ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ফিউডসই হতে পারে করোনা মোকাবিলার হাতিয়ার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০২০
ফিউডসই হতে পারে করোনা মোকাবিলার হাতিয়ার

মানব বিজ্ঞান তথা নৃবিজ্ঞানের একটি পরিচিত তত্ত্ব ‘ফিউডস’। এ তত্ত্বের মূল বিষয় হলো- বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজেদের হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে বড় শত্রুর মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া। অর্থাৎ সহজভাবে বলতে গেলে- পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে ঝগড়া থাকলেও অন্য পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে নিজেদের ভেতর আন্তরিকতা কাজ করে অন্যদের মোকাবিলা করতে। একই ভাব আমরা লক্ষ্য করি কোনো দেশ বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে। তখন রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের মতাদর্শ ভুলে দেশের জন্য এক যুদ্ধ ছাউনিতে অবস্থান নেয় একে অপরের ওপর আস্থা রেখে। 

বর্তমান বিশ্ব এমন এক সময় পার করছে যেখানে ফিউডসের মতো সব দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে যুদ্ধ, মারামারি ও প্রতিযোগিতার হানাহানি ভুলে অদৃশ্য শত্রু করোনা ভাইরাসের মোকাবিলায়। অদৃশ্য এই দানবের বিপক্ষে আজ মানবজাতি ঐক্যবদ্ধ।

একদেশ অন্যদেশের বিপক্ষে অস্ত্র না পাঠিয়ে পাঠাচ্ছে চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ, চিকিৎসক এবং সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস ও পাশে থাকার সান্ত্বনা। এই বিশ্বটাই যেন আমরা এতদিন শত-সহস্র সম্মেলন করেও পাচ্ছিলাম না। দশকের পর দশক আমরা যুদ্ধ থামাতে পারিনি, থামাতে পারিনি জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ামক কার্বন নিঃসরণের মাত্রা। সিরিয়া, ইরাকের মত ধ্বংস করেছি আমাদের বেঁচে থাকার প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান ওজন স্তর, বরফ গলিয়ে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছি উপকূলীয় অঞ্চলের দেশগুলো। অথচ কাউকে এখন আর সম্মেলন করে বা নিরাপত্তা পরিষদের অনুরোধ করতে হচ্ছে না। আমরা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছি যুদ্ধ, পরিবেশ বিরোধী পারমাণবিক অস্ত্র শিল্প। আমাদের পৈশাচিক প্রতিযোগিতা লকডাউন করে খুলে দিয়েছি মানবতার নির্মল আকাশ, শত্রুর সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছি এক দানবের বিপক্ষে।

২. সারাবিশ্বের মতো নভেল করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবা আঘাত করেছে আমাদের বাংলাদেশেও। দেরিতে হলেও অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের এই দেশটি সর্বাত্মক চেষ্টা করছে এই দানবের থাবা থেকে নিজেদের রক্ষা করার। ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা মিলিয়ন পার হয়েছে, হারাতে হয়েছে লক্ষাধিক প্রাণ। কিন্ত আমাদের মোকাবিলা সক্ষমতা ও সচেতনতা সেই অর্থে খুবই অপ্রতুল। এর পিছনে রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক ও পলিসি মেকারদের অদক্ষতা এবং সাধারণ মানুষের দুঃখজনক অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। ফলাফল, দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। আর এভাবেই চলতে থাকলে আসন্ন ভয়াবহতা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তার বড় কারণ আমাদের মধ্যে সেই উল্লিখিত ফিউডসের কার্যকারিতা নেই, যার ফলে করোনা সংক্রমণ ছাড়াই অন্যান্য রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে বিনা চিকিৎসায়। পিপিইর অপ্রতুলতার অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতাল, দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা শোনা গেছে কিছু সংখ্যক ইন্টার্ন চিকিৎসকের, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা না দিয়েই তাদেরকে পাঠানো হচ্ছে হোম কোয়ারেন্টিনে, শক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না নিয়ে লকডাউন করা হচ্ছে একের পর এক শহর ও গ্রাম। যৎসামান্য যে রাষ্ট্রীয় ত্রাণ জনগণ পাওয়ার কথা সেগুলোও চুরি হয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে এই চুরির সঙ্গে নাম জড়িয়ে যাচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। এছাড়া বেশকিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান অযৌক্তিকভাবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন নির্লজ্জভাবে। এখনো এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না এদেশে ব্যবসা করে আকাশচুম্বী মুনাফা করা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। শুধু একযোগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন আমাদের নিবেদিত প্রাণ চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা ব্যাংকাররা।  

৩. চীনের উহানে করোনা আক্রমণের পর এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় যে দুতিন মাস সময় আমরা হাতে পেয়েছিলাম, তা আমরা কাজে লাগাইনি। বরং সাধারণ জনগন থেকে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তির অবজ্ঞা ও উদাসীনতার মধ্য দিয়ে পার করেছি। ঠিক তার বিপরীত সেই কাজগুলো করে ভাইরাস মোকাবিলায় অনেকটাই সফলতা দেখিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া বা নিউজিল্যাণ্ডের মত দেশ।  

মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারলে আইন করে বা সচেতনতার বিজ্ঞাপন দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফিউডসের মত এগিয়ে আসতে হবে সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের, ত্রাণের পণ্য দরিদ্রদের মাঝে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর মত সুশৃঙ্খল বাহিনীকে দায়িত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি ত্রাণ দুর্নীতির সাথে যুক্ত জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও জনবান্ধব জনপ্রতিনিধিদের উৎসাহ দিতে হবে। অনানুষ্ঠানিকভাবে গঠিত স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশাসনিক সহায়তা দিতে হবে, সেইসঙ্গে অব্যাহত রাখতে হবে সচেতনতার প্রচার ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম।  

এই সংকটে জনসচেতনতায় বড় ভূমিকা রাখতে পারেন ধর্মীয় প্রতিনিধিরা। মহামারি মোকাবিলায় ধর্মের অপব্যাখ্যা যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে তাদের কাজ করা উচিত। মসজিদ মন্দির নিয়ে ধর্মমন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে চলতেও বাধ্য করতে হবে। অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক খাতে সঠিক নির্দেশনা প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিদিন ব্যাংক খোলা রেখে সময় সীমিত করা খুব বেশি কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। বরং সপ্তাহে তিন দিন বিরতি দিয়ে দুইদিন পূর্ণকালীন ব্যাংক খোলা রাখা যায় কি না সেটাও ভাবতে হবে।  

সম্মিলিতভাবে এগুলোর বাস্তবায়ন এবং সকলের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসাই হতে পারে এই দানব মোকাবিলার হাতিয়ার। তা না হলে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে কারো জন্যই মঙ্গল হবে না। মোট কথা, এই সংকটে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে যার যার অবস্থান থেকে। ভুলে গেলে চলবে না, আমরা একই জাহাজের যাত্রী। সুতরাং যে কোনো একজনের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলায় কোনো ছিদ্র হলে সেই ভুলের মাশুল দিয়ে ডুবে মরতে হবে সবাইকে। তাই ফিউডসের ব্যবহারিক প্রয়োগ হোক আমাদের করোনা দানব মোকাবিলার হাতিয়ার।

লেখক:কবি ও নাট্যকার।
email:kabilsadi@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।