ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নিভৃতচারী যুবরাজের নীরব বিপ্লব

তামীম রায়হান, ছাত্র, কাতার ইউনিভার্সিটি, দোহা থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১২
নিভৃতচারী যুবরাজের নীরব বিপ্লব

চীন-রাশিয়ার পাশের দেশ মঙ্গোলিয়া। মরুময় দেশ।

স্বল্প জনসংখ্যা। দেশটিতে মুসলমানদের সংখ্যা কয়েক লাখ মাত্র। এই মাত্র কয়েক লাখ হারিয়ে যাচ্ছে ইসলামের মাত্রা থেকে।

ভাষা দুর্বোধ্য, জীবনযাত্রাও কষ্টসাধ্য, যোগাযোগ বিপর্যস্ত, কে রাখে এদের খবর। ঐ অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য আর প্রভাব আজও প্রকট হয়ে আছে।

এত সমস্যার জাল ডিঙিয়ে এ পরিচয়বিহীন মুসলমানদের কাছে দ্বীন ঈমানের চেতনা নতুন করে জাগাতে কে যাবে এতদূর?

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ধনী দেশ কাতারের যুবরাজের কানে এ খবর যখন এল, তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। নিজের পুরো জীবনটাই তো তিনি নিয়োজিত করলেন দ্বীন ও তাবলীগের মেহনতে, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর খেদমতে।

একটি জামাত নিয়ে তিনি ২০১১ সালের মাঝামাঝি অনেকগুলো দিন কাটিয়ে এলেন ঐ অঞ্চলে। ভাষার বোধগম্যতার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ কাজাখস্তান থেকে দুজন দোভাষী আনিয়ে সাথে রাখলেন।

মঙ্গোলিয়ার গ্রামে ও শহরে তিনি মুসলমানদের খুঁজে খুঁজে বের করলেন সব কষ্ট যাতনা তুচ্ছ করে। তরুণদের একত্র করে তাদের কাছে তুলে ধরলেন ইসলামের প্রকৃত পরিচয়। তাদের ধর্মীয় দুরাবস্থা দেখে সহমর্মিতা জানালেন, নতুন করে ইসলামকে মেনে চলতে প্রেরণা দিলেন।

অবাক হয়ে তিনি দেখতে লাগলেন, এ মুসলমানরা কলেমাটুকুও জানে না। গোটা মঙ্গোলিয়ায় রয়েছে চল্লিশটি মসজিদ, কয়েকটিতে জুমার নামাজ ছাড়া আর কোন নামাজই হয় না, নামাজ কীভাবে পড়তে হয়, তাও জানে না তারা।

সব স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে তিনি দিন রাত তাদের সাথে মিশে থাকলেন, কলেমা শেখালেন, অজু শিখিয়ে দিলেন, নামাজ দেখিয়ে দিলেন।

থাকা খাওয়ার নানা কষ্ট, যাতায়াতের বিপত্তির সব ঝামেলাকে তুচ্ছ করে তিনি এ অসহায় মুসলমানদের দ্বীন ঈমানের কামিয়াবীর জন্য দিনভর দুয়ারে দুয়ারে হাজির হতেন, রাতভর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতেন নিজেদের অসচেতনতায় এ মুসলমানদের দূরাবস্থার কথা ভেবে।

তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ যে দেশের যুবরাজ তিনি, ইচ্ছে করলেই ভেসে যেতে পারতেন ভোগ ও ফূর্তির রঙিন ভুবনে, যেভাবে ভেসে যাচ্ছে অন্যান্য প্রিন্স ও প্রিন্সেসরা, কিন্তু জাগতিক সব সম্মান ও বিলাসিতা ছেড়ে এভাবেই তিনি চষে বেড়ান পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মুসলমানদের খোঁজে, যারা নামাজ কলেমা ভুলে শুধু বেঁচে আছে ধর্মের পরিচয়ে।

তার একান্ত ইমাম মাওলানা আলী আহমদ বাংলাদেশের আলেম। আমাকে তিনি স্নেহ করেন এবং এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমি তার কাছ থেকে শেখ ফাহাদ সম্পর্কে অনেক কিছূ জানতে পারি।

২০১০ সালেও তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখে সাধারণ পাসপোর্ট ব্যবহার করে নিতান্ত সাধারণ বেশ ধরে তাবলীগের চিল্লা লাগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের কক্সবাজার, টেকনাফ, রাঙামটির প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। এর আগেও বেশ কয়েকবার তিনি গিয়েছিলেন ময়মনসিংহ, বগুড়াসহ কয়েক জেলায়।

বাংলাদেশ সরকার তো দূরের কথা, বাংলাদেশস্থ কাতার দূতাবাসও জানতো না যে তাদের মহামান্য আমীরের ছেলে যে বাংলাদেশের গাঁও গেরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাবলীগের ঝুলি নিয়ে।

আরবি, ইংরেজি, ফরাসী ও জার্মান- এ চারটি ভাষায় দক্ষ এই যুবরাজ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে দারুণ সতর্ক। কাদাপানিতে হাঁটছেন, নিজের হাতে কাপড় ধুচ্ছেন, রিকশাওয়ালা ও কৃষকদের পাশে বসে দুআ শেখাচ্ছেন, কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই মসজিদে মসজিদে রাত যাপন করছেন, এসব দেখে কে বলবে যে, এই সাধারণ বেশের লোকটি বর্তমান পৃথিবীর তৃতীয় ধনী দেশের আমীরের ছেলে।

অথচ নিজের দেশে আগে পিছে কতো নিরাপত্তার আয়োজন তার জন্য। কাতারের বর্তমান আমীর নিজের ছেলের এমন সাদাসিধে চালচলন ও ইসলামের জন্য তার মায়া ও ত্যাগ দেখে আনন্দিত। তিনি বলেছেন, এভাবে পরিচয় গোপন করে আল্লাহর জন্য কাজ চালিয়ে যেতে পারলে তুমি করে যাও। আর তাই কাতারের যে কোন মসজিদে উম্মুক্ত বয়ান ও জামাতে থাকা খাওয়া এবং ইজতেমার অনুমতি দিয়ে রেখেছেন তিনি। যা অন্যান্য আরব দেশগুলোতে বিরল।

একবার সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ এই আমীরকে বলেছিল, তোমার দেশে তাবলীগকে যেভাবে সুযোগ দিচ্ছ, তা বন্ধ কর, নইলে এরা হুমকি হয়ে উঠতে পারে। উত্তরে আমীর তাদেরকে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমি খুব ভালো করেই জানি, সারা পৃথিবীতে যত দল ও মত আছে, এর মধ্যে নিজের সবকিছু খরচ করে একমাত্র আল্লাহর জন্য শতভাগ নিবেদিত হয়ে দ্বীনের কাজ এরাই করছে। এ নিয়ে আমার মোটেও দুশ্চিন্তা নেই।

জীবনের বাকী দিনগুলো এ পথেই কাটাতে চান এ তরুণ নিভৃতচারী যুবরাজ শেখ ফাহাদ বিন হামাদ বিন খলীফা আল থানী। নিজেকে তিনি এতই লুকিয়ে রাখেন যে আমীরের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তার যে ছবিটি এখনও ইন্টারনেটে পাওয়া যায় তা ১৭ বছর আগের। সামরিক বাহিনীতে তার দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখে অনেক পদবি ও দায়িত্ব তাকে দিতে চেয়েছিলেন কাতারের রাজপরিবার।

নিজের বিনয় ও গোপন থাকার সদিচ্ছা জানিয়ে তিনি সেসব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরই মধ্যে তিনি রাজপরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য, তার চাচাতো ভাই, অন্যান্য গোত্রের শেখদের কাছে এ মহান দায়িত্বের গুরুত্ব পৌঁছিয়ে তাদেরকেও বের করেছেন তাবলীগের রাস্তায়, শর্ত একটাই, যা কিছু করা তা করতে হবে নিজের ঐশ্বর্য ও পরিচয় গোপন রেখে শুধু এক আল্লাহর জন্য।
 
লেখক: ছাত্র, কাতার ইউনিভার্সিটি, দোহা, কাতার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।