় রইলাম। শ্রদ্ধা মোনাজাত উদ্দিনের প্রতি। ধন্যবাদ নাজিম উদ্দিনকে। জয়তু মফস্বল সাংবাদিকতা। জয়তু মফস্বল সাংবাদিক।

লেখক: মিরসরাই প্রতিনিধি, দৈনিক ভোরের কাগজ।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।