ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সত্য প্রকাশের সময় এসেছে যে!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১২
সত্য প্রকাশের সময় এসেছে যে!

২০০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা হেফাজতের(!) হাজতি হিসেবে ফরিদপুর কারাগারের সেলে ঢুকতে গিয়ে বেশ অবাক লাগছিলো। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতি আর মৌলবাদী অপশক্তির হোতা আমিনীদের নিয়ে গড়া জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে গায়ের জোরে সহোদর ভাইসহ (সাংবাদিক অমরেশ রায়) আমাকে জেলে পাঠানোয় বিস্মিত হইনি।



বিস্মিত হয়েছিলাম, ক্ষমতার জোরে আইনের এমন বিকৃতি ও অপপ্রয়োগ যে ঘটানো যায়, তা দেখে। আশ্চর্য হয়েছিলাম, সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিক ও সাংবাদিক নামধারীদের দৌরাত্ম্য কতো দূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে যে, তারা যাদের সহকর্মী বলে দাবি করেন, সে রকম দুজন সাংবাদিককে শায়েস্তা করতে চৌদ্দ শিকের ঘানি পর্যন্ত টানিয়ে ছাড়তে পারেন, সেটা বুঝতে পেরে।

দীর্ঘ ৯ বছরেরও বেশি সময় পরে কেন সে ঘটনা নিয়ে লিখতে বসেছি, আগে না বলে, তার একটা ব্যাখ্যা শুরুতেই দিয়ে রাখা দরকার। কারণ, বিনা অপরাধে ও বিনা বিচারে আমাদের টানা ৮৩ দিন কারা নির্যাতন ভোগ করানোর ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ওই সম্মিলিত অপশক্তির মূল অস্ত্র ছিলো তাদেরই এক প্রতিনিধির দায়ের করা একটি মামলা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত সদর নন জি আর ১৫৬/২ নম্বরের মামলাটি পরে পুলিশ বাদী রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় রূপ নেয়।

সেই ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটক সংক্রান্ত মামলাটি রাষ্ট্রপক্ষ প্রত্যাহার করে নিয়েছে মাত্র দুই সপ্তাহ আগে।

এখন আমিসহ ওই মামলার ৩৪ আসামি মামলার দায় থেকে মুক্ত! কারাগারের দুঃসহ দিনযাপনের ধারাবাহিকতায় আদালতে দিনের পর দিন বিড়ম্বিত হাজিরা দান, পারিবারিক বিপর্যস্ততা, মানসিক-শারীরিক ক্ষতি-ক্লেশ ও আর্থিক গচ্চাসহ ধর্মদ্রোহ ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার কলঙ্ক বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণাও আর থাকলো না। তাই সে সময়কার ঘটনাবলির পূর্বাপর উল্লেখ করে সত্য প্রকাশের দিন সমাগত যে!     

সে মামলার আসামিদের সবাই আমরা নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মী অথবা সহযোগী-পৃষ্ঠপোষক। পেশায় আমরা দু’ভাই সাংবাদিক, অধিকাংশই ছাত্র, কয়েকজন চারুশিল্পী, এমনকি একজন দরিদ্র দোকানিও ছিলেন আসামি তালিকায়। অথচ দৃশ্যত: এই নিরীহ আমরাই অভিযুক্ত হয়েছিলাম ধর্মদ্রোহী এবং রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে!

শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ দেশের বিবেক ২৪ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকেও খালেদা জিয়ার আগের সরকার রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়েছিলো যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোদা গোলাম আযমের বিচার দাবিতে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা ও গণ-আদালত বসিয়ে তার অপরাধ মৃত্যুদণ্ডতুল্য ঘোষণার  ‘অপরাধে’!

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমির সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই মাতা ও বরেণ্য সাহিত্যিক মৃত্যুবরণও করেন রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ ও দুর্নাম মাথায় নিয়ে। পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার তার ও অন্যদের নামে দায়ের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি প্রত্যাহার করে নিলে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি একটি কলঙ্ক বয়ে বেড়ানোর দায় থেকে বাঁচে।

আমার বর্তমান কর্মস্থল অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.ডটকমও মামলাটি প্রত্যাহারের ঘটনাটিকে ‘ফরিদপুরের একটি কলঙ্ক মোচন হলো’ বলে উল্লেখ করেছে। আমাদের সৌভাগ্য যে, এ কলঙ্ক মোচনের জন্য আমাদের কা‌উকেই মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি। তবে আমরা দু’জনসহ ১২ জনের মতো(কয়েকজন নারী নাট্যকর্মীও ছিলেন) কারা-নির্যাতিত হয়েছি, অন্তত: ২২ জন হয়েছি এলাকাছাড়া।

২০০২ সালের ৬ আগস্ট ফরিদপুরে ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নামক নাটকটি মঞ্চায়নকে কেন্দ্র করে মৌলবাদী মহলের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে ১৩ আগস্ট ফরিদপুরের ৩২ নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মীর নামে মামলাটি করা হয়। ঘটনার তিন মাস পর ২৮ অক্টোবর নাটকীয়ভাবে আমাদের দু’ভাইয়ের নামও সম্পূরক চার্জশিটে জুড়ে দিয়ে আমাদেরও মামলায় জড়ানো হয়। তার আগেই অবশ্য নিরাপত্তা হেফাজতের নামে ২৩ সেপ্টেম্বর ফরিদপুর কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় আমাদের দুজনকে। একই সঙ্গে ৫৪ ধারায় দায়ের মামলায় অন্যদের আটকে রাখা হয় জেলে।

২০১১ এর এপ্রিল মাসে ৩৪ জন আসামির পক্ষে এ মামলাটি প্রত্যাহারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানাই। পৌণে ২ বছর ধরে যথাযথ আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সরকারপক্ষ এই মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানায় ফরিদপুরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের ৬ নম্বর আদালতে। সরকারের পক্ষে ফরিদপুরের পিপি অ্যাডভোকেট খসরুজ্জামান দুলু মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানালে বিচারক ইউনুছ আলী খান মামলাটি প্রত্যাহারের আদেশ দেন।
 
আসামিদের(!) সবার মাঝেই এখন অপরাধ না করেও অপরাধী হয়ে থাকার যণ্ত্রণামুক্তির স্বস্তি! আদালতের রায়ের মাধ্যমে নির্দোষ প্রমাণিত হবার পাশাপাশি জুটেছে মুক্ত-স্বাধীনভাবে চলাচলের নিশ্চয়তা প্রাপ্তির আনন্দও!       

ভোরের কাগজের ফরিদপুর জেলা প্রতিনিধি ও পাশাপাশি জনকণ্ঠের নিজস্ব সংবাদদাতা (বছর খানেকের জন্য) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম সে সময়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জোট সরকার ভোটে জিতে ক্ষমতাসীন হবার আগেই ওই রাত থেকেই দেশের বিস্তীর্ণ জনপদজুড়ে শুরু হয় আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মী, হিন্দু সম্প্রদায় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষের ওপর পাইকারি হারে সন্ত্রাস-নির্যাতন। হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির-প্রতিমার ওপর হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের সে ভয়াবহতা ফরিদপুর অঞ্চলে একটু বেশিই ছিলো।

স্বাভাবিকভাবেই অন্তত মাস তিনেক আক্রান্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিএনপি-জামায়াত-মৌলবাদী গোষ্ঠীর সেসব নির্যাতন-সন্ত্রাসের সংবাদগুলো তুলে ধরেছিলাম ভোরের কাগজ-জনকণ্ঠে।

একইভাবে দৈনিক আজকের কাগজের তৎকালীন ফরিদপুর প্রতিনিধি হিসেবে অমরেশ রায়সহ অন্য সাংবাদিকরাও নির্যাতিত অসহায় মানবতাকে রক্ষার কলমযুদ্ধে শামিল ছিলেন দায়িত্ববোধ ও আদর্শ-চেতনার নৈতিক জোর থেকেই।

ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় বাড়ি একজন কলেজ শিক্ষক, যিনি কর্মরত ছিলেন ভাঙ্গা উপজেলার একটি কলেজে তার বাড়িতে একযোগে হাজার-বারো শ’ লোকের হামলা-ভাঙচুর-লুটপাটের ভয়াবহতা দেখে সাংবাদিকতার সাধারণ নির্লিপ্ততার বাইরে আসতে বাধ্য হয়ে আমরাও বিস্ময়ে, আতঙ্কে বিমূঢ় হয়েছিলাম, ‘মানুষ মানুষের ওপর এভাবে আক্রমণ চালাতে পারে!’ অসুস্থ সেই শিক্ষক ও তার পরিবার কোনোক্রমে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন।

ভাঙ্গার ভাড়া বাসায় আশ্রয় নেওয়া সেই শিক্ষক নিজেই ঘটনার ব্যাখ্যা করছিলেন এভাবে, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও এতো ভয়াবহ নির্যাতন সইতে হয়নি আমাদের। এবারের নৃশংসতা একাত্তরকে ছাড়িয়ে গেছে। কেননা, জামাতিরা বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমিনীদের মতো মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদী চক্র আর অপশক্তি। ’      

ভেবে দেখলাম, তিনি ঠিকই বলেছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির তৎকালীন ফরিদপুর জেলা আহ্বায়কসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নাট্য-শিশু-সাংবাদিক সংগঠনের কর্মী হিসেবে নির্বাচনের আগে-পরে আমিওতো অন্যদের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং কেবলই শক্তিমান হতে থাকা জঙ্গিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের নির্মূল চেয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে বেড়াচ্ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আরেকবার ক্ষমতায় এসে দেশকে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে নিয়ে সমৃদ্ধ করুক, সে চাওয়ার সপক্ষেও প্রকাশ্যে এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তৎপরতা চালিয়েছি। তখনওতো আমি-আমরাই ফরিদপুরের কুলাঙ্গার মুজাহিদসহ নিজামী-আমিনী গংদের একাত্তরের অপকর্মগুলো তুলে ধরেছি।

তবে একথা ঠিক, মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়ায় সেসব লিখতাম-বলতাম ইতিহাস বা পূর্ব প্রজন্মের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। আর আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে খালেদা-নিজামী-মুজাহিদ-আমিনীদের নেতৃত্বে সৃষ্ট জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা আর তাদের দ্বারাই পরিচালিত ২০০১ নির্বাচন পরবর্তী নারকীয় সহিংসতার বিভৎসতা তুলে ধরেছিলাম, স্বচক্ষে দেখে বা বুঝে-শুনেই।

তাই একাত্তর আর ২০০১ এর আগে-পরের অপশক্তির অপতৎপরতার তুলণামূলক বিশ্লেষণ করেই বুঝেছিলাম, ওই কলেজ শিক্ষকের কথাগুলোই সঠিক। আর ৯ বছর পরে ২০০১ এর নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা-নির্যাতন সম্পর্কিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনও একই সত্যই তুলে ধরছে।

বেশ মনে আছে, সে সময় সুহৃদরা আন্তরিকভাবে সহানুভূতির সঙ্গে অনুরোধ করে আর প্রতিপক্ষ হুমকি-ধামকির সুরে ‘সাপের লেজে’ পা না দিতেই বলতেন। বিএনপি-জামাত-আমিনী-জঙ্গি আর ’৭১-’৭৫ এর খুনি ও তাদের হালের দোসরদের সম্মিলিত সে অপশক্তির বিরুদ্ধে লেগে যে তাদেরই ক্ষমতার জামানায় নিরাপদে থাকতে পারবো না, তাতো জানতাম-বুঝতাম। কিন্তু তারপরও সেই অন্ধকার সময়কালে আলোর যুগ আনতে নিজের নগণ্য অবস্থান থেকে সামান্য ভূমিকা রাখতে চেয়েছি।

এ কারণে শুরুতেই বলেছি, ২০০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কারাগারের ফটক পেরোতে গিয়ে মোটেই অবাক হইনি। সেটা আমার কাছে ছিলো ‘বিষধর সাপের লেজে পা দিয়ে ছোবল খাওয়ার’ মতোই।

কিন্তু সে সময়কার ঘটনার পেছনের ঘটনাকে তুলে ধরতেই আমার কলম ধরা। খালেদা-নিজামী-মুজাহিদ-আমিনীদের প্রতি অনুগত স্থানীয় সাংবাদিকদের(!) সেসবসহ আগে-পরের আরো অনেক অপঘটনা ঘটানোর পেছনের অনুঘটক হিসেবে কর্ম-তৎপরতা(!) তুলে ধরতেই এ লেখার অবতারণা।      

দেশ কাঁপানো ২০০২ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটক এবং ওই মামলাকে কেন্দ্র করে নাট্যকর্মীদের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ, ফরিদপুরের বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও নাট্য সংগঠনের কার্যালয়, বাড়িতে বাড়িতে ও সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের হোস্টেলে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে মৌলবাদীরা সাম্প্রদায়িক নির্যাতন এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চালায়। সভা-সমাবেশ করে অর্ধ শতাধিক সাংবাদিক, সংস্কৃতি ও নাট্যকর্মী এবং প্রগতিশীল রাজনীতিবিদকে মুরতাদ ঘোষণা করে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ছড়িয়ে তাদের প্রকাশ্যে দিগম্বর করে ফাঁসি, হত্যা, জীবন্ত কবরদান, যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই গণধোলাইয়ের ফতোয়া, হুমকি, নির্দেশ বা উস্কানি দেওয়া হয়।

এ ধরণের বর্বরোচিত হামলা-মামলা ও অপতৎপরতায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয় পুরো ফরিদপুরজুড়ে। ষড়যন্ত্রের মূল টার্গেট (!) হিসেবে আমার অবস্থা যে কেউই সহজেই অনুভব করতে পারবেন। তারপরও বলি, দিনের বেলায়ও বাসার বাইরে গেলেই খুন, লাঞ্ছনা বা গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার ভয়, রাতের বেলা অন্য সুহ্নদ-প্রতিবেশিদের বাসায় আশ্রয় নেওয়া, পুরো পরিবারজুড়ে আতঙ্ক, পরিবারের শিশুদের অপহরণ ও বাসায় অস্ত্র রেখে ফাঁসিয়ে দেওয়াসহ প্রতিনিয়ত নানা হুমকি-ধামকি ছাড়াও জেলমুক্তির লক্ষ্যে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির শিকার হওয়া এবং পরিশেষে এলাকাছাড়া হওয়ার মতো অপরাধ বোধ হয় আমার ছিলো না!

একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করাটাই ছিলো বোধ হয় আমার একমাত্র অপরাধ।      

তবে বসে ছিলেন না মুক্তমতের সহকর্মীরাও। ওই সময় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সাংবাদিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাট্য সংগঠনসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সুশীল সমাজ মৌলবাদী চক্রের ওই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম এর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রতিবেদন ও নিবন্ধ-সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে কারা নির্যাতন ও হামলা-মামলার প্রতিবাদ জানানো হয় আন্তর্জাতিকভাবেও।

আর আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানো ফরিদপুরের অসংখ্য মানুষের অবদান ও ভূমিকার কথাই বা ভুলি কী করে?    

প্রায় ৩ মাস জেল খেটে ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আদেশে জামিনে মুক্তি পেয়ে আমরা দু’ভাই ঢাকায় চলে এসেছি। ইতিপূর্বে দৈনিক ভোরের কাগজ ও দৈনিক দিনের শেষের সিনিয়র সহ সম্পাদক এবং দৈনিক জনকন্ঠের মফস্বল ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে অ্যাসিসটেন্ট আউটপুট এডিটর এবং সহোদর অমরেশ রায় দৈনিক আজকের কাগজের পর বর্তমানে দৈনিক সমকালে স্টাফ রিপোর্টার পদে কর্মরত।

লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, ধর্মকে ব্যবহার করে একটি নারীপাচারচক্রের নারী পাচার ও নির্যাতন সম্বলিত গোপালগঞ্জের একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত নাটক ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটকটি ফরিদপুরে মঞ্চায়িত হয় ২০০২ সালের ৬ আগস্ট। কিন্তু আমাকে-আমাদের শায়েস্তা করার চেষ্টা শুরু হয়, ওই বছরের শুরু থেকেই। পরে জেনেছি, ২০০১ এর ১ অক্টোবর পরবর্তী সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্মূল কার্যক্রম রুখে দাঁড়ানো  সারাদেশের সাংবাদিকদেরকে টার্গেট করে করে শায়েস্তা করার মিশনে মাঠে নামে জোট সরকার।

এ মিশন অনুযায়ী বরিশালের শওকত মিল্টন, নড়াইলের রিফাত বিন ত্বহা, সিরাজগঞ্জের হেলাল উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক কারা-নির্যাতিত বা নানাভাবে হামলা-মামলার শিকার ও নিগৃহীত হন, কেউ কেউ এলাকাছাড়া হন আমাদের মতোই। আর জাতীয়ভাবে শ্রদ্ধাভাজন শাহরিয়ার কবির, ড. মুনতাসির মামুন, সাংবাদিক সালিম সামাদসহ অন্যদের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে কারা নির্যাতন বা মেরে ফেলার চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের ইতিহাসতো সবাই জানে।    

এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ণে কাজে লাগানো হয়, বিভিন্ন জেলার বিএনপি-জামায়াত ভাবাপন্ন সাংবাদিক(!), অপসাংবাদিক বা সাংবাদিক নামধারীদের যারা স্ব স্ব এলাকার টার্গেটকৃত সহকর্মী(!) নির্মূল অভিযানে সহায়তায় নেমে পড়েন বীরবিক্রমে এবং প্রকাশ্যে কোনো রকমের রাখ-ঢাক ছাড়াই।    

ওই টার্গেট তালিকায় আমি ও আমার সহোদরসহ ফরিদপুরের আরো কয়েকজন সাংবাদিক যে ছিলেন, এটা ঘটনা পরম্পরায় প্রমাণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথম আলোর তৎকালীন ফরিদপুর প্রতিনিধি ও পরবর্তী সময়ে দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার গৌতম দাসকে দীর্ঘ ষড়যন্ত্র ও চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর বিএনপির তৎকালীন মন্ত্রীর ক্যাডার-সন্ত্রাসীরা মেরেই ফেলে। অন্যজন রাজাকারবিরোধী সংবাদ-প্রতিবেদন লেখায় মৌলবাদী-সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী হামলায় এক পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া দৈনিক জনকণ্ঠের তৎকালীন স্টাফ রিপোর্টার বর্তমানে দৈনিক কালের কণ্ঠের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও মফস্বল সম্পাদক(বিশেষ) প্রবীর সিকদারকে গৌতম দাসসহ আমরা জেলে থাকতেই কারাগারে নিক্ষেপের চেষ্টা-ষড়যন্ত্র চলেছে। তারা দু’জন চক্রান্ত বুঝতে পেরে এবং আমাদের দু’ভাইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পান।

আমাদের পক্ষ নেওয়ায় স্থানীয় দৈনিক ঠিকানার তৎকালীন স্টাফ রিপোর্টার বেলাল চৌধুরীকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হয় ২০০২ সালের ২৪ আগস্ট, আমাদের জেলে পাঠানোর এক মাস আগে। ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেলেও পঙ্গু হয়ে গেছেন সাংবাদিক বেলাল চৌধুরী। ফরিদপুরের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রবীণ সাংবাদিক-শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র ঘোষের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার করে চরিত্র হননের চেষ্টা চলে কয়েক মাস ধরে।

আর আমাদের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রকার অন্যায়-ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতিরোধ আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ায় সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সব সময়ের সংগঠক ফরিদপুর জেলা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মুনশী হারুন-অর-রশীদও বার বার হুমকির শিকার হন। তাকেও আমাদের সঙ্গেই মুরতাদ ঘোষণা করে প্রকাশ্যে হত্যা বা গণপিটুনিতে মেরে ফেলার ফতোয়া দেন আমিনী গং।

শুধু এক ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটককে ঘিরেই কী ফরিদপুরে সাংবাদিক নিগ্রহ-নির্যাতনের ওই দীর্ঘ অঘটনগুলো ঘটেছে? আসলে তারা দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক ষড়যন্ত্রেও প্রতিবাদী-বিদ্রোহী প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আদর্শিক সাংবাদিকদের শায়েস্তা করতে বড়ো ধরণের অঘটন ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে (সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে পঙ্গু করা ছাড়া) হঠাৎ করে ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটকটিকে পেয়ে সেটাকেই ইস্যু করে হায়েনার অট্টহাসির সঙ্গে ধর্মোন্মাদনার চিরাচরিত অস্ত্রে শান দিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

না হলে, জোট সরকারের এক মন্ত্রীর উপস্থিতিতেই মাগুরায় এর মাত্র কিছুদিন আগেই ওই ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটক মঞ্চস্থ হলেও কোনো রকম প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়নি আর সেখানে একই নাটক ফরিদপুরে হলে পরে রাতারাতি এ রকম অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হলো কেন? আরো মজার ব্যাপার যে, যারা ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটকের মাধ্যমে ‘ইসলাম গেলো’ রব তুলে ধর্মরক্ষার জেহাদে (এর সঙ্গে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী থেকে শুরু করে হালের জঙ্গি-মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠীর কাজকর্মের কী অদ্ভুত মিল!) নেমেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছাড়া কেউই নাটকটি আদতে দেখেনইনি! যিনি নাটকটি দেখে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন এবং নাটকটির একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সেই ফরিদপুর টাউন থিয়েটারের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ পরে অকপটে স্বীকার করেন, সাংবাদিকসহ একটি মহল এ ঘটনায় বাড়াবাড়ি করা ছাড়াও তাকে নানা হুমকি দিয়ে সাম্প্রদায়িক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে বাধ্য করেছে (সূত্র: দৈনিক ভোরের কাগজ ২৯ জুলাই ২০০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘ফরিদপুরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টার তথ্য ফাঁস’ এবং ৩১ জুলাই প্রকাশিত ‘ফরিদপুরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন সাংবাদিকরা’ শীর্ষক সংবাদ)।     

আর এ জেহাদে ছিলেন আমিনী-মুজাহিদসহ তাদের স্থানীয় ধর্মরক্ষার এজেন্ট বিএনপি-জামায়াত আর মৌলবাদী দল-সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সন্ত্রাসী, গডফাদার, মাতাল-চরিত্রহীনদের সঙ্গে সাংবাদিকরাও(!), যাদের অনেকেই ওই সময়কালেই জোট সরকারের চালানো ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ এর আওতায় সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার ও প্যাদানি খেয়ে কারাগারে আমাদের পাশের সেলেই ঠাঁই পেয়েছিলেন।      

এবার জানাই, সাংবাদিক হয়ে বা সাংবাদিক নাম ধারণ করে কারা কিভাবে এ সমস্ত অপকর্মে নেতৃত্ব দিলেন। ২০০২ সালের শুরু থেকেই স্থানীয় একটি দৈনিকের সম্পাদক ও ফরিদপুর প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতির নেতৃত্বে দৈনিক ইনকিলাবের তৎকালীন ফরিদপুর সংবাদদাতা আনোয়ার জাহিদ(চাঞ্চল্যকর কামাল-হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে এখন ফরিদপুর কারাগারের কয়েদি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক ব্যবসা, অবৈধ দখল, ত্রাণের টিনসহ সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ ও একাধিক নারী কেলেঙ্কারি মামলার আসামি)এবং অন্য কয়েকজন অপসাংবাদিক ও সাংবাদিক নামধারী এ ষড়যন্ত্র শুরু করেন। আমরা যখন মিডিয়ার মাধ্যমে বিএনপি-জামাতের রোষানলে বিপন্ন মানবতাকে বাঁচাতে মাঠে, তারা তখন নির্যাতনকারীদের পক্ষে আমাদের সংবাদকে মিথ্যা-অতিরঞ্জিত, রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট প্রমাণে, আমাদের চরিত্র হননে ব্যস্ত।

২০০২ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে স্থানীয় ওই দৈনিকের সম্পাদক তার পত্রিকায় আমাকেসহ উপরোল্লেখিত অন্য সাংবাদিকদের জড়িয়ে ‘উজবুকদের সাংবাদিকতা’, ‘অন্যের বেলায় দোষ’, ‘হায় সাংবাদিকতা’ ইত্যাদি শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু মিথ্যা ও নোংরা সংবাদ প্রকাশ করেন। জোট সন্ত্রাসীদের অত্যাচার-নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গাওয়াসহ আমাদের পাঠানো সংবাদ-প্রতিবেদনের তথ্য-প্রমাণকে বিতর্কিত করতে এবং সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও বিদ্বেষ ছড়ানো এসব সংবাদ পরবর্তী সময়ে আমাদের ওপর মামলা-হামলা ও কারা নির্যাতনসহ সাংবাদিক গৌতম দাস হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয়।

৬ আগস্ট ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ারও বেশ কদিন পরে ওই নাটককে পুঁজি করে সাংবাদিক নামধারী আনোয়ার জাহিদ ও অপরাপর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ফের মাঠে নামেন ওই দৈনিকের সম্পাদক। এখানে বলে রাখি, ফরিদপুর নাট্য সমন্বয় পরিষদের তৎকালীন সংগঠক হিসেবে আমিই উদ্যোগ নিয়ে নাটকটির প্রতিবাদকারী প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদের উপস্থিতিতে সমন্বয় পরিষদের সভাসহ নাটকটির নাট্যকার ও কলাকুশলীদের নিয়ে বেশ কয়েকটি সভা-বৈঠক করে ১০ আগস্টের মধ্যেই বিষয়টির সাংগঠনিক বিচার ও সুরাহা করাতে সমর্থ হই। যে কারণে বিষয়টি নিয়ে আর না এগোনোর সিদ্ধান্তও জানিয়েছিলেন ধর্মীয় নেতারা।

কিন্তু ওই চক্রটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টি করে শহরের চকবাজার জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মোমাজ্জাদ হোসাইন এবং ইসলামী ঐক্যজোট নেতা জামিয়া আরাবিয়া শামসুল উলুম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মোহাম্মদ আব্দুল কাদিরকে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ক্ষেপিয়ে তোলে। এই মুফতি কাদিরই ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটকের লেখক-নির্দেশকসহ কলাকুশলীদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন। পরে তা মামলায় রূপান্তরিত হয়, মোট ৩২ জনকে আসামি করে তদন্তকারী কর্মকর্তার চার্জশিট দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

এ ব্যাপারে পরে মাওলানা মোমাজ্জাদ হোসাইন অকপটে স্বীকার করেন, ওই মহলটিই তাকে ওই সময় প্রভাবিত করে মাঠে নামিয়েছিলো। তিনি আরো বলেন, ‘আমি তো টিভি দেখারই সময় পাই না, নাটক দেখবো কিভাবে? ওই সাংবাদিকরাই বলে বলে আমাকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে’। মামলার বাদী মুফতি কাদিরও বলেন, আমি নাটকটি দেখিনি। অন্যদের কাছ থেকে শোনার পর সবকিছু করেছি’ (সূত্র: পূর্বোক্ত)।

১৮, ১৯ ও ২০ আগস্ট দৈনিক ইনকিলাবে সাংবাদিক নামধারী আনোয়ার জাহিদকে দিয়ে মঞ্চস্থ নাটকটির অন্যতম আয়োজক হিসেবে আমাকে ও সহযোগী হিসেবে সহোদর অমরেশ রায়কে জড়ানোর জন্য ধারাবাহিক মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করানো হয়। পরে জেনেছি, ওই সম্পাদক নিজের পত্রিকা কার্যালয়ে এর আগের রাতেই আনোয়ার জাহিদ ও অন্যদের সহ গোপন বৈঠক করে ইনকিলাবে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরকে গ্রেপ্তার করিয়ে কারাগারে পাঠানোর সমস্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু কোতোয়ালি থানার তৎকালীন নীতিবান ওসি তাদের নির্দেশনা না মানায় তা সফল হয়নি।

এদিকে ইনকিলাবে সংবাদ প্রকাশের প্রথম দিনই আমরা দু’ভাই মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় এবং এর বিহিত কামনা করে ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি হিসেবে ওই সম্পাদককেই লিখিত আবেদনপত্র দেই। এর মাত্র ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই ওই সভাপতি কোনো রকম সভা কিংবা কারণ দর্শানো নোটিশ প্রদান ছাড়াই সম্পূর্ণ অগঠনতান্ত্রিক ও অবৈধভাবে আমাদের দুজনকে ক্লাবের সদস্যপদ স্থগিত করে চিঠি ধরিয়ে দিয়ে নিজেকে সব ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবে প্রকাশ্য করেন।     

একই ধরনের আবেদন ও চিঠি বার বার জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে দেওয়া এবং কোতোয়ালি থানায় কয়েকবার জিডি করা সত্ত্বেও নিরাপত্তার পরিবর্তে পেয়েছি জেলযাপন!  

এরপর ওই সম্পাদকসহ চক্রটি নতুন পরিকল্পনা আঁটেন। বলা হতে থাকে, ওই নাটকটির রচয়িতা আমি এবং নাটকের পাণ্ডুলিপিতে আমার ও অমরেশ রায়ের হাতের লেখা থাকাই এর প্রমাণ। ২০ আগস্ট থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ওই স্থানীয় দৈনিক এবং দৈনিক ইনকিলাবে এ বিষয়ে মিথ্যা ও সাজানো রিপোর্ট-ছবি প্রকাশ করা হতে থাকে।

এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক ওই নাটকের সঙ্গে আমাদের দু’ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা সে ব্যাপারে তদন্ত করতে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি করে দেন। অবশ্য এর আগেই প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নানা তদন্তে আমরা নির্দোষ প্রমাণিত হই। ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর ওই কমিটি ফরিদপুরের প্রতিনিধিত্বশীল অর্ধশতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ করে। আজ পর্যন্ত ওই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে না আনা হলেও এজাহারভুক্ত ৩২ জন ছাড়া আর কেউই অর্থাৎ আমরা দু’জন নাটকটির কোনো পর্যায়েই সংশ্লিষ্ট নই এ মর্মে কমিটি জেলা প্রশাসকের কাছে রিপোর্ট দেন। কিন্তু ওই একই চক্র নানাভাবে চাপ প্রয়োগসহ ফের মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ ও সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রিপোর্টটি ধামাচাপা দিয়ে ফেলে(সূত্র: পূর্বোক্ত)।

ওই কমিটির কাছে আমরা দু’জন হাতের লেখার নমুনা লিখে দেওয়াসহ নাটকটির সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করি। সাক্ষ্যদাতা অন্যদের প্রায় সবাই আমাদের সমর্থন করেন। অথচ ওই সম্পাদকসহ তার ২/৩ জন সাংবাদিক নামধারী সহযোগী পাণ্ডুলিপিতে আমাদের হাতের লেখা থাকার মিথ্যা তথ্য দিলে মৌলবাদী চক্রের ষড়যন্ত্র এবার নতুন মাত্রা পায়।

এরপর আসে সেই চূড়ান্ত ক্ষণ। ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে আমাদের দুজনকে আবারও হাতের লেখার প্রমাণ দেওয়ার কথা বলে কোতোয়ালি থানায় ডেকে নেওয়া হয়। সেখান থেকে পুলিশি প্রহরায় আদালতে এনে নানা অজুহাতে বিকাল পর্যন্ত বসিয়ে রেখে বিকেলে হাতের লেখা নেওয়ানোর নাটক করা হয়।

এরপর সন্ধ্যায় হাতের লেখার নমুনাসহ আদালতে আমাদের ওঠানো হলেই ম্যাজিস্ট্রেট লেখা পরীক্ষার দিকে গেলেন না! নাটকীয় কায়দায় ‘কথাকৃষ্ণকলি’ নাটক সংক্রান্ত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আগে থেকেই কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা একটি জিডি(!) আদালতে উপস্থাপন করে আমাদেরকে নিরাপত্তা হেফাজতে জেলখানায় পাঠানোর আবেদন জানান। আবেদনে বলা হয়, দু’দিন পরে ২৫ সেপ্টেম্বর শহরের জনতা ব্যাংকের মোড়ে ‘কথাকৃষ্ণকলি’ মঞ্চায়নের বিচার চেয়ে ডাকা জনসভার জন্য আমরাই নাকি হুমকি!

আমাদের দুজনকেই সন্ত্রাসী ও শান্তি-আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী উল্লেখ করে উল্টো আমাদেরকই কারাগারে পাঠানোর হাস্যকর আবেদনের বিরোধিতা করেন তাৎক্ষণিকভাবে হাজির হওয়া আইনজীবীরা। তখন আবেদন ঘুরিয়ে বলা হয়, আমিনীর সমাবেশের জন্য আমাদেরই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে! তাই পাঠাতে হবে কারাগারে!

এ সময় আদালতে উপস্থিত আইনজীবী, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের পাশাপাশি ফরিদপুর পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রয়াত হাসিবুল হাসান লাবলু এ আবেদনের বিরোধিতা করে আদালতে জানান, কোনো সুস্থ মানুষ নিজে থেকে না চাইলে তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়া যায় না। কারো নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে রাষ্ট্রই তাকে পুলিশি নিরাপত্তা দেবে। তা না করে উল্টো জেলে পাঠানো বেআইনিই শুধু নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আইনের বিকৃতি ও অপপ্রয়োগ।    

পৌর চেয়ারম্যান প্রয়োজনে তার হেফাজতে আমাদের দেওয়ার আবেদন জানিয়ে বলেন, জনগণকে নিয়ে তিনিই আমাদের নিরাপত্তা দেবেন। ম্যাজিস্ট্রেট এ পর্যায়ে আমাদের কাছেই জানতে চান, আমরা নিরাপত্তা হেফাজত চাই কিনা? আমরা বার বার এর বিরোধিতা করা সত্ত্বেও ম্যাজিস্ট্রেট নিরাপত্তা হেফাজতের নামে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে তড়িঘড়ি করে এজলাস থেকে নেমে যান।    

তৎকালীন মন্ত্রী শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের নির্দেশে ঢাকার একজন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে আমাদের যে কোনো প্রক্রিয়ায় জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিলে তারা পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন বলে পরে জেনেছি। আমাদের সারাদিন পুলিশ দিয়ে একরকম ঘিরে রাখা, আদালত চত্ত্বরে বার বার পুলিশের মাইক্রোবাসের আনাগোনা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি জানতে চাওয়া ও তদারকি করা, আদালতের নির্দেশের পর ওই মাইক্রোবাসেই তড়িঘড়ি করে কারাগারে পাঠানো এবং আগেভাগেই জেলের নির্ধারিত সেল তৈরি করে রাখাসহ সারাদিনের পরিবেশ, পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের আচরণ, সহকর্মীদের সতর্কবাণী ইত্যাদি মিলিয়ে আগেই অবশ্য বুঝে গিয়েছিলাম, গ্রেপ্তার হতে যাচ্ছি!    

এভাবে জেলে পাঠানো অবৈধ ও আইন বহির্ভূত বুঝতে পেরে ওই রাতেই আমাদের বানানো হয় ৫৪ ধারার সন্দেহভাজন আসামি। ৫৪ ধারার নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জেলে আটকে রাখার পর ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে জেনে করা হয় নাটক সংক্রান্ত মূল মামলার আসামি।

এ কারণে জেলের বাইরে মুক্ত জীবনে আসতে আমাদের দিনের পর দিন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও জজকোর্টে পৃথক কিন্তু পরস্পরবিরোধী ৩টি মামলা ও আইনের ধারায় লড়তে হয়েছে দিনের পর দিন। পরিবারকে ছুটে যেতে হয়েছে ঢাকায় হাইকোর্টে।

আইনের এ রকম বিকৃতি ও অপপ্রয়োগ করে বিনা দোষে ও বিনা বিচারে টানা ৮৩ দিন কাউকে জেলের ঘানি টানানোর দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ কেউ দিতে পারবেন কি?

উল্লেখ্য, জেলে পাঠানোর আগ পর্যন্ত আমরা দুজন ওই মামলার আসামি ছিলাম না। পুলিশ প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়, হাতের লেখার মিল থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে আমরা আসামি হবো। আজ পর্যন্ত সে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অথচ আমরা কারাগারে থাকতেই আমাদের মামলার সম্পূরক চার্জশিটভুক্ত আসামি বানান তদন্তকারী কর্মকর্তা।

আবার সম্পূরক চার্জশিটে হাতের লেখা সংক্রান্ত অভিযোগের (প্রমাণ নয়!) ভিত্তিতে মামলার নতুন চার সাক্ষী বনে যান ওই স্থানীয় সম্পাদক, সাংবাদিক নামধারী আনোয়ার জাহিদ ও তাদের সহযোগী অন্য দুই সাংবাদিক(!)। আবার তারাই আমরা যেন জেল থেকে বের হতে যেন না পারি সে লক্ষ্যে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশসহ নানা অপতৎপরতা প্রকাশ্যেই অব্যাহত রাখেন।

তারাই সাংবাদিক প্রবীর সিকদার ও গৌতম দাসকেও জেলে পাঠানোর নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে ওই স্থানীয় দৈনিক ও ইনকিলাবে মি্থ্যা সংবাদ প্রকাশ করে ও প্রকাশ্য অপতৎপরতার মাধ্যমে। এবার তাদের দুজনকে জড়ানো হয় সে সময় বাংলাদেশে আসা বিদেশি সাংবাদিকদের কথিত রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের সঙ্গে। তারা এ ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে রক্ষা পান।

২৫ সেপ্টেম্বর আমিনীর জনসভা থেকে তিনিসহ অন্যরা প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেন ৫ সাংবাদিকসহ পৌর চেয়ারম্যান লাবলুকে। এবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে অশ্লীল গালাগালসহ তাকেও হুমকি দিয়ে এবং ভারত ও হিন্দুদের এ ব্যাপারে জড়িয়ে নতুন সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেন আমিনী। তিনি পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও ব্লাসফেমি আইন পাসের হুমকি দেন।

পরে জাতীয় পত্র-পত্রিকাগুলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানিয়েছিলো, সে সময় জোট সরকারের মন্ত্রিত্ব পেতে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করা ও খালেদা জিয়াকে প্রভাবিত করতেই ‘কথাকৃষ্ণকলি’ ইস্যু নিয়ে মাঠে নামেন। মাঠ গরম করতে স্থানীয় ওই সম্পাদক ও তার সহযোগীদের কাজে লাগান আমিনীও।      

ওই সাংবাদিক নামধারীরা এভাবেই বার বার প্রমাণ করে গেছেন, আমিনী-মুজাহিদদের ইন্ধনে আইনের চরম অপপ্রয়োগ করে আমাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত এ কারা নির্যাতনের মূল ষড়যন্ত্রকারী তারাই।    

ঢাকার বাইরের সাহসী পরিশ্রমী, সৎ, বস্তুনিষ্ঠ, মানব কল্যাণকামী, আদর্শবান, চেতনায় বলীয়ান সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার এখন মূল্যায়ন করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে। সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজ এ ব্যাপারে অগ্রণী হয়ে তাদের পক্ষে নিচ্ছে প্রশংসনীয় ভূমিকা। বেশ কিছুদিন ধরেই ‘মফস্বল সাংবাদিক’ হিসেবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার এই প্রকৃত কলম সৈনিকদের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরে তাদেরকে পাদপ্রদীপের আলোয় তুলে আনছে বাংলানিউজ।

কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠের কথাও বলতে হবে। সামান্য কজন অপ ও হলুদ সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নামধারীর জন্য প্রকৃত কলম সৈনিকদের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। যেমনটি হয়েছিলাম ৯ বছর আগে আমরা দুজনসহ ফরিদপুরের প্রগতিশীল সাংবাদিকেরা।

যশোরের দেশবরেণ্য সাংবাদিক শামছুর রহমান কেবল, ফরিদপুরের গৌতম দাসসহ অন্য সাংবাদিক হত্যার পেছনেও সাংবাদিক নামধারী এসব চক্রের নাম এসেছে বারবার।

তাই, এ চক্রেরও মুখোশ খুলে দিয়ে প্রকৃত সাংবাদিক ও সাংবাদিকতাকে বাঁচানোর সময় এসেছে। সময় এসেছে আংশিক নয়, পুরো সত্য প্রকাশেরও।          

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।