বিবাদে-বিগ্রহে-যুদ্ধে প্রতিপক্ষরা পরস্পরের বিরুদ্ধে নামে সংঘাতে-আক্রমনে-আগ্রাসনে। বিজয়ী ও বিজিত পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ক্রস ফায়ারে পড়া বেশ কিছু নিরীহ জানমালও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
রাজনীতিও এক ধরনের নিরব অথচ প্রলয়ংকরী যুদ্ধ। প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে নিজের বা দলের আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি হতে পারে নোংরা ও কর্দমযুক্ত। উন্নত গণতন্ত্রে রাজনৈতিক যুদ্ধ-বিগ্রহে-দলাদলিতে কিছুটা শিষ্টাচার ও এটিকেট থাকে। সব দল ও প্রতিপক্ষ জনগণকে যথাসম্ভব সম্মান দিয়ে চলেন। সেই তুলনায় বাংলাদেশের রাজনীতি খুবই নোংরা ও হীন। এই রাজনীতিতে জনগণ দাবার ঘুটি মাত্র। রাজপথের ’আন্দোলনে-ভাংচুরে জনগণ আর রাষ্ট্রীয় সম্পদ নগণ্য কোলেট্যারাল ড্যামেজ মাত্র। হরতালে-রাজপথে রাজনীতিবিদেরা পুলিশের ওপর চড়াও হবার পর নেতারা আহত হলে রাজনীতির ময়দানে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের উস্কানিতে, প্ররোচনায় সৃষ্ট সংঘাতে, সন্ত্রাসে, জ্বালাও পোড়াওতে নিহত-আহত-ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো বিবেচনায় নেয়া হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণ কেবলই নাম-গন্ধহীন অনুল্লেখ্য কোলেট্যারাল ড্যামেজ মাত্র। অথচ কোলেট্যারাল ড্যামেজে নিহত-আহত-ক্ষতিগ্রস্তরা কারো বাবা-মা-ভাই-বোন-সন্তান। তাদের ক্ষতির আগুনে পোড়ে পরিবার পরিজন। রোজগারের সচল চাকা অচল হলে ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে পরিবারের। রাজনীতিবিদেরা এই ফ্যাকটর যদি বিবেচনায় নিতেন তাহলে আরো পরিমার্জিত হতো রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন। হয় না বলেই রাজনৈতিক কোলেট্যারাল ড্যামেজের শিকার হয়ে ঝরে পড়ে নেতা-কর্মী ও জনগণের প্রাণ, ক্যারিয়র, স্বপ্ন।
এইসব ‘অতি সামান্য’ বিষয়াদি বিবেচনায় আনেন না আমাদের দুই জাতীয় নেত্রী। নিজেদের স্বার্থের বাইরে দুই নেত্রীর চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা কাজ করে এমন প্রমাণ মেলে না। নিজেদের ক্ষমতাসীন দেখার স্বপ্নে-স্বার্থে দুই নেত্রী যেকোনো নেতা-কর্মীকে কোলেট্যারাল ড্যামজে বানাতে দ্বিধান্বিত হন না। সামান্য রাজনৈতিক হুমকিকেও তারা বরদাশত করতে পারেন না। অথচ গণতন্ত্র চর্চ্চায় আত্ম ও দলীয় সমালোচনা অতীব জরুরি এক কার্যক্রম ও পদক্ষেপ।
‘রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি প্রিয় সাবজেক্ট। তিনি দল ও জনগণের মতামতকে তোয়াক্কা করেন এমন প্রমাণ মন্ত্রিসভা গঠনে, দলীয় কার্যনির্বাহী ‘নির্বাচনে’, সাংসদ মনোনয়নে দৃশ্যমান হয় না। ধর্মনিরপেক্ষতা ও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্হা বাতিলের সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগে আমরা শেখ হাসিনার একগুঁয়েমিই দেখি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত বিভক্তি শেখ হাসিনার ‘গোঁয়ার্তূমির’ তাড়াহুড়ায় ভুল জন্ম দেওয়া জনবিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্তে পরিণত হয়। দেশ ও সরকার কিভাবে চালাবেন তার একক মালিকানা আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী শেখ হাসিনার। নির্বাচনে-উপ নির্বাচনে কাকে কোন বিচারে মনোনয়ন দেওয়া হবে এই সিদ্ধান্ত দল নেবেন। এতে কোনো দ্বিধা দোদুল্যমানতা কাজ করা উচিত নয়। তবে সিদ্ধান্তের দায়-দায়িত্ব দলকেই নিতে হবে।
কিন্তু সাম্প্রতিক দু’টো নির্বাচনের মনোনয়ন ও ফলাফলে আমরা কী দেখতে পেলাম? নারায়ণগঞ্জে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছিলো সন্ত্রাসের গড ফাদার শামীম ওসমানকে। রাজনৈতিক ওসমান পরিবারের ভাইয়েরা ক্ষমতা নিরংকুশ করতে, এলাকার প্রতিপত্তি নিজেদের পরিবারের করতলগত রাখতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাতার নীচে আশ্রয় নিয়েছেন। এক ভাই যখন বিরোধী দলের শক্তি, অন্য ভাই তখন সরকারি দলের কাণ্ডারী। পুরো বাংলাদেশ জুড়ে এরকম শ’ খানেক রাজনৈতিক পরিবারের দাপট। এরা মিলে মিশে, আলাপ-আলোচনায় ব্যক্তি রাজনীতিকেই নিশ্চিত করেন। দলীয় রাজনীতির বিকাশ এদের কাম্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ’রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্টে’ নারায়ণগঞ্জে মনোনয়ন পেয়েছিলেন শামীম ওসমান। তিনি বিভিন্ন সূত্রে অবগত ছিলেন শামীমের চেয়ে আইভীই যোগ্য প্রার্থী এবং আইভীর বিজয় প্রায় সুনিশ্চিত। কিন্তু আইভীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্টের কারণে। আইভীর বিজয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক এক্সপেরিমেন্টের ’কোলেট্যারাল ড্যামজে’ হয়েছেন শামীম ওসমান। তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনী ব্যবস্হা বাতিলে এবং দলীয় সরকারের অধীনে সেনাবাহিনী মোতায়ন ভিন্নও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এই ’রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সত্যতা’ প্রমাণে ‘আওয়ামী বলী’ হয়েছেন শামীম ওসমান। দলীয় সরকারের অধীনে ইভিএম পদ্ধতিতে সেনাবাহিনী মোতায়ন ছাড়া নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের অনায়াস জয় সম্ভব এই সত্য প্রমাণের এক্সপেরিমেন্টের কোলেট্যারাল ড্যামেজ হলেন কুমিল্লার আওয়ামী মেয়রপ্রার্থী অধ্যক্ষ আফজাল খান।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে নির্বাচনের আগেই জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব চয়েস ছিলেন বিজয়ী আইভী। তিনি আইভীকে দিয়েছিলেন নৈতিক সমর্থন। তাছাড়া বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য উপাত্তে প্রধানমন্ত্রী জানতেন আইভীই জিতবেন। কুমিল্লার নির্বাচনের মনোনয়নের আগে প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানতেন সদরের সাংসদ বাহার বনাম চিফ হুইপ সহ ছয় সাংসদের রাজনৈতিক শত্রুতা। জানতেন বাহারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া আফজল খানের বিজয় এক কথায় অসম্ভব। তবু বাহারকে দলীয় নির্দেশনার কাঠামোর মধ্যে আনার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কারণ এক্সপেরিমেন্ট-প্রবণ শেখ হাসিনার ক্ষমতার পুনর্যাত্রায় দলীয় সরকারের অধীনে সেনাবাহিনীহীন ইভিএম পদ্ধতির নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রমাণ করা ছিলো জরুরি। শেক হাসিনার এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছে। আর বিপাকে পড়েছেন ইস্যুবিহীন বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া। বিএনপি’র ক্ষমতায় যাবার আন্দোলন মুহূর্তের জন্যে হলেও থমকে দাঁড়িয়েছে।
আগামীর কোলেট্যারাল ড্যামেজ কারা হবেন সেটা দেখার প্রতীক্ষায়। কিন্তু নেতা-কর্মীরা কী আওয়ামী নেতৃত্বের ওপর আস্হা হারাচ্ছেন না? তবে জনগণের সৌভাগ্য যে, এখন তাদের ছিন্নমূল জীবনের বদলে দলীয় নেতা-কর্মীরা এসেছেন কোলেট্যারাল ড্যামেজের আওতায়।
ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৪ ঘণ্টা, ০৭ জানুয়ারি, ২০১২