ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও পরীক্ষাগারের জৈবনিরাপত্তা স্তর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৫ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২০
কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও পরীক্ষাগারের জৈবনিরাপত্তা স্তর

সাম্প্রতিক করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত এই দুনিয়ায় টেস্টিং কিট ও দ্রুত রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দমালা হলো, পরীক্ষাগারের জৈবনিরাপত্তা স্তর। অণুজীবসমূহ (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইতাদি) নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে গবেষণা কর্মের ইপ্সিত সফল ফলাফলের চেয়েও নমুনা ব্যবস্থাপনা বেশি গুরুত্ববহ। যুগে যুগে সকল মহামারির পেছনে সবচেয়ে বেশি দায় ছিল অনিয়ন্ত্রিত অনুজীবের বিস্তরণ, হোক তা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত। 

তাই নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষণ ও পরীক্ষণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা যথাযথ ও নিরাপদভাবে (নমুনার অসংক্রমিতরূপে নির্গমন) সম্পাদিত হওয়ার জন্য পরীক্ষাগারের জৈবনিরাপত্তা সর্বাধিকতম বিবেচ্য বিষয়। একটি রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষা যেমন দ্রুততম সময়ে রোগীর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা শুরু করতে পারে ঠিক তেমনি সেই পরীক্ষণ যদি এমন কোন পরীক্ষাগারে সম্পাদিত হয়, যেখানে জৈবনিরাপত্তা স্তর যথেষ্ট নিরাপদ নয়, সেক্ষেত্রে পরবর্তী ফলাফল আরো বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আনতে পারে।

 

আমেরিকার জাতীয় স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট (NIH) এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC) থেকে প্রকাশিত পরীক্ষাগারে বায়োসেফটির ৫ম সংস্করণে বলা হয়েছে, বায়ো হ্যাজার্ড বা বিপজ্জনক জৈব বস্তুর (উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, সংক্রমণে সক্ষম অণুজীবের নমুনা যা মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে) ঝুঁকি নিরূপণের ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষাগারের গৃহীত সংবরণ পদক্ষেপ সমূহের নিবিড় মান নিয়ন্ত্রণ ঐ পরীক্ষাগারের জৈবনিরাপত্তা স্তরকে বিবৃত করে। উপরন্তু পরীক্ষাগারের জৈবনিরাপত্তা স্তর বিনির্মাণে যে কোন সীমাবদ্ধতা পরীক্ষণের ফলাফলের যথার্থতার ওপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে। যদিও সংবরণ পদক্ষেপ সমূহ বিভিন্ন দেশের বায়োসেফটি কমিটি তাদের দেশের উপযোগ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মোতাবেক নীতিমালা প্রণয়ন করার অধিকার রাখে।  

শুধু উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত পরীক্ষাগারকেই জৈব নিরাপদ বলা যাবে না, যদি না  তাতে আদর্শ অনুজৈবনিক ব্যবস্থাপনা না নেওয়া হয়। এই ব্যবস্থাপনায় নিরাপদ যন্ত্রপাতির সাথে সাথে গবেষণাগারের অবকাঠামো, গবেষণার নিমিত্তে নিয়োজিত গবেষকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, পরীক্ষণের আগে নমুনা সমূহের প্রস্তুতি, পরীক্ষণের সময় ও পরে যাতে পরীক্ষাগারে সতর্কতা অবলম্বন, পরীক্ষণ শেষে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নমুনার বর্জ্য অপসারণ এবং সকল স্তরে সুচারুরূপে পর্যবেক্ষণ করাকে বোঝায়।  

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৩ সালে তাদের বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বুলেটিনে বিপজ্জনক জৈব বস্তুর ঝুঁকি বিন্যাসের ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষাগারের জৈবনিরাপত্তা স্তরের শ্রেণিবিন্যাস করেছে। এই শ্রেণিভেদকে একটি ঊর্ধ্বমুখী পিরামিডের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যে সকল অণুজীব মানবদেহে কোনো প্রকার সংক্রমণ ঘটাতে পারে না কিংবা স্থানীয় সংক্রমণের কোনো আশঙ্কা নেই, সেক্ষেত্রে পরীক্ষাণের জন্য প্রাথমিক স্তরের নিরাপদ (BSL 1) পরীক্ষাগারই যথেষ্ট। অপরপক্ষে, যে সকল অণুজীব মানবদেহ বা প্রাণিদেহে সংক্রমণক্ষম কিন্তু সাধারণত পরীক্ষাগারের কোনো সদস্য বা স্থানীয় পর্যায়ে বা পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় আনে না, তথাপি পরীক্ষাগারের অনিরাপত্তা যে কোনো সময় সংক্রমণ ঘটাতে পারে সে নিমিত্তে পরীক্ষাগারে যে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে হয়, তা দ্বিতীয় স্তরের (BSL 2) জৈবনিরাপত্তাকে নির্দেশ করে। পাশাপাশি মানবদেহ ও প্রাণিদেহে মারাত্মক সংক্রমণক্ষম অণুজীব পরীক্ষণের জন্য তৃতীয় স্তরের (BSL 3) জৈবনিরাপত্তা আবশ্যক। আর সবচেয়ে বেশি সংক্রমণক্ষম অনুজীব যার সংক্রমণ প্রায় অপ্রতিরোধ যোগ্য এবং মানবদেহে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংক্রমণ হতে পারে, সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা (BSL 4) বিধান করতে হয়।  

অসংক্রমণক্ষম অণুজীব যেমন-  Escherichia coli অনায়াসে BSL 1 সুবিধা সমৃদ্ধ পরীক্ষাগারে পরীক্ষণ করা গেলেও এইচআইভি, জিকা ভাইরাস, ইবোলা এমনকি হালের নভেল করোনা ভাইরাস (SARS-CoV-2) পরীক্ষণের জন্য পরীক্ষাগারে BSL 3, ন্যূনতম হলেও BSL 2 সুবিধা নিশ্চিত থাকা একান্ত কাম্য। একটি BSL 2 পরীক্ষাগারে রিয়েল টাইম পি সি আর, ক্লাস টু বায়োলজিক্যাল সেফটি ক্যাবিনেট, ইত্যাদি যন্ত্রপাতির পাশাপাশি পরীক্ষাগারের কক্ষ সমূহের ডিজাইন, অটোক্লেভ ব্যবস্থা যাতে নমুনাকে পরীক্ষণ শেষে অসংক্রমিতরূপে পরিণত করা, পরীক্ষণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (PPE) নিশ্চিত করা, চিকিৎসা বর্জ্যের নিরাপদ ব্যবস্থাপনা ও সমধিক প্রণিধানযোগ্য। এই সকল সুবিধাদির সাথে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকার, নির্দেশিত পথে নিয়ন্ত্রিত বায়ু প্রবাহ নিশ্চিত করলে পরীক্ষাগারটি BSL 3 যোগ্যতা অর্জন করে যেখানে প্রাণঘাতী ভাইরাসের পরীক্ষণ করা যাবে।  

গত ৩১ মার্চ, ২০২০ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (CDC) হতে প্রকাশিত “করোনা ভাইরাসের নমুনা প্রস্তুতি, পরীক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা”য় নমুনা পরীক্ষণের জন্য BSL 2 পরীক্ষাগার, পরিবেশগত নমুনা পরীক্ষণের জন্য একমুখী বায়ূপ্রবাহসহ BSL 2 সুবিধা ও BSL 3 এর সাবধানতা অবলম্বন করতে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ভাইরাসের সেল কালচার ও বৈশিষ্ট্য উন্মোচন গবেষণার ক্ষেত্রে পরীক্ষাগারে ন্যূনতম BSL 3 সুবিধা থাকা বাধ্যতামূলক।

এছাড়া ইউরোপিয়ান রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (ECDC) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে নভেল করোনা ভাইরাসের পরীক্ষণের জন্য BSL 2 সুবিধাকেই আদর্শ ধরেছে। ইতোমধ্যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রণীত ‘জাতীয় প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা’ নীতিমালায় পরীক্ষাগারে পরীক্ষণ ও নমুনা ব্যবস্থাপনা অনুচ্ছেদেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সুপারিশ সমূহকে আত্তীকরণ করা হয়েছে। সেই নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, দেশে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (IEDCR) এর BSL 2 সুবিধা সমৃদ্ধ পরীক্ষাগারটিই হলো করোনা ভাইরাস তথা কোভিড-১৯ পরীক্ষণের জন্য জাতীয় প্রমাণ পরীক্ষাগার। দেশে BSL 2 বা এরকম সুবিধা সমৃদ্ধ পরীক্ষাগার অত্যন্ত অপ্রতুল।  

আইইডিসিআরের পাশাপাশি আরও কিছু পরীক্ষাগারে কোভিড-১৯ পরীক্ষণ শুরু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় ১৭টি স্থানে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল এবং বিভিন্ন গবেষণাগারে রিয়েল টাইম পিসিআর আর বায়োলজিক্যাল সেফটি ক্যাবিনেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে যাতে স্থানীয় পর্যায়ে দ্রুত পরীক্ষণ করা যায়।

সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে সেই পরীক্ষাগার সমূহের BSL 2 জৈবনিরাপত্তা স্তর সুনিশ্চিত করা। বিপজ্জনক জৈববস্তুর নিরাপদ নির্গমন ব্যবস্থা অন্যান্য মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো নয়। কারণ পুরো প্রক্রিয়ায় যে কোনো ধাপে একটু অসাবধানতা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ ঘটাতে পারে।  

তদুপরি পরীক্ষাগারের কক্ষের যথাযথ ডিজাইন, কক্ষে পরীক্ষণের জন্য সকল যন্ত্রপাতির প্রাপ্যাতা ও কক্ষের সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তার বিধানে ন্যূনতম ঘাটতি থাকলে পরীক্ষার সঠিক ফলাফলে সীমাবদ্ধতা আসার পাশাপাশি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।  

তাই বলা যায়, সকল ধাপে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া শুধু রিয়েল টাইম পিসিআর আর টেস্টিং কিট দিয়ে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে কোভীড-১৯ পরীক্ষা করতে গিয়ে যদি নমুনা ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না করা যায় কিংবা নিবিড় পর্যবেক্ষণ না করা হয়, তবে তা শেষতক পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। তাই যেখানে কোভিড-১৯ পরীক্ষণ করার কথা ভাবা হচ্ছে সেখানে উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতির সাথে সাথে পরীক্ষাগারের জৈবনিরাপত্তা স্তর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।  

সবিশেষ এটা আমাদের মনে রাখতে হবে যে রোগীর নমুনার দ্রুত পরীক্ষণ এবং অনেক বেশি পরিমাণে নমুনা পরীক্ষণ যেমন জরুরি ঠিক তেমনি পরীক্ষাগারের জৈবনিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জিন প্রকৌশল ও জীব প্রযুক্তি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Email: mmhasansohag@geb.jnu.ac.bd

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।