প্রায় প্রতিদিন। একটা লোকাল বাস হয়ে গোটা বাংলাদেশ।
ট্রাফিক সিগনালে আটকে থাকা বাসযাত্রীদের প্রথম ক্ষোভের শুরুটা হয় ট্রাফিক পুলিশকে ভর্ৎসনা দিয়ে। এরপর কথা কাটাকাটি, তর্ক-বিতর্ক আর বক্তৃতা কোথায় গিয়ে যে থামে ইয়ত্তা নেই।
একজন বলে, ঢাকার জ্যাম কোনদিন শেষ হবে না। কেউ নিয়ম মানে না।
আরেকজন বলে, কোটি কোটি টাকা নষ্ট করে ফ্লাইওভার বানিয়ে কোনও লাভ নেই। গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে।
আরেক জনের মত মাটির নিচে রাস্তা করলে সমস্যার সমাধান হতো।
আরেজন একটু উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে, মাটির নিচে রাস্তার দরকার নাই। সরকারের কবর করা দরকার। এর মধ্যে সিগনালের লালবাতি হলুদ হয়ে সবুজ হয়। চারটা গাড়ি ছেড়ে আবার ট্রাফিক পুলিশের প্রসারিত হাত এদিকেই।
এবার উত্তেজিত লোকাল বাসের সব যাত্রী।
এইটা কোনও কাজ হলো? কয়টা গাড়ি ছাড়লো? ওরে মারা দরকার না? এক সিগনাল এতোক্ষণ আটকে রাখে?
একজন বলে, মন্ত্রী এমপিরা যদি এভাবে আটকে থাকতো জ্যামে, তবেই বুঝতো মানুষের কষ্ট!
বাসের পেছনের আসন থেকে একজন জবাব দেয়, যারা দেশ চালায় তারা আটকে থাকে কী করে। তারা ভিআইপি না! পুলিশ সাইরেন বাজিয়ে তাদের পার করে দেয়।
রাস্তার ভোগান্তি নিয়ে আলোচনার ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে বাজারদর, জ্বালানি তেল আর সিএনজির দাম বাড়া নিয়ে।
একজন বলে, মাত্র আট মাসে তিনবার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। বিদ্যুতের মতো দ্রুততায় তাকে থামিয়ে দিয়ে আরেকজন বলে ওঠে:আট মাসে নয়- সাড়ে সাত মাসে।
আরেকজন বলে, এক ইয়াসমিন ধর্ষণের জন্যে খালেদা জিয়াকে প্রায় চুল ধরে টেনে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছিলো আওয়ামী লীগ। এখন পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিদিন ১০টা ধর্ষণের খবর থাকে। এখন যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকতো আর বিরোধী দলের নেতাকে তার বাড়ি থেকে বের করে দিতো তাহলে রাস্তায় কয়েক হাজার গাড়ি পোড়াতো আওয়ামী লীগ। আরেকজন বলে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই বিদেশে লোক পাঠানো বন্ধ হয়, শেয়ারবাজারে ধস নামে।
সামনে থেকে অন্য একজন বলে, আওয়ামী লীগ বিএনপি নিয়ে বাস গরম করার দরকার নাই। দেশের কথা বলেন।
বিএনপির খুব প্রশংসা করা আগের একজন এবার বলে, আমরাতো দেশের কথাই বলি। বিএনপি নিজের ক্ষতি নিজে করেছে। ক্লিনহার্ট অপারেশনের নামে সারা দেশের পরীক্ষিত নেতাদের হত্যা করিয়েছে। কোথাও এখন ভারসাম্য নেই। নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান গডফাদার। বিএনপির ডেভিড থাকতে একটা ব্যালেন্স ছিল। তাকে হত্যা করার পর তা নষ্ট হয়েছে। আমি বিএনপি-আওয়ামী লীগ না; তবে প্রশ্ন হচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপুমনি তিন বছরের নাকি আড়াই বছরই শুধু বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশের জন্য তিনি কী অর্জন করেছেন। দেশতো ইন্ডিয়ার কাছে চলেই গেছে।
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। ততক্ষণে এদিকের সিগনালমুক্ত হয়ে লোকালবাস এগোয় উত্তরের দিকে। একটু গিয়েই আবার মগবাজারে ট্রেনের সিগনাল।
বাসটা চলতে শুরু করায় আলোচনার গরম বাষ্প একটু ঠাণ্ডা হয়েছিল কেবল। থার্মোমিটারের পারদ আবার উর্ধ্বগামী।
লজ্জা নাই। কত অ্যাকসিডেন্ট হলো। কতবার মন্ত্রী বললো এখানে ওভারপাস হবে। একটা প্রতিশ্র“তিও রাখে নাই। একজন বলে। তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলায় অনেকজন। দূর থেকে মন্থরগতিতে ট্রেন আসছে আলো ফেলে। তীব্র শব্দ নিটকবর্তী। তার মধ্যে বাসের ভেতর অনেক উত্তেজিত, তিতিবিরক্ত কণ্ঠ। অনেকক্ষণ বাদুরঝোলা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলে, ভাই সবাই যদি, বলতে চান শুনবে কে? দয়া করে একজনকে স্পিকার নির্বাচন করুন। তার কাছে ফোর চান। তিনি অধিবেশনটা পরিচালনা করুন।
রাত তখন ১০টা পেরিয়ে গেছে। ট্রেন চলে গেছে। এখনি গতি পাবে লোকাল বাসটি। এসময়ে এমন রসিক মন্তব্যে অনেকে ঠা-ঠা করে হেসে উঠে। তারপর সব আলোচনা থেমে যায়।
তখন আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো এই ছোট আকৃতির লোকাল বাসটিই পুরো বাংলাদেশ। আমরা ১৫ কোটি যাত্রী।
মহাজোট সরকার তিন বছরের প্রান্তে এসে কতটা জনপ্রিয় জানতে চান? সরকারের কোন প্রতিনিধি, গোয়েন্দা সংস্থার কোন ব্যক্তি যদি এমন একটি বাসে উঠে পড়েন কখনো তাহলে আর কিছু না হোক সরকারের অবস্থাটা টের পাবেন। আমি ৩ জানুয়ারি রাতে ঘরফেরত মানুষভর্তি সেই লোকালবাসে আওয়ামী লীগের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ নয় নিচুস্বরে কথা বলারও একজন মানুষ পাইনি।
বংলাদেশ সময়: ১৯৪৪ ঘণ্টা, ০৪ জানুয়ারি, ২০১২