অতঃপর কাউন্ট ডাউনের শেষ! একাত্তরের খুনি নাম্বার ওয়ান, যুদ্ধাপরাধীদের ওস্তাদ, রাজাকারকূলশিরোমনি গোলাম আযম গ্রেফতার হয়ে নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের অতিথি! যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায় এ গ্রেফতারের ঘটনা একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের এ এক দীর্ঘ অপেক্ষার অবসানের দিন—বুক থেকে জগদ্দল পাথর নেমে যাবার দিন, আনন্দের, বিজয়ের দিন।
বাংলাদেশের সব মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব মানুষজন, মহাজোট নেতৃ্ত্ব, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ট্রাইব্যুন্যাল, তদন্তকারী দল, প্রসিকিউশন টিম সবাইকে এই বিশেষ দিনটিতে অভি্নন্দন। তোমাকে আবার হাজার সালাম শহীদজননী জাহানারা ইমাম। বাংলাদেশের জন্ম-শত্রু একাত্তরের কৃমিকীট এই ঘাতক গোলামকে তুমিই আমাদের ঘৃণা করতে, বিচারের মুখোমুখি করতে, আন্দোলন করতে শিখিয়েছো। স্মরণ করছি প্রয়াত নেতা অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, আ.লীগ আব্দুর রাজ্জাক সহ এ আন্দোলনের সব নেতাকর্মী, সহযোগী মিডিয়া কর্মীদের লাগাতার অবিস্মরণীয় ভূমিকা ও অবদানের কথা। সত্যের পক্ষে কোন আন্দোলন যে টাকার জোরে, যুদ্ধাপরাধীদের মাওলানাদের শব্দকৌশল ছলচাতুরিতে দুর্বল-ব্যর্থ করে দেওয়া যায় না তা আবারও প্রমাণ হলো। এখন দেশের মানুষের আশা, মীর কাসেম আলী, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক সহ একাত্তরের অন্য কুশীলবদেরও গ্রেফতার, বিচারের আওতায় আনা হবে।
এ গ্রেফতারের অপেক্ষায় আজ সকাল থেকে বসেছিলাম কম্পিউটারের সামনে। একদিনে অনেক ঘটনা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগরতলায়,বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়া বঙ্গভবনে, গোলাম ট্রাইবুন্যালে। একই দিনে আবার গোলামের জন্মস্থান নবীনগরে জনসভার নিয়ত করেছেন জেনারেল এরশাদ। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে গোলাম আযমের গ্রেফতারই মূল নিউজ! টপ নিউজ! এ নিউজ কভারে দেশের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর মধ্যে বাংলানিউজের ভূমিকাও সবার চেয়ে এগিয়ে। গোলামের বাসা থেকে বেরুনো থেকে শুরু করে ট্রাইবুন্যালে প্রবেশ, শুনানি শুরু, তার জামিনের আবেদন নাকচ, কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নতুন স্থায়ী বাসিন্দা গোলাম, পল্টনে কিছু জামায়াতি আণ্ডাবাচ্চার মিছিল, গোলামের আইনজীবীর গোস্বা, ‘না এটা ঠিক হয়নি’, তার সাবেক সেনা কর্মকর্তা বাচ্চার(পুত্র) প্রতিক্রিয়া—এসবকিছুর আপটুডেট কভারেজে ছবি-নিউজ সবকিছুতেই বাংলানিউজ ফার্স্ট। প্রিয় বাংলানিউজ টিমকে এর জন্য অভিনন্দন।
এ গ্রেফতারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে অনেক কথা-সমালোচনা হয়েছ। গোলাম খুব বৃদ্ধ, অসুস্থ, ধরতে গেলে পড়ে মরে যাবে--এমন প্রচারণাও ছিল! কিন্তু সবশেষ গত ডিসেম্বরে বেশ কিছু ইন্টারভ্যু দিয়ে গোলাম প্রমাণ করেন, এসব প্রচারণা ঠিক না। তিনি পুরোপুরি ফিট! বিশেষ করে বাংলানিউজের সঙ্গে ইন্টারভ্যুতে ‘যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত’ বলে বিজয়ের মাসে তিনি দেশের মানুষকে এক প্রচ্ছন্ন হুমকিও দেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে তাকে গ্রেফতার করলে যদি সারাদেশ জুড়ে বিশেষ কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সারাদেশে হামলা শুরু হয় গোলামের অনুসারী নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে, ল’ চেম্বারে, সে আশংকায় তার আইনজীবী শুনানি পিছিয়ে ১৬ ডিসেম্বরের পরে নিয়ে যেতেও সক্ষম হন। কিন্তু পুনঃনির্ধারিত ২৬ ডিসেম্বর ট্রাইবুন্যাল অভিযোগপত্রটি ফিরিয়ে দিয়ে বলে প্রসিকিউশন টিম সেটি আইনানুগ ও যথানিয়মে সুবিন্যস্ত করে লিখতে পারেননি।
এর মাঝে আবার নতুন মওকা খোঁজেন গোলামের আইনজীবী! যেহেতু একবার অভিযোগপত্র ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা আর গ্রহণ করা যায় না জাতীয় বক্তব্যও এসেছে। মাঝে বাংলাভিশনে আবার যুদ্ধাপরাধীদের আরেক মাওলানার বক্তব্যে অনলাইনে-ব্লগে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে! বেচারাকে সেগুলোকে নানা জায়গা থেকে ডিলিট করে নিজস্ব সুশীল(!) ভাবমূর্তি অটুট রাখতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
গোলাম আযমের এ গ্রেফতার প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে ট্রাইবুন্যাল! তার উকিলদের সব আবেদন সময় নিয়ে শোনা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ট্রাইবুন্যালের প্রতি শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর আইনানুগ আনুগত্য। আগেভাগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে যুদ্ধাপরাধীদের আণ্ডাবাচ্চাদের বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগও দেওয়া হয়নি। আসামির উকিলদেরই বলা হয়েছে তোমাদের মাল তোমরা হাজির করো। এরপর বড়মগবাজারের বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসতে তার কোনও সমস্যা হয়নি! এরপর আবার ট্রাইবুন্যালের গেটে নেমে সেখানকার হেফাজতখানায় যেতে, সেখান থেকে আসতে হুইল চেয়ার লেগেছে! একঘন্টার বেশি সময় নিয়ে তার আইনজীবীদের বক্তব্য শুনেছে ট্রাইব্যুনাল! দিনটি আসলেই গোলামের জন্য খারাপ একটা দিন ছিল। ব্যারিস্টার মওদুদ সহ বিএনপি নেতারাতো আর এদিন বঙ্গভবনের সংলাপের ফটোসেশন মিস করে এখানে আসতে পারেন না! আব্দুল আলিমের শারীরিক অবস্থার জামিনের সুযোগও দেওয়া যায়নি গোলমকে। আব্দুল আলীমতো আর হুইল চেয়ারে বসে ইন্টারভ্যু দিয়ে দিয়ে দেশের মানুষকে এ বিচারের বিরুদ্ধে হুমকি দিচ্ছিলেন না! গোলাম আযম সাম্প্রতিক যত ইন্টারভ্যু দিয়েছেন এর একটাও হুইল চেয়ারে বসে দেননি। এখন জামিন নিতে তার হুইল-চেয়ার-কৌশল যদি আমলে নেওয়া হতো তাহলে ট্রাইবুন্যালের সমালোচনা হতো।
এ নিয়ে দ্বিতীয়বার নাজিমউদ্দিন রোডে গেলেন গোলাম আযম। এর আগে গণ আন্দোলনের চাপে খালেদা জিয়া যে তাকে জেলখানায় নিয়েছিলেন তা ছিল সমঝোতায়। গণ আন্দোলনের রোষ থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য। এরপর সেখানে জামাই-আদরে রেখেই তার নাগরিকত্ব আর নিরাপদ মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু কথায় আছে না—‘বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান!’ শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতা নয়, দেশ স্বাধীন হবার পরও দেশে দেশে ঘুরে এই জ্ঞানপাপী উগ্রতা-ধর্মান্ধতার ফিরিওয়ালা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কেবল ষড়যন্ত্র করেই গেছে। এরপর ৭ বছর লন্ডনে থেকে পাকিস্তানি পাসপোর্টে ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে আসে এই ঘাতককূল শিরোমণি। জিয়া-এরশাদের দয়ায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকা স্বত্ত্বেও তাকে আর নিজের দেশ পাকিস্তানে ফিরে যেতে হয়নি। এরশাদের পতনের পরপরই জামায়েতের আমীর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন স্বরূপে। শুরুতে শহীদজননী জাহানারা ইমাম ছাড়া কেউ এর জোরালো প্রতিবাদ করেননি। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় সমন্বয় এসব সংগঠনের পর আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে সঙ্গে আসে আওয়ামী লীগ। আবার ক্ষমতার স্বার্থে পিছিয়ে যেতেও সময় লাগেনি তাদের! এর জন্য গোলামকে বলা হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের আরেক নাম। সে কারণে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কফিন ছুঁয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ সময়েও তার কোন সমস্যা হয়নি।
এরপর নানাঘাটের ঘোলা জল খেয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ভুল বুঝতে পারে দলটি। গোলামদের বিচারের অঙ্গিকার নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে রেখে নতুন প্রজন্মের বিপুল ম্যান্ডেটে ক্ষমতায় এসে এখনও এ অঙ্গিকারের প্রতি তারা অটল আছে। গোলামের গ্রেফতারের দেরি নিয়ে দেশের মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখেছে আওয়ামী লীগ নেতৃ্ত্বাধীন মহাজোটের সরকার। এখন এ গ্রেফতারের পর মানুষের উচ্ছ্বাস-প্রতিক্রিয়া, তা কী তাও দেখছে বাংলাদেশ। দেশের মানুষ এখন চায় দ্রুত বিচার। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গোলামের বিচার। তা কি শুনতে পাচ্ছে সরকার?
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, ১১ জানুয়ারি, ২০১২