পূর্বকথা
গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতির কারণে অবরুদ্ধকরণ পর্যন্ত সময়কালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি/পদোন্নয়ন অভিন্ন নীতিমালা-শীর্ষক বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চাউর হয়েছিলো। শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি/পদোন্নয়ন অভিন্ন নীতিমালা-শীর্ষক বিষয়টি তিন দশকের পুরনো বিষয় হলেও, এটি নতুন করে ফের আলোচনায় এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে ১৯৯৩ সালে। তারপর থেকে অনেকবার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু বারবার কে বা কারা নানা কারণ দেখিয়ে এই নীতিমালা প্রণয়নের কাজটি পিছিয়ে দেয়। কিন্তু সর্বশেষ ২২ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে বাবিমক তার ওয়েবসাইটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি/পদোন্নয়ন অভিন্ন নীতিমালা-শীর্ষক একটি দলিল সযুক্ত করে, যা এখনও সংযুক্ত রয়েছে। অনেকে এ নীতিমালা তৈরিতে আমলাদের নাক গলানো নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে বিষোদাগার করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা জনগণের উদ্বেগ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা নিয়ে জনগণের মধ্যে কৌতুহল রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ফৌজ, আমলা অথবা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে কৌতুহল রয়েছে। এ বিষয়ে কৌতুহল থাকা খুবই স্বাভাবিক। কারণ শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যাপারটি যদি অস্বচ্ছ হয় অথবা দোষযুক্ত হয়, তাহলে শুধু যে শিক্ষক সমাজই ভোগান্তির শিকার হবে তা নয়, বরং সারা জাতিই ভোগান্তির শিকার হবে। একজন শিক্ষক তার যোগ্যতা অনুযায়ী মর্যাদা, ক্ষমতা ও পারিতোষিক পাবে, সেটা তার অধিকার। কিন্তু শিক্ষক পদোন্নতির নীতিমালা এমন হওয়া উচিত নয় যে, সেই নীতিমালার ফাঁকফোকরে যে কেউ অধ্যাপক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে অথবা একজন যোগ্য শিক্ষককে টপকিয়ে যে কেউ অধ্যাপক মর্যদায় অধিষ্ঠিত হবে বা অধ্যাপক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে। কারণ একজন অধ্যাপক একটি প্রতিষ্ঠান, একটি জাতির পথপ্রদর্শক ও সর্বোপরি আলোকবর্তিকা বিশেষ। কিন্তু পদোন্নতির নীতিমালার শৈথল্যের কারণে যদি কেউ অধ্যাপক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তার জ্ঞানদীপ্তির মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন উঠে; তখন বুঝতে হবে একজন ফৌজ, একজন আমলা অথবা একজন খেটে খাওয়া সাধারণ নাগরিক শুধুমাত্র একজন অধ্যাপকের মর্যাদা, ক্ষমতা ও পারিতোষিক নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন তা নয়, বরং তিনি একটি জাতির বিবেককেই প্রশ্ন করছেন এবং একটি বিশৃঙ্খল উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলছেন।
স্বচ্ছ নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালায় সংযোজিতব্য শর্তসমূহ
সেজন্য নিয়োগ ও পদোন্নতি অভিন্ন নীতিমালায় নতুন শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও জাতীয় অধ্যাপক সম্মানে ভূষিতকরণে একটি স্বচ্ছ, নিয়মতান্ত্রিক ও নির্ভরযোগ্য প্রক্রিয়া চালু করা প্রয়োজন। এ প্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষক যেন তার নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী মর্যাদা, ক্ষমতা ও পারিতোষিক পায় এবং একইসাথে ভুল তথ্য দিয়ে অথবা নীতিমালাকে পাশ কাটিয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রাপ্ত একজন শিক্ষক তাঁর কৃত অনিয়ম অনুযায়ী পদোবনমন ও পদচ্যুতির মতো শাস্তি পায়। এরূপ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি/পদোন্নয়ন উপযোগী কিছু শর্তের তালিকা প্রস্তুত করেছি। এ শর্তগুলো হলো-নিম্নরূপ:
১. প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে
ক) বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (বাবিমক) কর্তৃক নিবন্ধন পরীক্ষা চালু করণ এবং নিবন্ধন পরীক্ষা পাস সাপেক্ষে প্রার্থীর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করণ।
খ) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যার সমসংখ্যক গবেষণা সহযোগী (Research Fellow) পদ সৃজন ও সেই পদে নিবন্ধিত প্রার্থীদের নিয়োজিতকরণ এবং প্রার্থীদের মধ্য থেকে প্রভাষক পদ খালি থাকা সাপেক্ষে যোগ্যতমদের পর্যায়ক্রমে প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ ও অযোগ্যদের পর্যায়ক্রমে অপসারণ।
গ) যে কোন বিদেশি ভাষায় দক্ষতা স্কেলে সর্বোচ্চমানের দক্ষতা (যেমন-TOEFL) বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে শর্তযুক্তকরণ। ইংরেজি, আরবি, ফারসি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এই নিয়ম এখন থেকেই চালু করণ।
২. প্রভাষক থেকে পর্যায়ক্রমে অধ্যাপক পদে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে
ক) পিএইচডি ও নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রকাশনা ও অভিজ্ঞতা থাকা শর্ত সাপেক্ষকরণ।
খ) প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রক্রিয়াটিতে চাকরি নিশ্চিতকরণে বাবিমকের অনুমোদনের নিয়ম চালু করণ।
৩. জাতীয় অধ্যাপক নিয়োগের ক্ষেত্রে
ক) সমস্ত শর্তপূরণ করে যারা অধ্যাপক হোন, তাদের মধ্যেও আবার যারা গবেষণা ও জ্ঞানচর্চায় এগিয়ে তাদেরকে নিয়ে একটি জাতীয় অধ্যাপক পুল তৈরীকরণ।
খ) জাতীয় অধ্যাপক পুলে ঠাঁই পাওয়া অধ্যাপকদেরকে দরখাস্তের সমান সুযোগ দিয়ে জ্ঞানের সব শাখায় প্রতিবছর জাতীয় অধ্যাপক নিয়োগের বিধান চালুকরণ।
৪. শিক্ষা প্রশাসক (বাবিমক অধিকর্তা, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ডীন ও কলেজ অধ্যক্ষ) নিয়োগের ক্ষেত্রে
ক) যোগ্যতম অধ্যাপকদের মধ্যে থেকে বাছাই করে একটি স্থায়ী প্যানেল তৈরীকরণ ও প্রতিবছর সেই তালিকাটি সংশোধন ও পরিমার্জন।
৫. পুরো প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে চালু রাখতে করণীয়
ক) বাবিমক কর্তৃক জার্নাল তালিকাভুক্ত করণ ও অনুমোদনের রেওয়াজ চালু করণ। বাবিমক কর্তৃক তালিকাকৃত বা অনুমোদিত নয় এমন জার্নালের প্রকাশনা নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ব্যবহার রহিত করণ।
খ) ক্লাশগুলো যথারীতি অনুষ্ঠিত হচ্ছে কি-না তা নিশ্চিতকরণে বাবিমকের প্রশাসনের আওতায় তদারকী ব্যবস্থার প্রবর্তন।
গ) যথারীতি ক্লাশ নেন না বলে যাদের বিরুদ্ধ অভিযোগ রয়েছে তাদেরকে জাতীয় অধ্যাপক ও শিক্ষা প্রশাসক (বাবিমক অধিকর্তা, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ডীন ও কলেজ অধ্যক্ষ) পুলে অন্তুর্ভুক্ত না করণ।
গ) ভুল তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতি লাভ করলেও, যাচাইয়ে ধরা পড়লে চাকরিচ্যুতির ব্যবস্থা চালু করণ।
[বি.দ্র.: কওমী মাদ্রাসার ডিগ্রিসমূহকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বিধায় এগুলোকে বাবিমকের আওতায় আনয়ন করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে। ]
শেষকথা
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (বাবিমক) উদ্যোগে প্রণিতব্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি/পদোন্নয়ন অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের যে কার্যক্রম চলছে, তার সাথে এ শর্তগুলো সংযোজন করা যেতে পারে। এগুলো সংযোজন করা হলে বিশ্ববিদ্যলয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক: অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: razaul_faquire@du.ac.bd