ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জামায়াতের লম্বা হাত

আবিদ রহমান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১২
জামায়াতের লম্বা হাত

স্বাধীনতার পর অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যখন যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশে নিজেদের অস্তিত্বের রাজনৈতিক লড়াইয়ে ব্যতিব্যস্ত জামায়াতিরা তখন প্রাণরক্ষার দৌড়ে। এক জামায়াতি অন্য জেলায় ক্লিন শেভেন মডারেটেড পরিচয়ে।

তবে বেশীর ভাগই বর্মা বা ইয়াংগুনের জংগল ভেংগে মধ্যপ্রাচ্যের বিমানে চেপেছিলো।   আরেক কাঠি সরেস নেতারা লন্ডন-আমেরিকায় গাড়ে স্হায়ী ঠিকানা। দৌড়ের মধ্যে থেকেও জামায়াতীরা মুরুব্বী পাকি গোয়েন্দা সংস্হার সহানুভূতিশীল আংগুল ছাড়ে নি।

বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদে জামায়াত শিবিরে লেগেছিলো ‘ঈদানন্দ’। পাকি গোয়েন্দা সংস্হার আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াতীরা রাজনৈতিক ক্ষমতার বদলে অর্থনৈতিক শক্তি হবার কামিয়াবীতে মনোনিনেশ করে। ততোদিনে রাজনৈতিক পূর্ণবাসনের প্রক্রিয়াটি শুরু করে দিয়েছিলেন অভ্যুৎত্থানে ক্ষমতায় আসা জিয়ার সাফারী গণতন্ত্রের খাকি সরকার। শাহ আজিজ-আবদুল আলীম, সবুর খান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী সহ স্বাধীনতা বিরোধী মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামী ও পিডিপি’ নেতারা আত্মগোপন ছেড়ে গাড়িতে-বাড়িতে পতাকা উড়িয়ে দিব্যি বীর পুরুষ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিলের মধ্য দিয়ে মুসলিম লীগ (রা) টিকে থাকতে পারেনি। জামায়াতীরা আজো বাংলাদেশের রাজনীতির বিষফোঁড়া হিসেবে টিকে আছে আর্থিক জোরেই। স্বাস্হ্য-শিক্ষা-ব্যাংকিং-বীমা সহ সকল রোজগারী আর্থিক খাত জামায়াতীদের করতলগত। পাশাপাশি প্রশাসন ও শিক্ষাঙ্গনে জামায়াতীরা পরিকল্পিতভাবে অনুপ্রবেশ করিয়েছে তাদের ক্যাডার ও শুভানুধ্যায়ীদের। ফ্যানাটিক জামায়াতিরা কখনোই অর্থ-বিত্ত ও লোভের কাছে বিক্রি হয়নি। বরং জামায়াতীরা বারবার ক্রেতার ভূমিকায় কিনেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ঈমান। দেশের সংবাদ মাধ্যমেও জামায়াতিদের শক্তিশালী অবস্হান। প্রবাসে ও দেশে বিভিন্ন ব্যানারে তারা গড়ে তুলেছে বিভিন্ন আন্তর্জাল পত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যম। বেনামী সংগঠন গড়ে তুলেছে বেশুমার।

জামায়াতীরা তাদের গুরু ‘মুরতাদ’ মওদুদীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় জানতো, একদিন একাত্তরের অপরাধের মুখোমূখি হতে হবে। দলে দলে দেশে আইন পেশায় জামায়াতী ক্যাডাররা ঢুকে পড়ে। জামায়াতিদের নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি রাখা হয় একদল আইনজীবী ও ব্যারিস্টারদের। পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও ঢুকে পড়ে জামায়াত। ‘পুলসেরাতের’ রাতের প্রহরী হবার খায়েশে। সেই পুলসেরাতের রাত এসেছে। বিভিন্ন ছবিতে দেখি জামায়াতী পুলিশ অতি ‘তমিজের’ সাথে গুরুদের সেবা যত্ন করছে ছাতা হাতে জেলে-আদালতে আনা-নেওয়ায়। জেলের দেয়ালের আড়ালে শোনা যায় জামায়াতী নেতারা রাজসিক জীবন-যাপনে আছেন। নাটের গুরু গোলাম আজমকেতো মুহূর্তেই অসুস্হ সাজিয়ে হাসপাতালে ভর্তির টিকেট মিলিয়ে দিয়েছে।

আসলেই জামায়াতীদের বাহু অতি সুদীর্ঘ। প্রেসক্লাবের প্রিয় মানুষ ও জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রিয় মুখ বিচারপতি টিএইচ খানের সুযোগ্য সাংবাদিক-সংবাদপাঠক পুত্র আফজাল এইচ খান তখন বিএনপি’র মুখপত্র ‘দৈনিক দিনকাল’র সম্পাদক। ব্যবস্হাপনা সম্পাদক জিয়াপুত্র তারেক রহমান। চারদল তখন বিরোধী শিবিরে। বেশ ঘটা করে সরকারবিরোধী আন্দোলনও চলছে। এক সন্ধ্যায় চারদলীয় জোটের নেত্রী বেগম জিয়ার আগামী কর্মসূচি প্রেসবিজ্ঞপ্তি আকারে এলো সংবাদপত্রে বিএনপি কিংবা চারদলীয় জোটের লেটার হেডে নয়, জামায়াতের লেটার হেডে। কৌতুহলে বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ে জানতে চাইলেন বিএনপি’র সাংসদ ও দিনকাল সম্পাদক আফজাল খান। পরদিন বিনা নোটিশে ভদ্রলোক দিনকালের সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন।

আমার এক অতি ঘনিষ্ট আত্মীয় ও শীর্ষ স্হানীয় সাংবাদিক প্রায় টকশো’তে যুদ্ধাপরাধীদের এক হাত নিতেন। আত্মীয় ভদ্রলোকটি আবার বিএনপি ঘরানার অতি শীর্ষ না-হলেও জাঁদরেল নেতা। ফি বছর প্রেস ক্লাব নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। একবার প্রেসক্লাব নির্বাচনে বন্ধুদের নির্বাচনী সংগী হলাম দেশে ফিরে। আলাপ চারিতায়, বিএনপি-জামায়াত ফোরামের এক অতি শীর্ষ নেতা আমাকে বল্লেন, ’কী ওস্তাদ আত্মীয়কে উদ্ধার করতে এসেছেন? এবার কিন্তু আশা নাই। ব্যাটা  বিএনপি ঘরানার সাংবাদিক মানে আমাদের খেয়ে-পরে বেঁচে আছে আর টেলিভিশনের টকশোতে বলে আমরা নাকি রাজাকার! নির্বাচনে ব্যাটকে আস্ত একটা সবক দেবো’। আমার আত্মীয় ভদ্রলোক বিপুল জনপ্রিয়তার পরও নির্বাচনে হেরেছিলেন। সবক পেয়েছিলেন কিনা জানিনা।

একটি গুজবঃ ওয়ান ইলেভেনের অন্যতম কুশলীব জেনারেল মাসুদ তখন দুর্নীতিবিরোধী টাস্ক ফোর্সের প্রধান। দুর্নীতির অভিযোগে এক জামায়াত সাংসদকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে বেচারা মাসুদ বিপাকে পড়েছিলেন। সেই নেতার জামাতার বড় ভাবীর আপন মামা ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক প্রধান ফখরুদ্দিন। জামায়াতের লম্বা হাত ফখরুদ্দিন অব্দি পৌছেছিলো। ফখরুদ্দিন হয়ে তদবীরের বিষ নেমেছিলো জেনারেল মঈনের কর্ণ কুহরে। এমনিতেই মঈন-মাসুদের মধ্যে চলছিলো টানা-পোড়ন। সেই টানা-পোড়নে জামায়াতি ইন্ধন এক-সলতে আগুন হয়ে মাসুদকে পুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো স্টাফ কলেজের নির্বিষ পদে।
 
সত্য-মিথ্যা জানা হয়নি। তবে এক একান্ত সাক্ষাতে জেনারেল মাসুদ জামায়াত সাংসদকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেবার কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন।

গোলাম আযম গ্রেফতারের পর জামায়াতের হাত কতটুকু লম্বা হয় এখন সেটাই দেখার বিষয়।

প্রশাসনের শীর্ষ স্থানীয় অনেককেই সম্প্রতি পার্থে সারাক্ষণ প্রবাসী জামায়াত নেতাদের সাথে সাথে দেখা গেছে। জামায়াতীদের অর্থায়নেই নাকি তাদের একজন সিডনি-ক্যানবেরা ঘুরে গেছেন। এ অভিযোগ অষ্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি গিয়াস মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক পিএস চুন্নুর। মৃদু হাসিতে নিরব সমর্থন জানিয়েছেন সভাপতি ব্যারিস্টার সিরাজ।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের দূর্গে যখন জামায়াতের কেনা মানুষ থাকে তখন দুশ্চিন্তা হয় বৈকি!  

ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।