‘দীনেশ দাস আর নেই। ’ সকালে চার শব্দের এই বাক্যটি বলেই একসময়ের সাংবাদিক, আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান ফোন রেখে দিলেন।
আমার বহুদিনের বন্ধু, সহ-সংগ্রামী, পেশাদার সাংবাদিক ও সদালাপী দীনেশ এর অকালমৃত্যুর শোক সামলাতে পারছিলাম না। বেরিয়ে পড়লাম ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে দীনেশ দাস এর মরদেহের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু ঘাতক বাস তাকে চাপা দিয়ে মাথা ও মুখমন্ডলের এমনভাবে থেঁতলে দিয়েছে, তা আর দেখার উপায় নেই। কফিনের ভিতরে শেষশয্যায় শায়িত দীনেশ এর মরদেহের বুক থেকে পা পর্যন্ত যারা দেখেছেন, তারা অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। প্যান্ট, কোর্ট জুতো পরা আমাদের বহুদিনের বন্ধু দীনেশ চিত হয়ে নিথর, প্রাণটি নেই কেবল দেহে। ততোক্ষণে রামপুরার বাসা থেকে দীনেশ এর সহধর্মিনী পলি সরকার ও ভিকারুননিসা নুন স্কুল থেকে বছর দশেক বয়সী কন্যা অথৈ দাসকে ডিআরইউ’তে নিয়ে আসা হয়েছে। বাইরে শায়িত দীনেশের মরদেহ আর ডিআরইউ ক্যান্টিনে বসা স্ত্রী ও কন্যার আকাশবিদারী আহাজারিতে সকালের বাতাস ভারি করে ফেলল।
এক প্রিয় সহকর্মীর অকালপ্রয়াণে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকবৃন্দ জাতীয় প্রেসক্লাবে সড়ক অবরোধ করে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। প্রতিবাদী স্লোগানে স্লোগানে বিদীর্ণ হয়েছে আকাশ-বাতাস। মাত্র কয়েকদিন আগে সড়ক দূর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়ে সাংবাদিক নিখিল ভদ্র মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। ওই দূর্ঘটনার ক্ষত না শুকাতেই দীনেশ এর এই মৃত্যু সকলের সামনে একটি প্রশ্ন মোটা দাগে তুলে ধরেছে এদেশের সড়কে কি স্বাভাবিক মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নেই?
দীনেশ এর সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় ২ জানুয়ারি, সোমবার। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় গুলশানে আমার অফিসের কাছাকাছি এসে ফোন করেন। আমি তখন প্রেসক্লাবে। বললেন, আমার সঙ্গে তাঁর কিছু জরুরি কথা আছে। আমাকে না পেয়ে মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদের দু’কপি স্মরণিকা রেখে গেলেন। দুই একদিনের মধ্যে আবার আসবেন বলে বললেন। কিন্তু দীনেশ আসার পথ রুদ্ধ। ঘাতক বাস তাকে না ফেরার দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।
জরুরি কথা থাকার কারণ তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব দুই দশকের বেশি। লড়াইয়ে সংগ্রামে, সুখ-দুঃখে আমরা একে ওপরের সহমর্মী। ১৯৯২ সালে আমরা একঝাঁক সাংবাদিক যখন দৈনিক জনকন্ঠে যোগ দিই, দীনেশ তখন ছোট কোন কাগজে কাজ করতেন। কিন্তু আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। রিপোর্ট তৈরির কৌশল নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হতো। ১৯৮২ সালে সাপ্তাহিক একতা ও রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তা দিয়ে তিনি সাংবাদিকতা শুরু করলেও দীর্ঘ কর্মজীবনে তাকে ভাল চাকরির জন্য বেশ লড়াই করে যেতে হয়েছে। ১৯৯৫ সালে সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন এর মৃত্যুর পর দীনেশ ‘চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদ’ গঠন করে কৃতি মফস্বল সাংবাদিকদের পুরস্কার দেয়া শুরু করেন। এতে সাংবাদিকের পাশাপাশি সংগঠক হিসেবেও তার পরিচিতি গড়ে ওঠে। এই স্মৃতি সংসদের একজন সদস্য হিসেবে সব সময় আমাকে কমিটিতে রেখে এসেছেন।
পরে নাঈমুল ইসলাম খান ‘দৈনিক আমাদের সময়’ বের করলে দীনেশ দাস সেখানে যোগদান করেন। ডান ও বামপন্থি রাজনৈতিক দল মিলিয়ে অর্ধশতাধিক বিট তিনি একাই কভার করতেন। পল্টন এলাকায় রাজনৈতিক দলের সভা সেমিনার কভার করে ছুটে যেতেন একুশের বইমেলা কিবা অন্য কোন সংগঠনের অনুষ্ঠান কভার করতে। এই পত্রিকায় যোগ দিয়ে তিনি পেশাগত দিক থেকে থিতু হন। অবশ্য পত্রিকাটির মালিকানা বদল হওয়ার পর পয়লা নবেম্বর থেকে তিনি আবার চাকরিচ্যূত হওয়ার পর মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদের কাজের পাশাপাশি তিনি চাকরিও খুজছিলেন।
ডিসেম্বরের শুরুতে দীনেশ আমার অফিসে এসে চাকরি হারানোর খবরটি দিয়ে বললেন, আগামী ২৯ ডিসেম্বর মোনাজাতউদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তার নামে পরিচালিত স্মৃতি পুরস্কারের দু’বছরের বিজয়ীকে এবার পুরস্কার দেওয়া হবে। এ আয়োজনে বেশ বড় খরচ। স্মৃতি সংসদের অনুষ্ঠানটা হয়ে যাওয়ার পর তিনি চাকরি খোঁজাখুঁজি করতে বের হবেন। তিনি দুয়েকটি বিজ্ঞাপন সংগ্রহের ভার আমার ওপর দিলেন। কয়েকজনকে ফোন করে অনুরোধ করলাম। লাঞ্চের অর্ডার দিলাম তার জন্য। খাওয়ার সময় দেখলাম, তার হাতে মোটর সাইকেলের চাবি। বললাম, দাদা মোটর বাইক চালান নাকি? বললেন, ট্রেনিংটা আগে থেকেই ছিল। অফিস থেকে ঋণে বাইক পাওয়ার পর এটাই আমার সঙ্গী। বললাম, এই যন্ত্রে আমার খুব ভয়। কারণএটা এতোটা
আনপ্রেডিক্টেবল যে অন্যকেও চাপা দিতে পারে, চালক হিসেবে নিজেরও চাপা পড়ার আশঙ্কা থাকে। খুব কনফিডেন্সসহ দীনেশ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভরসা ভগবান ।
মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি সংসদের অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করলেন। ফোন রিসিভ করে দেখি কথা না বলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে গান ভাঁজছেন। বললাম, খবর কী দীনেশ দা? বললেন, মনটা খুব ভাল। স্মৃতি সংসদের দুটি পুরস্কারের অর্থের সংস্থান হয়েছে। এ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় বিজ্ঞাপনও সবগুলো পেয়েছেন। অনুষ্ঠানের ভেন্যু, গেস্ট- সব ঠিক। এখন শুধু ২৯ ডিসেম্বর দিনটি ভালয় ভালয় পার করে দেয়া। বললাম, ভাল হলেই ভাল। শেষমেষ অনুষ্ঠানটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এরপর কিছুদিন ধরে তিনি চাকরির জন্য বিভিন্ন অফিসে কথাবার্তা বলছিলেন। বেঁচে থাকলে হয়তো খুব শীঘ্রই তার বেকারত্ব ঘুঁচতো।
এরই মধ্যে একদিন এসে অনুযোগ করলেন, আপনার জন্য আমার আজ ভাল করে নাস্তা খাওয়া হয়নি। বললাম, কেন? খবর দিলেন, তার স্ত্রী পলি আমার ‘বাতাস বালিকা’ বইটি একনাগাড়ে দুইদিন ধ’রে পড়ছে। রান্না ঘরে যাওয়ার দিকে তার খেয়াল নেই। এ নিয়ে বেশ হাসাহাসি হলো। জেনেছিলাম, দীনেশ দাস বাসায় বিশাল লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন। তার বাসার সর্বত্রই তাঁর বইয়ে ঠাসা।
দীনেশ ছিলেন খুব মর্যাদা সচেতন সাংবাদিক। জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কারও কাছ থেকে কিছু ধারকর্জ করলেও কথা মতো দিয়ে দিতেন। কয়েকবছর আগে একবার বললেন, দূর্গাপূজার ছুটি বাড়িতে কাটানোর পরিকল্পনা করে বাসায় স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে কথা দিয়ে বের হয়েছেন। কিন্তু পূজা উদযাপন করতে যাওয়ার মতো অর্থ তার কাছে নেই। আমাকে অনুরোধ করলে, আমি ইস্কাটনে তাকে আসতে বললাম। ওই ব্যাপারে সব সময় কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাতেন। কথা মতো, পরে আমাকে পরিশোধ করে দিলেও দেখা হলে মাঝে মাঝেই বলতেন, আপনার সেই টাকা দিয়েছিলাম তো! এতে লজ্জা আমি পেলেও, তার আত্মমর্যাদাবোধ দেখে মনটা শ্রদ্ধায় ভরে উঠত।
দীনেশ দাস জন্ম নেন ১৯৬৪ সালের ৩ মার্চ। তার পিতার নাম মহাদেব দাস। বাড়ি নওগাঁ জেলার রানীনগর থানার বানিয়পাড়া গ্রামে।
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট