প্রিয় নির্মল সেনকে দেখতে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার হাতে পাঁচ লাখ টাকার একটি চেক দিয়ে এসেছেন।
এমনিতে নানা কারণে বিগত বছরটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকারর জন্য ভালো যায়নি। একটার পর একটা ভুল করেই গেছেন। অথবা ভালো কাজ করেও প্রশংসা পাননি। এর একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি। বেশি টাকায় কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের জন্য উল্টো তাকে এখন সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। কিন্তু এই জরুরি বিদ্যুতের ব্যবস্থা না হলে কী অবস্থার সৃষ্টি হতো দেশে? তবে বিদ্যুতের চুরিও দেশের বড় একটি সমস্যা। এটি আগেও ছিল, এখনও আছে। এই চুরি বন্ধ করতে এ সরকারও ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক যা তা হলো এখন পর্যন্ত খাম্বা দুর্নীতির কথা শোনা যায়নি। সৃষ্টি হয়নি নতুন কোনো খাম্বা মামুনের। এসব নিয়ে পরে লেখার চেষ্টা করব।
আমাদের দেখা প্রবাদ প্রতিম একজন সাংবাদিক নির্মল সেন। জীবিতদের মধ্যে এমন আরও আছেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী, তোয়াব খান, এবিএম মুসা প্রমুখ। এদের মধ্যে চিরকুমার নির্মল সেন নানা কারণে ব্যতিক্রমী। সততা আর আদর্শ নিষ্ঠা নিয়ে তার কোনো বিচ্যুতি নেই। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেরও কড়া সমালোচক ছিলেন। চুয়াত্তরে তার লেখা ‘স্বাভাবিক জীবনের গ্যারান্টি চাই’ নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আদতে গোড়ার থেকে আমাদের বাম রাজনীতির বেশিরভাগ চরিত্র আওয়ামী লীগ বিরোধী। তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অথবা শক্ত অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগকে তারা বরাবর শক্ত প্রতিপক্ষ মনে করতেন। শুরুর দিকে বাম রাজনীতিকদের অনেকে আবার ছিলেন নির্বাচনী রাজনীতির বিরুদ্ধে অথবা নির্বাচনী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পেরে ওঠার মতো নিজস্ব আস্থা-শক্তিসামর্থের অভাব ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাসানী-মোজাফফর ন্যাপের ব্যানারে প্রকাশ্য রাজনীতিতে থাকা বাম দল বা চরিত্রগুলোও আওয়ামী লীগের তাজউদ্দিন নেতৃ্ত্বাধীন সরকারের আনুগত্যে দেশের মুক্তিকামী মানুষের যুদ্ধে শরিক হয় । কিন্তু শ্রেণী, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর সীমাবদ্ধতার কারণে আওয়ামী লীগ নিজের বাম মিত্রদের বরাবর আস্থায় রাখতে পারে না অথবা ব্যর্থ। সময়ের প্রয়োজনে একোমডেটিভ হতে না পেরে আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় অভ্যস্ত অনেক হতাশ বাম পরবর্তীতে বিএনপি-জাপা জাতীয় দলের সঙ্গে মিশে গেছেন। আবার একোমডেটিভ হতে গিয়ে মেনন-ইনুদের অভিজ্ঞতাও ভালো নয়। এসব কোনো পক্ষে যাওয়া যাদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না, তারা টিকিয়ে রেখেছেন নিভু নিভু স্বতন্ত্র স্বত্বা। নির্মল সেন তাদেরই একজন।
মূলত এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে তাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়। দৈনিক বাংলায় চাকরি করেন, লেখালেখির টাকা দিয়ে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল চালান, পাঁচদল আর সাংবাদিক ইউনিয়ন করেন। সারা সময় একই পোশাক, খদ্দরের ঢোলা পাঞ্জাবি, সাদা ঢোলা পাজামা। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনি, এরশাদের পতনের পর বিচিন্তার লেখা আনতে আর লেখার টাকা পৌঁছে দিতে তার তোপখানার বামগলির অফিসে যেতাম। অনেকগুলো বামপন্থী দলের অফিস থাকায় সে গলির নাম হয়েছিল বামগলি, সেখানে একটি ভাত খাবার হোটেলের নাম হয়ে গিয়েছিল হোটেল পলিটিকস। পুরনো ভবনটির স্যাঁতসেঁতে নিচতলার অফিসে বসতেন নির্মল সেন, সিদ্দিকুর রহমানসহ আরও কয়েকজন নেতা। সেখানেই ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর অফিস। দাদাই সেখানে মূল চরিত্র। সবসময় দলের সাধারণ সম্পাদক। আমরাও বরাবর লিখতাম ‘শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের নেতা নির্মল সেন বলেন...। গল্পে গল্পে বলতেন দেশের রাজনীতির নানান ঘটনা প্রবাহের বৃত্তান্ত। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে তার মুখে শোনা গল্পটি খুব মনে পড়ে।
সেই ৭ মার্চের রাতে নির্মল সেনসহ কয়েকজন বাম নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যান। নির্মল সেন তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি এ ভাষণ কী করে দিলেন? এটি তো আপনার ভাষণ না। এটি তো আমাদের বামপন্থীদের ভাষণ। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘নির্মল তোমরা বামপন্থীরা মনে করো তোমরাই খালি পড়াশুনা করো! আমরা কিছু করি না! এখন শোনো কেমনে এই ভাষণ দিলাম। সারারাত বারান্দা দিয়া হাঁটছি আর একটার পর একটা লাইন সাজাইছি...! নির্মল সেনরা এমনি আমাদের আরও অনেক কিছুর সাক্ষী। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর জমানায় তিনি ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ লিখেছেন। কারণ বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের কাছে সেই শাসন আশা করা যায়নি। বর্তমান জমানাতেও অসুস্থ শরীর নিয়ে মন্ত্রী আবুলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কর্মসূচিতে অংশ নিতে তার এলাকার শহীদ মিনারে বক্তৃতা দিতে গেছেন। কারণ শেখ হাসিনার কাছেও এমন শাসন আশা করেনি দেশের মানুষ। যার কাছে কেউ কিছু আশা করে তার কাছে তা না পেলে কষ্ট পায়, সমালোচনা করে। যার কাছে কিছু আশা করে না তার কাছে চাওয়া পাওয়ারও কিছু নেই।
যশোরে সহকর্মী সাংবাদিক শামছুর রহমান গুলিতে খুন হলে আমরা আবার সাংবাদিক হিতৈষী নির্মল সেনকে দেখেছি। সারা সময় পরিবারটির, মামলার খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করতেন। নিজে সারাজীবন শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে রাজনীতি করেছেন, সাংবাদিকদের দাবিদাওয়া আদায়েও বরাবর সামনে থাকতেন। সারা জীবন সততা নিয়ে কাজ করা সেই নির্মল সেন স্ট্রোক-অসুস্থ-পক্ষাঘাতগ্রস্ত হবার পর অসহায় হয়ে পড়েন। কত সাংবাদিক অসুস্থ হলে নিজের টাকায় সহায়তা করেছেন, অসুস্থ হয়ে তিনি হয়ে গেলেন অসহায়, দয়ার পাত্র! ওই সময়গুলোতে তাকে দেখতে গেলে শিশুর মতো কাঁদতেন। স্ট্রোক-পক্ষাঘাতগ্রস্ত হবার পর তিনি দৃষ্টি শক্তি হারান। হাতে লিখতেও পারতেন না। কিন্তু তখনও লেখালেখি বন্ধ করেননি। তার এক ভাইপো রতনের কাজ ছিল তাকে পত্রিকা পড়ে শোনানো, তিনি যা লিখতে চাইছেন তা লিখতেন রতন। কিন্তু এভাবে কী স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত বেঁচে থাকতে পারেন আমাদের সময়ের কালজয়ী সাংবাদিক নির্মল সেন? আর্থিক অস্বচ্ছলতাও তাকে তখন কাবু করে বেশি। আসলে দৈনিক বাংলা বন্ধ হয়ে যাবার পর আর তার নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থা ছিল না। অনেক পত্রিকার লোকেরা তাকে দিয়ে লিখিয়েছেন, কিন্তু সম্মানির টাকা পয়সা ঠিকমতো দেননি। আমাদের প্রভাবশালী নেতানেত্রীরা সিঙ্গাপুর-ব্যাংককের নিচে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান না। আর টাকার অভাবে ভারতে ট্রিটমেন্ট শেষ না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর ঢাকার কমিউনিটি হাসপাতাল, সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্থদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকার সময় ওষুধ কেনা সহ নানান আর্থিক সমস্যায় তাকে জর্জরিত থাকতে হয়। এক সময় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। সে কৃতজ্ঞতায় জনাব মঞ্জু তার ওষুধ কেনার জন্য মাসিক একটি পরিমাণ টাকা দিতেন। কিন্তু ১/১১’র পর মঞ্জু বিদেশ চলে যাবার পর সে টাকা কতদিন অব্যাহত ছিল বা এখনও আছে কি না জানা নেই।
আমাদের দেশের অন্যতম প্রবাদপ্রতীম এই সাংবাদিক অবশেষে আর্থিক কারণেই তার সারাজীবনের কর্মস্থল রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন গোপালগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে। কারণ ঢাকায় তার বাড়ি ভাড়া দিয়ে থাকার সামর্থ্য নেই। ঢাকায় তাকে দেখার কেউ নেই। বাংলদেশে নির্মল সেনের মাপের একজন মানুষের এই পরিণতি ভাবতে পারেন? এই নির্মল সেনের লেখা নিয়ে যারা বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায় অথচ তার কোনো খোঁজখবরও কখনও নেয় না তাদের কী এতে লজ্জা হয়? বা নির্মল সেনের মৃত্যুর পর যারা শোকবাণীতে, স্মরণসভায় কেঁদেকুটে বুক ভাসাবেন, তারা তিনি বেঁচে থাকতে তার শেষ জীবনটি একটু ভালো কাটাবার জন্যে কিছু করতে পারেন কি না! আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর পর কিছু প্রতিষ্ঠানের মিডিয়াজুড়ে দামি বিজ্ঞাপন প্রপাগান্ডায় শোক প্রকাশ প্রতিযোগিতা দেখে হাসি পেয়েছে। জীবিত থাকতে সেই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বিজ্ঞাপনের টাকাগুলো তার হাসপাতাল খরচের পিছনে ব্যবহার করত! নির্মল সেনের মৃত্যুর পর যারা অনেক কিছু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা কী তার জীবিতাবস্থায় করতে পারেন না? প্রধানমন্ত্রী তাকে দেখতে গিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে এসেছেন, এর জন্যে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। এই সময়ে টাকাগুলো তার কাজে লাগবে। কিন্তু নির্মল সেনের মতো মানুষেরা অসুস্থ অসহায় হয়ে গেলে তাদের ঢাকায় রেখে যাবতীয় সহায়তা দিতে কি কোনো হোমসের ব্যবস্থা করা যায়? এটি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেও হতে পারে। কিন্তু তা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ-পর্যায়ে হলে ভালো। বা এমন একটি উদ্যোগ নিলে দেশের অনেক মানুষজন, প্রবাস থেকেও আমরা তাতে অংশ নিতে কন্ট্রিবিউট করতে পারি। প্রস্তাবটি ভেবে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনীত অনুরোধ করছি। ভালো থাকুন নির্মল দা। বেঁচে থাকুন অনেকদিন। খুব মনে পড়ে আপনাকে।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১১