ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

তিতাস হত্যার জবাব চাই

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১২
তিতাস হত্যার জবাব চাই

তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে একটি জ্বলজ্যান্ত নদীকে হত্যার অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে দেশে! ভারতকে ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা দিতে ঘটানো হয়েছে নারকীয় ঘটনাটি! হাজার বছরের পুরনো তিতাস নদীর ওপর পাশাপাশি দুটি রেল ও সড়ক সেতু। কিন্তু সড়ক সেতুটি দুর্বল হওয়াতে এর উপর দিয়ে ভারতীয় ভারী যানবাহন লরি ট্রাক চলাচলের অনুপযোগী।

এমন এক-দুটি গাড়ি উঠলেই ভেঙ্গে পড়বে! সে কারণে শুধু এসব ভারতীয় গাড়ির নিরাপদ চলাচলের সুবিধার্থে দুই সেতুর মাঝ বরাবর নদীর বুকে বাঁধের মতো মাটি তৈরি করে ফেলা হয়েছে একটি বিকল্প রাস্তা! ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সড়ক(!)’ তথা ‘তিতাস নদী হত্যা সড়ক’! এতে স্বাভাবিক প্রবাহ গতি হারিয়ে মরতে বসেছে একটি জ্যান্ত নদী! তিতাস নদীভিত্তিক লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকায় আকস্মিক টান পড়েছে! এলাকার জীববৈচিত্রও সব শেষ! এ নিয়ে একুশে টিভি’র সরেজমিন রিপোর্ট দেখতে দেখতে অমর চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক, তার কালজয়ী ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিটির কথা মনে পড়ল । ওস্তাদ আয়াত আলী খান সহ তিতাস পাড়ে জন্ম নেওয়া অনেক গুণী মানুষের কথা। তাদের, বাংলাদেশের অন্যতম প্রাণের একটি নদী তিতাস হত্যার কৃতি্ত্ব নিতে উঠে পড়ে লেগেছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ কাম মহাজোট সরকারের ঘাড়ে! ইতিহাসে উঠে গেল তিতাস নদী হত্যাকারী হিসাবে এই সরকারের নাম! দুনিয়া জুড়ে যেখানে চলছে পরিবেশবাদীদের জয়গান, এই কিছুদিন হলো ডারবানে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে গিয়ে অনেকের সঙ্গে অনেক বড় বড় কথা বলে এসেছে বাংলাদেশ, টিপাইমুখ বাঁধ হলে বাংলাদেশের বড় একটি অঞ্চল মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হবে বলে দেশে যখন একটি আন্দোলন চলছে, তখন ভারতীয় স্বার্থে দেশে একটি নদী হত্যার বিষয়ে সরকার-বিরোধীদল, মূল ধারার বেশিরভাগ মিডিয়া অবাক নিশ্চুপ! কেইসটা কী?

এমনিতে আমি বরাবর ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট-গভীর সমুদ্র বন্দর এর সবকিছুর পক্ষে। বিদেশে গিয়ে আমরা যা কিছু চাই, যা কিছু পাই, সবকিছুর পক্ষে। কিন্তু ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্টের নামে আমাদের দেশে এসব কী কাহিনী? ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট এসবতো আমাদের সুবিধার-লাভের জন্যে দেব কি দেব না!  টাকা পাবো সার্ভিস দেব। ব্যস! ভারতের অনগ্রসর উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহে তাদের দ্রুত পৌঁছতে দরকার ট্রানজিট। এ নিয়ে অনেকদিন ধরে তারা নানান ফোরামে দাবি করে আসছিল। আর বিএনপি ‘দেবো না’, আওয়ামী লীগ ‘দেবোনা কেন’ বলে আসছিল। ট্রানজিট দিলে ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী, গুন্ডাপান্ডা সব ঢুকে যাবে, এমন শের মানুষকে বলছিল-বোঝাচ্ছিল ভারত জুজু’র ব্যবসায়ীর দল! এর মাঝে কলকাতার সঙ্গে ট্রেন-বাস চলছে, ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী-গুন্ডাপান্ডা কিছু না দেখে এ প্রসঙ্গটি আপাতত বাদ।

আদতে দুনিয়াতে এখন যে কেউ আর একদেশ আরেক দেশ এক দৌড়ে দখল করে না; বাজার দখল করে, গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের বাজার যে অলরেডি ভারতের পেটের মধ্যে, ব্যবসায়ী জ্ঞানপাপীরা অবশ্য তা কম বলে। কারণ দেশের বাজার ভারতের হাতে তুলে দিতে এদের কারোর অবদানই কারও চেয়ে কম নয়। স্বাধীনতার পর থেকে জুজু ব্যবসায়ীরা ক্ষমতায় বেশি ছিল। কাজেই দেশকে ভারতীয় পণ্যের একচেটিয়া বাজারে পরিণত করতে তাদের অবদানটাই বেশি। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপেও ভারতীয় নানা ভোগ্যপণ্যের ওপর নির্ভরশীল দেশ বাংলাদেশ! গরু-পেঁয়াজ থেকে শুরু করে নানান কিছু ভারতীয় না হলে আমাদের চলে না, জমে না! ফেনসিডিল এসবতো আছেই। সৌদি আরবের লোকজন যেমন মউজ করতে ড্রাইভ করে বাহরাইন চলে যান, আমাদের অনেকে যান কলকাতা!

কিন্তু এবার ভারতের বন্ধু একটি দল ক্ষমতায় আসার পর ভালো সম্পর্কের দাবি নিয়ে যেখানে দেশের জন্যে ২৪ ঘন্টার তিনবিঘা করিডোরের মতো ভালো অনেক কিছু আদায় করা সম্ভব ছিল, উল্টো দিল্লিওয়ালারা যেন আমাদের পেয়ে বসেছে! আমাদের প্রধানমন্ত্রী দুই উপদেষ্টা গওহর জামিল, মশিউর রহমানরা যখন মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা বলেন, টাস্‌কি খেয়ে ভাবতে হয় এরা কোন দেশের উপদেষ্টা? ইন্ডিয়ার না বাংলাদেশের? তিস্তা চুক্তি যখন হলো না তখন বাংলাদেশ বড় গলায় বলেছিল, তাহলে আমরাও খেলব না অথবা ট্রানজিট চুক্তি করব না। কিন্তু আশুগঞ্জ হয়ে ভারতীয় বিদ্যুতকেন্দ্রের মালামাল নেবার সময় জানা গেল কোনো সমস্যা নেই! এ ধরনের একটি চুক্তি অনেক আগেই দু’দেশের মধ্যে করা আছে! এরপর লাগলো আরেক ক্যাচাল! ভারত ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা নেবে, কিন্তু শুল্ক দেবে না! প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা বলা শুরু করলেন, ‘লজ্জা লজ্জা, এভাবে শুল্ক নেয়া যায় না বা দুনিয়ার কোথাও নেয় না(!), এভাবে শুল্ক নেয়া অভদ্রতা’ ইত্যাদি! আবার এ নিয়ে বিরোধীদল প্রতিবাদ, মিডিয়ায় লেখালেখি, টকশো’তে ফাটাফাটি শুরু হলে সরকারি নেতারা বলা শুরু করলেন, নেব না কেন নেব। শুল্ক অবশ্যই নেওয়া হবে। দুদেশের মধ্যে এ নিয়ে সিটিং দিয়ে মিটিং হবে। আলোচনা করে নির্ধারণ করবেন শুল্ক হার! ভারতকে ট্রানশিপমেন্ট প্রেম সুবিধা দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন প্রেম দেওনেওয়ালারা, কিন্তু আজ পর্যন্ত শুল্কের বিষয়টিই সুরাহা করেননি! বড়ই গোলমেলে বিষয় তাই নয় কী?
 
titasআসলে আমাদের চতুর নেতা-উপদেষ্টারা বরাবর ঘোড়ার আগে গাড়ি কেনায় অভ্যস্ত। এমনিতে সবকিছুতে নিজে নিজে পণ্ডিত মনে করেন। কখনো যেটি প্র্যাকটিক্যালি ভাবেননি তাহলো ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট দেবার মতো অবকাঠামোই আমাদের নেই। যারা এসব বিভিন্ন সময়ে বলেছেন তারা অবকাঠামো সৃষ্টির কাজ করেননি। আর যারা এনিয়ে উতলা অবস্থায় ছিলেন, তাদের মাথায়ই ছিলনা আবুলের মতো একজন অকর্মা যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন দেশে! যিনি দেশের রাস্তাঘাটের রুটিন মেরামতের কাজ করতে-করাতে পারেন  না, তিনি বা তার আমলের রাস্তা দিয়ে যাবে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্টের বিশাল সব ভারতীয় লরি ট্রাক! এখন আমাদের জানা দরকার তিতাস নদীর মাঝ বরাবর বাঁধ দিয়ে ভারতীয় গাড়ি চলাচলের রাস্তা আজগুবি রাস্তা বানানোর নদী হত্যার বিধবংসী সিদ্ধান্তটিও আবুল মন্ত্রীর দেয়া কিনা? না অন্য কারও? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি তা একদম জানতেন না? বা জানার পর, একুশে টিভির রিপোর্ট দেখার পর তিনি কি করেছেন। আগের ক্ষমতায় জলাভূমি ভরাট করে কোন স্থাপনা প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ করে আইন করেছিলেন এই প্রধানমন্ত্রী! এবার তার ক্ষমতার সময় দেশের একটি পরিচিত নদী হত্যা? এখন এ বিষয়টির শানেনজুল আমাদের কে বলবেন? বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অনেক ভালো ভালো কথা বলে মন্ত্রী হয়েছেন, এখনও বলছেন। তিনি কী আমাদের বিষয়টি তদন্ত করে আসল সত্য জানানোর সাহস-ক্ষমতা রাখেন? না প্রধানমন্ত্রীই দেবেন এই জবাব? জবাবটা কিন্তু কাউকে না কাউকে দিতেই হবে। কোন মাপ নেই।

বিএনপি সহ ভারত জুজু ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে কিছু কথা।   প্রতিদিন এত বক্তৃতা দেন, প্রেসকনফারেন্স, মাজার জিয়ারত, আলোচনা বা কেউ দেখা করতে গেলেও মিডিয়ায় একখানা প্রেসরিলিজ আসে। কিন্তু তিতাস হত্যা ইস্যুতে নিরব, মুখে কলুপ কেন? সময়ে মহাজোট সময়ে একা ও স্বতন্ত্র নেতা(!) এরশাদ টিপাইমুখ ইস্যুতে  সিলেটের জকিগঞ্জ পর্যন্ত রোডমার্চ করে ফেলেছেন! এখন আবার  যাচ্ছেন উত্তরবঙ্গে। টিপাইমুখ বাঁধ হবে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে একশ কিলোমিটার দূরের ভারতীয় এলাকায়। ওসবে সীমান্ত শহর পর্যন্ত বাহারি গাড়ির রোডমার্চ করতে পারেন, কিন্তু দেশের ভিতরের তিতাস নদী বিধবংসী বাঁধ চোখে পড়ে না! দেশের মানুষের সঙ্গে এসব একটু বেশি ফাজলামো হয়ে যাচ্ছে না? আসলে আমাদের প্রধান দলগুলো মুখে সারাদিন বড় বড় কথা বললে, অন্তরে যে কপট চরিত্রের, দেশের চাইতে ভারতীয় বা বিদেশি যে তাকে টাকা, সুযোগ-সুবিধা দেয় তাদের স্বার্থ রক্ষার ধ্বজাধারী(!) তিতাস নদী হত্যার বাঁধটিই এর হালের জ্বলজ্বলে সাক্ষ্য। এখন এই নদী বাঁচাতে সরকার যদি দ্রুত ব্যবস্থা না দেয় তাহলে তিতাস পাড়ের মানুষজনকে সঙ্গে নিয়ে উদ্যোগটি নিতে হবে। মানুষের মিছিল নিয়ে গিয়ে নদী রক্ষার আন্দোলনে বিধবংসী ওই বাঁধ-রাস্তাটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পারবেন না? স্বার্থান্বেষীদের লোভের হাত থেকে তিতাস নামের নদীটি বাঁচাতে এমন একটি জরুরি সিদ্ধান্ত নিন প্রিয় দেশবাসী। মিনতি জানাই। এখনই সময়। জাগো বাহে কোন্‌ঠে সবাই...!
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, ০৩ জানুয়ারি, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।