ক্রিসমাসের দু’চারদিন আগে হবে। কাজ শেষ করে মধ্যরাতে ডেরায় ফিরছি।
এবারে পুলিশ অফিসারের প্রশ্ন, কাজ থেকে ফিরছো বুঝি? বললাম, হ্যাঁ। জবাবে এলো, অনেক কষ্ট করে এলে। তোমাকে অনুসরণ করার কারণ হলো, তোমার বাম দিকের ব্রেক লাইটটা কাজ করে না। তুমি কি সেটা জানো? আমি বললাম, না তো। সে তখন সুন্দরভাবে দেখালো। আমি দুঃখিত হলাম। এবার অফিসারটি বললো, এর জন্য অর্ধশত ডলার জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু সামনে ক্রিসমাস এবং তুমি অনেক কঠিন কাজ করে ফিরছো। দেশ তোমার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। তুমি আমাদের কাজে অনেক সাহায্য করেছো। তাই তোমার জরিমানার টাকাটা আজকে আমাদের টিমের পক্ষ থেকে তোমার পরিবারকে ক্রিসমাসের গিফট।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। খুশী হবার কথা। হয়েছিও সেটা। কিন্তু লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ঈদ এবং ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে পুলিশের চাঁদাবাজি, মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে টাকা নেবার একটার পর একটা ঘটনা।
আরেকটা কথা বলি। এখানে কোনও কারণে পুলিশের মুখোমুখি হওয়াটা অসম্ভব উপভোগ করি। এর প্রধান কারন হলো, বাঙলাদেশের পুলিশের আচরণের বিভিন্ন ঘটনাবলির পরে উল্টোটা বেশ উপভোগ্য। আমাদের দেশে পুলিশ মানেই পুলিশকে ‘স্যার স্যার’ ডেকে মুখে ফ্যানা তোলা। কিন্তু এখানকার পুলিশ উল্টো আপনাকে স্যার ডাকবে। পুলিশের মুখে ‘স্যার’ ডাক শুনতে কোন বঙ্গ সন্তানের ভালো না লাগে!
এবার একটা সিরিয়াস কথা বলি। মানুষের ভাষার কিন্তু একটা প্রবল ভূমিকা আছে তার আচরণ কি হবে। যেখানে কারণে অকারণে পুলিশকে ‘স্যার’ ডাকতে হয়, সেখানে ‘স্যার’ হয়ে পুলিশ কিভাবে তার অধঃস্তন (??) জনগণের সেবা করবে? তাই টাকা পয়সা দিয়ে পুলিশকেই সেবা দিতে হচ্ছে অহরহ। পুলিশ যদি জনগণের সেবক হয়ে থাকে তবে, জনগণকে পুলিশেরইতো ‘স্যার’ ডাকার কথা। এই স্যার ডাকার সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে জনগণের প্রতি পুলিশের আচরণও পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।
বাঙলাদেশে পুলিশের আচরণ নিয়ে ডিম আগে না মুরগী আগের মতো একটা বিতর্কও আছে। পুলিশের সুযোগ সুবিধার সাথে নাকি আচরণেরও একটা সম্পর্ক আছে। কেউ না মানলেও আমি সেটা মানি। কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ নয়। জনগণের সাথে পুলিশের ব্যবহার, সম্ভাষনের সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। এটা শুধু পুলিশের বেলায় নয়। যে কোনও সরকারী বেসরকারী সার্ভিস সেক্টরের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। স্যার ডেকে স্যারের কাছ থেকে সেবা পাওয়ার আশা করাটা ঠিক নয়। জনগণের সেবার মান নিশ্চিত করতে ‘স্যার’ ডাকার সংস্কৃতি গণমুখি করতে হবে। অর্থাৎ সেবার জন্য কেউ এলে তাকে সম্মান দেখানোর জন্য সরকারী বেসরকারী সেবা সেক্টরের লোকদের দিয়ে উল্টো সেই জনগণকেই ‘স্যার’ ডাকাতে হবে। জনগণকে দিয়ে স্যার ডাকানো একটা ঔপনেবেশিক সংস্কৃতি, শোষনের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি।
‘পুলিশে দুর্নীতি বাড়ছে। বাড়ছে ক্ষমতার অপব্যবহার। কমছে সেবার মান। থানায় গিয়ে মানুষ প্রতিকার পাচ্ছে না। পাচ্ছে খারাপ ব্যবহার। তল্লাশি চৌকির নামে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। ’ কথাটা আমার নয়। পুলিশ সপ্তাহ উদ্ভোধনের পর দেয়া বক্তব্যে আইজির পদমর্যাদাপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশের সমন্বয়ক ফণীভূষণ চৌধুরীর।
তিনি আরো বলেছেন, “‘এই সরকারের হাত ধরে পুলিশের অনেক অর্জন এসেছে। গত তিন বছরে আমরা যা পেয়েছি এত অল্প সময়ের মধ্যে এর আগের কোনো সরকার পুলিশকে দেয়নি। এত কিছু পাওয়ার পর আমরা করদাতা দেশের মানুষকে কতটুকু সেবা দিতে পেরেছি, সেটা নিয়ে মনে হয় এখন আত্মসমালোচনার দরকার। মাঠপর্যায়ের পরিদর্শকদের প্রথম শ্রেণী এবং উপ-পরিদর্শক ও সার্জেন্টদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে জনগণকে সেবাদানের নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। তার মানে কী, তাঁদের প্রশিক্ষণ, মোটিভেশন ঠিকমতো হচ্ছে না, ঠিকমতো জবাবদিহি নিশ্চিত করা হচ্ছে না?’ (সূত্রঃ পত্রিকা)
সাধুবাদ তাকে। সত্য কথাটা অকপটে বলার জন্য। আমার মনে হয় এ ধরনের আত্ন সমালোচনার একটা পুরস্কার থাকা জরুরি।
উন্নত বিশ্বের সব পুলিশই কি ভাল? অবশ্যই না। অনেক বর্ণবাদী (রেসিস্ট) পুলিশও আছে। শোনা যায়, বিশ্বের অনেক দেশে রাতের আঁধারে কিংবা নির্জন স্থানে স্বাক্ষীহীন পরিবেশে আমাদের মতো বাদামি চামড়া বা কালো চামড়ার কাউকে পেলে অনেক রেসিস্ট পুলিশ আচ্ছামতো প্যাদানি দেয়,খামোখা। এদের সংখ্যা কেমন কিভাবে বলবো? মনের ভাব বোঝার যন্ত্র তো নেই। তবে পার্থক্য হলো, এদের অপরাধ প্রমাণ করতে পারলে কঠোর শাস্তি আছে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উল্টো হয়। পুলিশের অপরাধ প্রমাণ করতে চাইলে মিথ্যা মামলায় ফাঁসতে হয়। খুবই সামান্য পার্থক্য কিন্তু গুরুত্ব ব্যাপক।
আরেকটা ভাল উদাহরণ এখানকার পুলিশের। নতুন বাসায় উঠেছি। চাবি পেয়ে প্রথমবারের মতো বাসা দেখতে আসা। প্রতিবেশীদের একজন নতুন আগন্তককে খালি বাসায় ঘুরাফিরা করতে দেখে সোজা ট্রিপল জিরোতে ফোন। ওমা! কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশের গাড়ি বাসার সামনে হাজির। কেবলই আমি আমার মেয়েকে নিয়ে সামনে সিঁড়িতে বসেছি। পুলিশের দল দ্রুত গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে আসতেই দেখে, আমি ছোট মেয়েকে নিয়ে সিঁড়িতে বসা। বুদ্ধিমান পুলিশ বুঝে গিয়েছে আর যাই হোক, ছোট মেয়েকে নিয়ে কোনও পিতা নিশ্চয়ই চুরি কিংবা ডাকাতি করতে আসেনি। বিপদ নেই নিশ্চিত হয়ে ধীরে ধীরে কাছে এসে বললো, ‘এটা কি তোমার বাসা? বললাম, হ্যাঁ। ’
‘দুঃখিত। তোমার নেইবারের ফোন পেয়ে এসেছি। ’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। আমি আজকেই প্রথম এসেছি। ভুল হতেই পারে। ’ এরপরে সরি বলে প্রস্থান।
আচরণগুলে দেখুন। জননিরাপত্তায় দ্রুততার সাথে স্পটে আসা। ভুল বুঝতে পেরে অহেতুক জনগণের ভোগান্তি না বাড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করে প্রস্থান। জননিরাপত্তার দায়িত্বটা কি শুধু পুলিশের? অবশ্যই নয়। পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয় সারা দেশে নজর রাখা। এক্ষেত্রে জনগণের সহযোগিতাও দরকার। সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে জনগণ এবং পুলিশ একে অপরের পরিপূরক। প্রতিবেশী তার দায়িত্ব পালন করেছে আগন্তকের আগমনে সন্দেহ জাগায়। পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করেছে দ্রুততার সাথে সেই আহবানে সাড়া দিয়ে। সেইবার পুলিশ চলে যাবার পরে এক পথচারী তাই হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিলো, ‘তুমি খুব লাকী। ইউ গট এ গুড নেইবার। ’
পথচারী ঠিকই বলেছে। ভাবছি আমার ক্রিসমাস গিফটের কথা। কখনো কি কারো সৌভাগ্য হবে ঈদের আগে আমাদের পুলিশের কাছ থেকে এ রকম মন ভাল হওয়া উপহার পাওয়ার? খেটে খাওয়া মানুষগুলো সারা বছর খেটে দুটো টাকা কামিয়ে ঈদে বাড়ি ফেরার পথে নানা হয়রানি, চাঁদাবাজির শিকার। ঈদের আগের শপিং মানেই গলাটা কেটে সেখানে রেখে আসা। ব্যবসায়ীরা দাম হাঁকায় যে যতো পারে। এখানে ক্রিসমাসের আগে শপিং মানেই হচ্ছে টাকার সাশ্রয়। ক্রিসমাস, নতুন বছর মানেই সবখানে মূল্যহ্রাসের ছড়াছড়ি। উপচে পড়া মানুষ শপিং মলগুলোতে। পকেট থেকে বাড়তি টাকা খরচ করে বিষন্ন মনে নয়, বরং ক্রিসমাস উপলক্ষে মূল্যহ্রাসের সুযোগ নিয়ে টাকা বাঁচানোর আনন্দে বিভোর।
সে যাই হোক। পুলিশের কথা বলছিলাম। আমার চার বছর অতিক্রম করা ছোট্ট মেয়েটা পুলিশের গাড়ি দেখলেই খুশীতে চিৎকার করে ওঠে: ‘বাবা, পুলিশ, পুলিশ। পুলিশ অনেক ভাল। একদিন পুলিশ আমার গাড়ি থামিয়ে কাগজ পরীক্ষা করছিল। আমার মেয়ে পিছনে বেবি সিটে বসা ছিল। তাদের স্মার্ট উপস্থাপনা, মার্জিত ব্যবহার হয়তো এদেশের পুলিশ সম্পর্কে আমার মেয়ের মনে ইতিবাচক রেখাপাত করেছে। কর্তব্য শেষে আমাদের সবাইকে মিষ্টি করে বিদায় নেবার পরে মেয়ের ছোট্ট প্রশ্ন, ‘ওরা কারা বাবা?’
‘পুলিশ। ’
‘পুলিশ খুব ভাল বাবা, তাই না?’
আমি ছোট্ট করে উত্তর দিই, ‘হ্যাঁ, বাবা। ’
পুলিশ সম্পর্কে ছোট মনে এই ইতিবাচক প্রভাব কখনো বড় ধাক্কা না খেলে হয়তো আজীবন থেকে যাবে। রাষ্ট্রীয় সেবায় নিয়োজিত যে কোনও বাহিনী বা সংস্থার জনগণের এই আস্থাটুকু অর্জন করা খুবই জরুরি।
কিন্তু আমার দেশে? যে সন্তান মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় তার সুস্থ্, নিরাপরাধ বাবাকে পুলিশের হাতে নির্যাতিত হতে দেখে, তার মনে পুলিশ সম্পর্কে কি ধারণা হবে?
মেয়ের পুলিশ-অভিজ্ঞতার বেশ কয়েক মাস পরের কথা। আমি ইন্টারনেটে দেশের হরতালের ভিডিও দেখছিলাম। পুলিশের অতিশয় বাড়াবাড়ি। হঠাৎ ঘাড়ে ছোট্ট হাতের স্পর্শ। মেয়ে আমাকে বাসায় থাকলে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। আবারো হঠাৎ প্রশ্ন, ‘বাবা ওরা কারা?’
বললাম, ‘পুলিশ। ’
‘কোন দেশের পুলিশ বাবা?’
দ্বিধায় পড়ে গেলাম। বললাম, ‘ভিন দেশের। সত্য মিথ্যার মাঝখান দিয়ে উত্তরটা দিলাম। ’
‘বাবা, এদেশের পুলিশ ভাল, ভিন দেশের পুলিশ খারাপ। আমার দেশের পুলিশ?’
‘নিরব থেকেছি। উত্তর দেয়নি। কি করে বলি যে, মা, ভিন দেশের পুলিশগুলোই হলো তোমার দেশের পুলিশ!’
দেশের বাইরে বেড়ে ওঠা আমার ছোট মেয়ের কচি হৃদয়ে দেশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা গড়ে উঠুক সেটা চাই কি করে!
mahalom72@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১২