আর দুটো রাত পোহালেই বিজয়ের মাস শেষ। রমজান মাস এলে যেমন ইরাক, আফগানিস্তানে পশ্চিমা দখলদার বাহিনী মৃত্যু আতঙ্কে থাকে, ঠিক তেমনি প্রতি বছর বিজয়ের এই মাসে স্বাধীনতা বিরোধীচক্র বেশ একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়।
স্বাধীনতারও বেশ কয়েক বছর পর। স্কুলে যাওয়া কেবল শুরু করেছি। মাঝে মাঝে গ্রামে এলে দেখতাম বেশ কিছু গর্বিত যুবক, বুকে দেশের প্রতি ভালবাসা, নিটোল দরদ নিয়ে ‘দেশ গঠনের পূর্বশর্ত গ্রামের উন্নয়ন’- এই শপথে কাজ করে যাচ্ছে। ওরা সবাই মুক্তিযুদ্ধ করে ফিরেছে। বেশিরভাগই শিক্ষিত, না হয় ছাত্র। মাঝে মাঝে নেতারা এসে বিভিন্নভাবে উজ্জীবিত করে যেতেন। ব্যক্তিস্বার্থে শহরমুখী না হয়ে গ্রামের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের ছবক দিয়ে যেতেন। অচিরেই নেতাদের পদচারণা কমতে থাকে। বুদ্ধিমান নেতারা দেশের স্বার্থ পকেটে রেখে ব্যক্তি উন্নয়নের জন্য সার্বক্ষণিক দলের সেবা করতে শহরে ভিটা গেড়ে বসেন। ধীরে ধীরে গ্রামে পড়ে থাকা কর্মী বাহিনীর মধ্যেও হতাশা শুরু হয়ে যায়। নেতাদের পথ অনুসরণ করে অনেকেই শহরমুখী হন, অল্প কিছু দেশপ্রেমিক, মাটির শপথের সাথে বেঈমানি না করে গ্রামে থেকে যান।
সেই থেকে যাওয়াদের মধ্যে দুইজন হলেন দুই ভাই, মানিক এবং কাঞ্চন। ডাবল মাস্টার্স মানিক-কাঞ্চন! সারা গ্রাম উজ্জীবিত ছিল তাদের উপস্থিতিতে। ওনাদের দেখলেই কেন জানি ছোটবেলায় আমার মনে হোত, ইস্ আমি কি পারবো এতো বড় বিদ্বান হতে! ডাবল মাস্টার্স! এ যুগের অনেকের মনে হতে পারে, এ আর কি! কিন্তু সেই প্রায় ৩০/৩৫ বছর আগে, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাঙলার এক অজপাড়া গায়ের কথা চিন্তা করুন। শুধু গ্রাম কেন, সারা দেশেও এখনকার মতো ভুরি ভুরি ডাবল মাস্টার্স ছিল বলে মনে হয় না।
এরপর সব কিছু দ্রুত বদল হতে থাকে। সমাজ, রাজনীতি, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ- আরো ভিতরের দিকে মানুষের চেতনা, দেশের প্রতি ভালবাসা, দরদ- সব, সব কিছু পাল্টে যেতে থাকে। দেশের স্বার্থকে ধীরে ধীরে ব্যক্তি স্বার্থ গ্রাস করে ফেলে।
বেশ কয়েক বছর পর বড় ভাই কাঞ্চনও পরিবারের মঙ্গলের কথা ভেবে চাকরী নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। উনি নেতাদের শহরমুখী হতে দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, জীবনের মৌবনের মৌচাক কোথায়! মধুহীন গ্রামে বসে থেকে নিজের যেমন, তেমনি ভবিষ্যত প্রজন্মের জীবনও যে অন্ধকার! দেশ গঠনের গল্প বলা, গ্রামের উন্নয়নের কথা বলা নেতারা শিষ্যদের অজপাড়া গায়ে রেখে সটকে পড়েছেন অনেক আগেই। শহরে গিয়ে আখের গোছাতে ব্যস্ত তারা।
সেই যে দেশের স্বার্থকে পাশে ফেলে রেখে নেতাদের ব্যক্তি স্বার্থে আত্ননিয়োগ করা, তার ফল আমরা আজো পাচ্ছি। বিজয়ের এতো বছর পরে হিসেবের খাতা খুলে দেখলে হতাশা ছাড়া তেমন বড় কিছুর দেখা পাওয়া ভার। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়ে বড় দুটো দলে কতোই না কাণ্ড করে চলেছে।
অন্যদিকে, নতুন প্রজন্মের একটা অংশ একাত্তরের যুদ্ধপরাধীদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে বানচাল করার চেষ্টায় আছে। নতুনদের এই অংশটা কেন স্বাধীনতা বিরোধীদের ছাতার নিচে আশ্রয় নিলো? কেন? হাজার প্রশ্ন!
শুধুমাত্র হানাদার পাকিস্তানিদের হঠানোই কি স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল? নিশ্চয়ই নয়। ৭১ এর যুদ্ধে শুধুমাত্র দখলদার বাহিনীকে হঠিয়েছি আমরা। কিন্তু স্বাধীনতার সেই মূল লক্ষ্য গণতন্ত্র, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন সমাজ, মানবতার উন্নয়ন, এইসব কিছু এখনো সেই তিমিরেই আছে। পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারা ধুঁকে ধুঁকে দারিদ্রের কষাঘাতে মারা পড়ছে। `৭১ এ বুলেটের হাত থেকে বেঁচে গেলেও সেই অকুতোভয় যোদ্ধাদের স্বাধীন দেশে এখনও সন্ত্রাসীদের হাতে মরতে হচ্ছে।
আজও মানুষ দিনে রাতে অপহরন, গুম, গুপ্তহত্যার শিকার। ঘরে বাইরে কোথাও জীবনের এতোটুকু মূল্য নেই। যে ক্ষুধা আর দারিদ্র থেকে মুক্তির জন্য মানুষ যুদ্ধ করেছিলো, আজ তা সর্বব্যাপী। আইনের শাসনের দেখা মেলা ভার। অন্যায়ের হাতে নিষ্পেষিত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালতও আজ দলীয় স্বার্থ এবং দুর্নীতির কাছে বন্দী। যে স্বাধীনতার লাল সূর্যটার জন্য লাখে লাখে মানুষ সবুজ জমিনকে বুকের রক্তে রাঙিয়ে দিয়েছিল, এই কি সেই স্বাধীনতা? ৪০ বছর জুড়ে একটা অসম্পূর্ণ স্বাধীনতাকে বহন করে চলেছি। দেশের মানুষকে ক্ষুধার মধ্যে রেখে, গণতন্ত্র, স্বাধীনতাকে ছুড়ে ফেলে, দেশটাকে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য এবং হানাহানির মধ্যে রেখে, প্রতি মুহুর্তে বিপন্ন মানুষের ক্রন্দন শুনে, আর যাই হোক সেটাকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা বলা যায় না।
মানিক মিঞারা এখনো যুদ্ধ করে চলেছে। যে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, শোষন বঞ্চনামুক্ত সমাজের জন্য ৭১ সালে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন সেই যুদ্ধ এখনো তাদের করে যেতে হচ্ছে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে বিশাল ফারাক! সে সময় শত্রু ছিল ভিনদেশি এবং স্বদেশীয় মুষ্টিমেয় কিছু দালাল। এখন নিজেই নিজের শত্রু। তখন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করাটা ছিল বৈধ। এখন সব কিছু নিরবে হজম করতে হয়। তখন পাশে অনেক সাহসী, বিশ্বস্ত, সংগঠিত সহযোদ্ধা ছিল। এখন পাশে জীবনের ভারে নতমুখ, বিচ্ছিন্ন অসহায় জনগোষ্ঠী। তখন গুলিতে মারা গেলে শহীদ হোত। আর এখন ধুঁকে ধুঁকে মরে গেলেও সেই মৃত্যুর কোন গরিমা নেই। তখন শত্রু মিত্র খুব সহজেই চেনা যেত। আর এখন কে শত্রু, কে মিত্র বড়ই অচেনা!
মানিক মিঞার বন্ধুদের অনেকেই মারা গেছেন। খুব কি বয়েস হয়েছিল তাদের? একটু ভুল হয়ে গেছে। মানিক মিঞার গ্রামে থেকে যাওয়া বন্ধুদের (যারা শিক্ষায় কুলাতে না পেরে গ্রামে থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিল) অনেকেই মারা গেছেন। শহরে যারা গিয়েছিল, তাদের বেশীরভাগ অন্ততঃ বিত্ত আর বৈভবে অনেক সুখেই আছে। মানিক মিঞাকে সেই তুলনায় মনে হয় অনেক বেশি বয়স্ক, রোগে জীর্ণ। রাস্তায় মাঝে মাঝে তাকে বিড়বিড় করে হাঁটতে দেখা যায়। কি বলে সে নিজেই জানে। নাকি বলে, কি বোকা আমি! সঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারিনি। ভাইটি আমার সুখে আছে। ছেলেরা সব মানুষ হয়ে গেল। একমাত্র ছেলেকে মানুষ করার জন্য আত্মীয়ের বাসা ঢাকাতে পাঠিয়ে দিয়ে মানিক মিঞা কি কষ্টে আছেন? নাকি তিনি বিড়বিড় করে বলছেন, ‘বোকারা মানিক হয় বুদ্ধিমানে কাঞ্চন’।
mahalom72@yahoo.com
বাংলাদেশ সময় ১০৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১১