ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

করোনাকালের বাজেট: কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫২ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০২০
করোনাকালের বাজেট: কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ

এটা ধার‍াবাহিক লেখার দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, নব্য উদারতাবাদ বা কল্যাণ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও উত্থানের পটভূমি সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগের আলচনার পূর্বে সম্প্রতি আলোচিত ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ ধারনাটি কিছুটা আলোচনা করা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামো বোঝার জন্য অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় ‘স্বজনতোষণ পুঁজিবাদ’ বা ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ ধারনাটি প্রযোজ্য বলে মনে হয়।

‘স্বজনতোষণ পুঁজিবাদ’ এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে ব্যবসাগুলি তাদের সুবিনিয়োগের কারণে বা সাফল্যের সাথে অধিক ঝুঁকির ফলস্বরূপ বিকশিত হয় না, বরং ব্যবসায়িক শ্রেণি এবং রাজনৈতিক শ্রেণির মধ্যে আঁতাতের মাধ্যমে অধিকহারে লাভবান হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক শ্রেণিই আবার রাজনৈতিক শক্তিতে পরিনত হয়ে “স্বার্থের সংঘাত” উপেক্ষা করে ব্যবসায় অন্যায্য সুবিধা গ্রহণ করে থাকে।  

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পরিবারতন্ত্র, আত্মীয় ও দলতোষণ এবং সামরিক বাহিনী ও সিভিল প্রশাসনকে ব্যাপক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য এই ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ ধারনাটি উন্নয়ন তাত্ত্বিকেরা বিশেষভাবে ব্যবহার করেছেন। ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম” -এর এই ধারনা আমাদের পরবর্তী আলোচনায় সহায়ক হবে।  

ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমস্যা মোকাবিলা করা দুরূহ কারণ, আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টন কঠিন কাজ এবং রাজনৈতিক নীতি পরিবর্তন ছাড়া তা অর্জন করা যায় না। সমাজের শক্তিধর ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর কায়েমি স্বার্থ আয় পুনর্বণ্টন নীতিমালাকে ভন্ডুল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে। নব্য উদারতাবাদী দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী হয়েও শক্তিশালী বৈষম্য-নিরসন নীতিমালা গ্রহণ করে চলেছে। ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় নীতি অনেক বেশি আয় পুনর্বণ্টনমূলক, যেখানে অত্যন্ত প্রগতিশীল আয়কর এবং সম্পদ করের মতো প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে জিডিপির ৩০-৩৫ শতাংশ সরকারি রাজস্ব হিসেবে সংগ্রহ করে ওই রাজস্ব শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা (প্রধানত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পেনশন, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন), পরিবেশ উন্নয়ন, নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা, গণপরিবহন, বেকার ভাতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়।  

২০১৫ সালে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল বাংলাদেশের একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হওয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ নির্দেশ করে। এটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে মনে করা যেতে পারে এবং দেশের সংবিধানে এর অন্তর্নিহিত নির্দেশনাও রয়েছে। যেমন দারিদ্র্য হ্রাস বিষয়টি সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য দিতে ন্যূনতম কী কী প্রয়োজন তার মান নির্ধারণ করা কঠিন। তবে যেগুলো গুরত্ব পেতে পারে তাঁর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে “অন্তর্ভুক্তি”। “অন্তর্ভুক্তি” বলতে বোঝনো হচ্ছে জীবন চক্র অনুযায়ী সমাজের সকল সদস্যকে সুরক্ষিত করার ক্ষমতা যাতে সর্বাধিক ঝুঁকির মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বিবেচনা থাকবে এবং যার দরকার এমন কেউই এর আওতাবহির্ভুত থাকবেনা। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা সহায়তা, যেকোনো ধরনের বৈষম্য বা বাধা ছাড়াই তা বিতরণ করা এবং অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং সক্ষম জনগণের অবদানমূলক সামাজিক বীমা এবং শ্রমবাজারের কর্মসূচির আওতাভুক্ত থাকা।  

একটি কল্যাণ রাষ্ট্র জন্ম থেকে সমাধি পর্যন্ত সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে থাকে। দ্বিতীয় গুরত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে “পর্যাপ্ততা”; সহায়তাগুলি জনগণের সামাজিক সুরক্ষার চাহিদা মেটাতে নিয়মিত, অনুমানযোগ্য এবং পর্যাপ্ত কিনা। সহায়তাগুলির পরিমান দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য পর্যাপ্ত কিনা, তা দিয়ে উৎদনশীল অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হওয়া সম্ভব কিনা, জীবন চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা ব্যক্তিদের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারছে কিনা এবং সর্বোপরি সহায়তাগুলির, যা একে অপরের পরিপূরক এবং আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে, সম্মিলিত প্রভাব তার জিবনযাত্রার মানকে পরবর্তী ধাপে নিতে কিছুটা হলেও সহায়তা করছে কিনা। তদ্ব্যতীত, সামাজিক সুরক্ষা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক খাত যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানগুলির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সামাজিক সহায়তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে হবে। দুর্যোগ ও শক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ জনসংখ্যা জরুরি সহায়তাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অধিকার ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল নীতি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন যে, লোকেরা তাদের অধিকার সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত এবং তাঁর ব্যাত্যয়ের বিষয়ে অভিযোগ করার এবং আপিলের ব্যবস্থা রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার ব্যয়গুলি সরকারের নিজস্ব উৎস থেকে সম্পূর্ণ অর্থায়ন করার সক্ষমতা থাকতে হবে।

নব্য উদারতাবাদ ও উন্নয়নয়নের জন্য প্রবৃদ্ধি থেকে বিভিন্ন দেশের কল্যান রাষ্ট্রের দিকে পথচলা: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় ও এর ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটি দ্বারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিমালার ভিত্তি প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। ’ এই প্রস্তাবনার সঙ্গে সংগতি রেখে সংবিধানের ৮(১) ধারায় বলা হয়েছে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের জন্য ‘সমাজতন্ত্র’ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বলে পরিগণিত হবে। সমাজতন্ত্রের প্রায়োগিক নির্দেশনা দিয়ে সংবিধানের ১৮(২) ধারায় বর্ণিত হয়েছে, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। ’

সংবিধানের উদ্ধৃতিগুলো থেকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিমালায় মানবকেন্দ্রিক, জনকল্যাণমূলক উন্নয়নের দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে যা বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলি ধারন করে (পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা সহ অন্যান্য)। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ কর্তৃক বর্তমানে প্রনয়নাধীন অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ধারনাপত্রের (যা ২০১৯ সালে প্রনীত)  দুটি মূল বিষয় হ'ল "অর্জিত সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নেওয়া এবং “অন্তর্ভুক্তি”অর্জনে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া"। সেখানে দারিদ্র বিমোচন ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত দেশের মর্যাদায় পৌছানোর লক্ষ্যে বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হারকে ১০% স্তরে উন্নীত করা এবং এই বৃদ্ধির সুবিধা কীভাবে আরও বেশি পরিমাণে জনগণের সাথে ভাগ করা যায় তার দিকে সর্বাধিক মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং তার সুফলতা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পর্যন্ত পৌছে দেওয়ার মাধ্যমেই দারিদ্র্য হ্রাসের দ্রুত গতি নিশ্চিত করতে হবে এবং তা বৈষম্য নিরসনে গতি সঞ্চার করবে বলে আশা করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আয়ের বৈষম্য হ্রাস করা সহজ চ্যালেঞ্জ নয় তবে সরকার এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রচেষ্টা করতে বদ্ধপরিকর। তবে সমৃদ্ধি ও অন্তর্ভুক্তির সাথে আরও অন্যান্য বিষয়গুলিও জড়িত যেমন জীবন মানের উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার, সুযোগের সাম্যতা এবং বৈষম্যের সকল রূপের নির্মূল করা। এগুলি দীর্ঘমেয়াদী চলমান লক্ষ্যমাত্রা যার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংস্কার, সংসদীয় গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়ে নীতিমালা, কর্মসূচী গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি জোরদার করার নিমিত্ত অষ্টম পরিকল্পনার সময়কালে জোর প্রচেষ্টা করা হবে মর্মে অঙ্গীকার করা হয়েছে।  
বর্তমানে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত ও বাংলাদেশসহ বিশ্বর সকল দেশ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠও এই মৌলিক বিষয়গুলো ধারণ করে। কভিড-১৯ এর ধাক্কায় যদি দেশের মানুষের ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে এই অন্তর্নিহিত মানব কল্যান বা মানবতার নীতি জাগ্রত হয়, তাহলে কল্যান রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য আসতে পারে।  আয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ এবং সংশ্নিষ্ট অন্যান্য বিষয় অবশ্যই মানবকেন্দ্রিক জনকল্যাণধর্মী উন্নয়নে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় থাকবে। তবে কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে এগুলোর বিন্যাস করতে হবে। যেমন- শুধু সংখ্যা বা অনুপাত নয় বরং মূলত ব্যক্তিমানুষের গুরুত্ব; সবার ন্যায্যভিত্তিক অন্তর্ভুক্তি; যাদের ঘাটতি রয়েছে তাদের সবার মানবাধিকার ও মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা; সবার জন্য আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ; মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও ইউনিভার্সাল স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সক্ষমতা সৃষ্টি বা বৃদ্ধি, উপযুক্ত অর্থায়নে তাদের অভিগম্যতা নিশ্চিতকরণ; সামাজিক সাম্য; দারিদ্রপীড়িত বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী যেমন, প্রতিবন্ধী, দলিতের বিশেষ বিশেষ চাহিদা মেটানো; পরিবার থেকে বিভিন্ন স্তরে সামাজিক পুঁজি গঠন; জনমুখী ও সেবাধর্মী জনপ্রশাসন; জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা ও পরিবেশ সংরক্ষণ।

প্রতিটি দেশের কল্যাণব্যবস্থাই সে দেশের আর্থসামাজিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং সে দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক সমস্যার নিরিখে বিকশিত হয়। আমাদের উঠতি অর্থনীতি; তাই আমাদের সামাজিক সমস্যা ও তাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব ও প্রাধিকার এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকেই রাষ্ট্রীয় পুনর্বণ্টন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের কথা ভাবতে হবে। জাতিসংঘ গৃহীত সাম্য-মানবস্বাধীনতা-মানবাধিকার-মানবমর্যাদা ভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ বাস্তবায়নের জন্য এজেন্ডা-২০৩০ (টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচি নামে পরিচিত) নব্য উদারতাবাদ কাঠামোয়ই বাস্তবায়ন করার কথা যা এর দূর্বলতাগুলোকে এর ভিতরে থেকেই দূর করার একটা প্রচেষ্টা কারন প্রচলিত ব্যবস্থা বৈষম্য অভূতপূর্বভাবে বাড়িয়ে চলেছে, অন্যদিকে টেকসই উন্নয়নে বৈষম্য দূর করা একটি মৌলিক বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল সেই ধারণা নব্য উদারতাবাদের প্রভাবে পরবর্তী সময়ে দুর্বল হতে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সেই জনকল্যাণ-অভীষ্ট পথপরিক্রমা-মডেল প্রতিষ্ঠাই হয়নি।

প্রচলিত উদার বাজার ব্যবস্থায় বাংলাদেশ বিগত এক দশকে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। প্রকট ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও বেশকিছু সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে বিশ্বপরিমণ্ডলে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দারিদ্র্যের হার যথেষ্ট কমে এলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র অথবা স্বল্প আয়ে জীবন ধারণ করতে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে করেনাভাইরাস দেশের অধিকাংশ মানুষের অর্থনৈতিক নাজুকতাকে সামনে নিয়ে এসেছে এবং একই সঙ্গে দিন বদলের সুযোগও উন্মোচন করেছে ।  

করোনা মহামারির পরবর্তীকালে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও পুনর্জাগরণ মানবকেন্দ্রিক হবে, মানবাধিকার ও মানব মর্যাদা সামনে আসবে এটা আশা করা যেতেই পারে। বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ও বিপর্যস্ত প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে সাম্যভিত্তিক জীবন যাপনে সব মানুষের ব্যক্তিগত জীবনমান ও দেশের সামষ্টিক সন্তুষ্টি অনেক উঁচু পর্যায়ের হওয়া উচিত। কল্যাণধর্মী আবহে এরকম ঘটবে বলে যথেষ্ট জোর দিয়ে বলা যেতে পারে। মানবকেন্দ্রিক কল্যাণধর্মী উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে, ত্বরান্বিতও হবে; তবে তা হবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সবার কার্যকর অংশগ্রহণ এবং অর্জিত সুফলের ন্যায্য বণ্টন সাপেক্ষে। কভিড-১৯ উত্তরকালে মানবকেন্দ্রিক কল্যাণধর্মী উন্নয়নের পথ রচনা ও অনুসরণ করার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অন্যথায়, বর্তমানে প্রচলিত বৈষম্যবর্ধক, অস্থিরতাময় উন্নয়ন ধারা চলতে থাকবে, দেশের উন্নয়নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন এবং টেকসই উন্নয়ন অধরা থেকে যাবে এবং রাষ্ট্র ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম” এর ধারার দিকে ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায়না। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কার্যকর অঙ্গীকার করেছেন এবং ব্যাবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছেন যাতে সকলের এগিয়ে আসতে হবে।  

পড়ুন প্রথম পর্ব: করোনাকালের বাজেট: কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ

তৃতীয় পর্ব: করোনাকালের বাজেট: কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ

(তৃতীয় বা শেষ পর্বে বাংলাদেশের কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে পথচলার বিশ্লেষণে বাংলাদেশের সামাজিক সুরক্ষা খাত এবং স্বাস্থ্য খাত এর সংক্ষিপ্ত আলোচনাপূর্বক আশংকা ও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে)

লেখক: উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদ; বর্তমানে লিয়েনে ইউএনডিপিতে কর্মরত

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।