চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা।
সম্প্রতি যেখানে হয়ে গেল ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং নারীর ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক এক সেমিনার। আয়োজক যৌথভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আমরা একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দল ঢাকা থেকে সেমিনারটি কাভার করতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। যেহেতু বিভাগের উদ্যোগে সেমিনার। ব্যস্ততার কেন্দ্রবিন্দু বিভাগের সভাপতির কাঁধেই বর্তায়। যার নাম ড. হানিফ সিদ্দিকী। ফুসফুসের সব জানলা খোলা রাখা আড্ডাবাজ এই মানুষটি আমাদের সাথে দিনভর।
সেমিনার
সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হানিফ সিদ্দিকী। প্রবন্ধের সার কথা- ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। আইসিটি খাতে একজন নারী যদি তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারেন তবে সামাজিক ধ্যান-ধারণা, ধর্মীয় গোঁড়ামি কোনো বাঁধা হতে পারবে না। ঘরে বসেও আপনি চাইলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবেন। ’ প্রযুক্তি বিদ্যার ব্যবহার নিয়ে সেমিনার। সেই সেমিনারে দেশের অন্যতম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরডটকম প্রযুক্তির ধুন্ধুমার ব্যবহার দেখিয়ে দিল সেমিনারে সয়বাদ ‘লাইভ’ প্রচার করে। সেমিনার চলাকালীন সেমিনারকক্ষ থেকে পাঠানো সংবাদটিকে দিনের সেরা পাঁচটি সংবাদ তালিকায় বিশেষ ট্রিটমেন্ট দেয়া হলো। সেমিনারে দর্শক আসন থেকে দাড়িয়ে ড. হানিফ ঘোষণা করলেন প্রত্যেককেই বাংলানিউজের হোমপেইজ ভিজিট করতে। হলভর্তি দর্শকদের মধ্যে তখন সংবাদ দেখার জন্য চঞ্চলতা। প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যবহার নিয়ে সেমিনারে প্রযুক্তির এই তাৎক্ষণিক ব্যবহার সত্যিই প্রশংসনীয়।
কে এই সিদ্দিকী
সিদ্দিকী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ২০০৩ সালের ফেব্র“য়ারিতে প্রভাষক পদে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সিদ্দিকীর গ্রামের বাড়ি নওগাঁয়।
বিশ্বস্বীকৃতির গল্প
১৯৯৫ সালে কৌতুহলের বশে প্রথম কম্পিউটারের কি-বোর্ডে হাত দেওয়া। তারপর অনেকটা এগিয়ে গিয়ে ওয়েবসাইটের বিভিন্ন তথ্য সমন্বয় করার উপায় বের করতে একনিষ্ঠভাবে গবেষণাকর্মে লেগে থাকা। সিদ্দিকীর এই অধ্যবসায় ২০১১ সালে এসে পেল বিশ্বস্বীকৃতি। কম্পিউটার বিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সাময়িকী ‘জার্নাল অব ওয়েব সিম্যান্টিকস’-এ তার প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিই সবচেয়ে বেশিবার পঠিত হয়েছে। ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ‘মোস্ট সাইটেড আর্টিকেল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বের কম্পিউটার প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা ওয়েব সিম্যান্টিকস গবেষণায় ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রবন্ধটি সবচেয়ে বেশিবার সূত্র (রেফারেন্স) হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক জার্নালটিতে ২০০৯ সালে তার গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম অ্যান ইফিশিয়েন্ট অ্যান্ড স্ক্যালএবল এলগরিদম ফর সিগমেন্টেড অ্যালাইনমেন্ট অব অন্টোলসি অব আরবিট্রারি সাইজ’।
কিভাবে কাজ করে সার্চ ইঞ্জিন
বিভিন্ন ওয়েবসাইটে লাখো-কোটি তথ্য থাকে সেগুলোকে সমন্বয় করে ড. হানিফ সিদ্দিকী একটি কমন ডেটাবেইস তৈরি করেছেন, যাতে একটি কম্পিউটার ওয়েবসাইটের বিভিন্ন কমান্ড সহজে বুঝতে পারে। অর্থাৎ গুগল সার্চ ইঞ্জিনে কোনো কিছু খুঁজলে (সার্চ) দেখা যায় ওই সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় অসংখ্য তথ্য হাজির করেছে সার্চ ইঞ্জিন। কিন্ত ওয়েব সিম্যান্টিকসে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট প্রশ্নটির উত্তরই বের করে আনবে এ সার্চ ইঞ্জিনটি।
৬০ দিনে ফল প্রকাশ
সেশনজটমুক্ত বিভাগ ঘোষণায় আগামী পাঁচ বছরের জন্য ‘মাস্টারপ্ল্যান’ নিয়ে এগুচ্ছে সিএসই বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ যখন ফল প্রকাশে সময়ক্ষেপণ করছে তখন সিএসই বিভাগ ফল প্রকাশ করছে মাত্র ৬০ দিনে। হানিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘অনার্সের ফলাফল ৬০ দিনের মধ্যেই ঘোষণা করেছি আমরা। অথচ নিয়মানুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে ফল ঘোষণার কথা। শ্রেণীকক্ষ সংকট, ল্যাবে কম্পিউটারের অপ্রতুলতা, শিক্ষক সংকটসহ বেশ কিছু সমস্যার পরও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এর মূল কারণ জবাবদিহিতা এবং পরিকল্পনা। ’
সিদ্দিকীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ‘নলেজ বেইজ’ করার কাজ শুরু করতে চান তিনি। এছাড়াও তিনি পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন আইটেমের নিউজের অনলাইন সংগ্রহশালা ‘নিউজ ক্লাসিফিকেশন’ নিয়েও কাজ করতে চান।
বসছে আন্তর্জাতিক সম্মেলন
২০১২ সালে অনুষ্ঠিতব্য ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন কম্পিউটার সায়েন্সেস অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ শীর্ষক প্রযুক্তি বিদ্যার আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সিএসই বিভাগে। বিভাগের দক্ষ কম্পিউটারবিদ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ২০টি দেশের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের সাথে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পাবেন।
জেগে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা থেকে যাওয়া সাংবাদিক বাহিনীকে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে রাতের ট্রেনে বিদায় দিতে এসেছেন সিদ্দিকী। ঢাকাগামী ট্রেনে তুলে দিয়ে স্যার ফেরত গেলেন ক্যাম্পাসে। তুর্ণানিশিতা, রাত ১২টা বেজে বিশ মিনিট। স্যারকে ফোন করি ‘স্যার কি ক্যাম্পাসে পৌঁছেছেন?’ মোবাইলে ভেসে আসে উত্তর-‘আমি বাসায় যাইনি। ডিপার্টপমেন্টে এসেছি। আগামীকাল সকালের মধ্যেই পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করতে হবে। তাই আছি রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। ’ ক্যাম্পাস মানেই নয়টা-পাঁচটা এই চিরাচরিত মনোভাব ভুল প্রমাণ করে কাজপাগল সিদ্দিকী রাতে জেগে থাকেন। রাতের ক্যাম্পাস ঘুমে। একটি বিভাগ কিন্তু জেগে আছে। সিএসই বিভাগ! যেন একখণ্ড দ্বীপ। পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপের মতো অনুকরণীয় এই দ্বীপ দেখে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না- নিকশ কালো রাতেও জেগে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়!
লেখক: সাংবাদিক ও ব্লগার
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১২