ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

অন্য রকম এক সফর

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১২
অন্য রকম এক সফর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর উপলক্ষে বাংলানিউজে শামীম খানের পাঠানো প্রতিবেদনগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম। আগরতলা থেকে ফিরে শামীম আবার লিখতে পারবেন পুরো সফরের রাউন্ডআপ।

ত্রিপুরা প্রতিনিধিও লিখতে পারবেন বিরল বিশেষ এই সফরকে কেন্দ্র করে আগরতলাবাসীর প্রাণের কথা।

এই প্রথম বিদেশি কোনো সরকার প্রধানের বিমান গিয়ে নেমেছে আগরতলা বিমান বন্দরে! দু’দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী যেখানে গেছেন, সেখানেই তাকে দেখতে ভিড় করেছেন শুধু মানুষ আর মানুষ! তাদের হাতে বাংলাদেশ আর ভারতের পতাকা।

ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতির কারণে আমি রিপোর্টগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়েছি। ‘একাত্তরের আগরতলা’ শিরোনামের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদনের কাজে এক সময় মাসাধিককাল সেখানে চষে বেড়িয়েছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সামরিক রাজধানী এই আগরতলা। এমনকি মুজিবনগর সরকার গঠনের সিদ্ধান্তও আগরতলা সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নেওয়া হয়। জেনারেল ওসমানী, মেজর জিয়া, খালেদ মোশাররফসহ সামরিক ব্যক্তিদেরও সেটি মূল বিচরণভূমি ছিল।

একাত্তরে খালেদা জিয়াকে আগরতলা নিয়ে যেতে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান সানিকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন জিয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জিয়ার চিঠি হাতে খালেদার কাছেও পৌঁছেছিলেন সানি। কিন্তু খালেদা তার সঙ্গে যেতে রাজি হননি। মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর ছোটভাই মুক্তিযোদ্ধা সানি এখনও বেঁচে আছেন। ঢাকায় আছেন। একাত্তরের সেই উত্তাল সংগ্রামের দিনগুলোর অনেক অনেক স্মৃতির সে শহর নিয়ে লেখা ‘একাত্তরের আগরতলা’ পরে বই আকারে বের করে ঢাকার নওরোজ কিতাবিস্তান।  


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মান সূচক ডিলিট ডিগ্রি দিয়েছে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে এখন বিশ্ববিদ্যালয়, একাত্তরে সেটি ছিল  মুক্তিযোদ্ধাদের বড় একটি ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত-ঘাম সে মাটিতে মিশে আছে। কিন্তু আমার কাছে সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া গণ সংবর্ধনার বিষয়টিকেই বেশি উজ্জ্বল প্রাণোচ্ছল মনে হয়েছে। জনসভার মতো কানায় কানায় পরিপূর্ণ বিশাল আসাম রাইফেলসের ময়দান। সেখানে বাংলাদেশ-ভারতের পতাকা হাতে হাজার হাজার নারী-পুরুষ!

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানাও ছিলেন।   আগরতলার মানুষজন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বা তার বোনকে না, তারা আসলে সেখানে দেখতে গেছেন ‘শেখ মুজিবরের মেয়েদের’! যিনি-যারা তাদের মা-বোনের মতো শাড়ি পরেন। বাংলায় কথা বলেন। তাদের পিতা শেখ মুজিবুরের কথা সেখানকার সিনিয়ররা চল্লিশ বছর আগে শুনেছেন। জুনিয়ররা শুনেছেন সিনিয়রদের মুখে। সেই অমিতসিংহ পুরুষের কথা! যিনি এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এক বক্তৃতার মাধ্যমে জাগিয়ে তুলেছিলেন একটি জাতিকে!

শামীম খানের রিপোর্টে ছিল, প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে আগরতলার রাস্তায় রাস্তায় বাজানো হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ভারতীয় একটি রাজ্যের রাজধানী শহরে এমনটি আশা করার কথা না। কিন্তু বাস্তবতাটি অন্যখানে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সেখানকার মানুষজনের  নাড়ির টান জড়িয়ে আছে। দেশ দুটি ঠিক। কিন্তু সে বাঁধন ছিন্ন করার নয়।


ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের বেশিরভাগ মন্ত্রীর পূর্বপুরুষের জন্মস্থান বাংলাদেশ। কুমিল্লার রায়পুর হাইস্কুলে একবার গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানি, সেখানকার প্রাক্তন ছাত্রদের বেশ ক’জন তখন ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের মন্ত্রী! একাত্তরে সে রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ১৪ লক্ষ। ১৬ লক্ষ শরণার্থী সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এমন কোনো বাড়ি সেখানে বাদ ছিল না যেখানে এক-দু’জন শরণার্থী আশ্রয় নিয়ে ছিলেন না। শরণার্থীর চাপে সে রাজ্যের স্বাভাবিক সব কিছু ভেঙ্গে পড়েছিল। স্কুলে-কলেজে শরণার্থী শিবির গড়ে ওঠায় লাঠে উঠেছিল রাজ্যের পড়াশুনা।

আখাউড়া থেকে নিশানা করে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি ছুঁড়লে তা আগরতলা শহরে গিয়ে পড়তো। তাদের মানুষ মারা যেতেন। কিন্তু কখনো কেউ এসব নিয়ে কোনো বিরক্তি দেখাননি। উল্টো সব কিছু দিয়ে সহযোগিতা করে চেয়েছেন বাঙালির একটা স্বাধীন দেশ হোক।

আসলে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি আর আগরতলা-ত্রিপুরার বাঙালি এক না। পশ্চিমবঙ্গের নেতৃ্ত্বের বাঙালির বেশিরভাগ একটু বাবু স্বভাবের। বাবুদের মতো খালি নিতে চান, পেতে যান। ইলিশ চান, ফারাক্কা-তিস্তার পানি চান, সব চান। তাদের কথ্য ভাষাও আমাদের মতো না। আগরতলা-ত্রিপুরার বেশিরভাগ বাঙালি আমাদের মতো করে কথা বলেন। আমাদের মতো আন্তরিক। তারা দিতে জানেন। যদিও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে পিছিয়ে থাকায় তাদের দেবার সামর্থ্য কম। তাদের তুলনায় আমাদের সামর্থ্য বেশি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অকুন্ঠ সহযোগিতার বিনিময়ে তারা আমাদের কাছে কখনো কিছু চাননি। আমরাও নিজের থেকে কিছু দিতে যাইনি-চাইনি। আসলে ট্রানজিট তাদের জন্যে দরকার।

আগরতলায় একবার সে রাজ্যের বিশিষ্ট কয়েকজনকে বলেছি, আপনারা আমাদের যুদ্ধের জন্য এতো কিছু করেছেন, একটু দাবি করে বলুন, আমাদের একটু পথ দাও, আমি লিখবো, কিন্তু কেউ সেভাবে বলেননি। বলেছেন, ‘যদি দেন দাদা বড় উপকার হয়’।

এমনি বিনীত-বিনয়ী আগরতলার লোকজন। শামীম খান নিশ্চয় আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করে থাকবেন, তাহলো সেখানকার বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাদামাটা জীবন। বাংলাদেশের ইউএনও অফিসের চাইতেও সাদামাটা সেখানকার মন্ত্রীদের অফিস। ভারতের এই একটি রাজ্যেই এখনও টিকে আছে বামফ্রন্ট সরকার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জীবনে অনেক দেশ সফর করেছেন। আরও অনেক দেশে হয়তো যাবেন। কিন্তু আগরতলা গিয়ে নিঃসন্দেহে একটু ভিন্নরকম ফিল করেছেন। ফিল করেছেন চল্লিশ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধকে। সে যুদ্ধের সহযোগী মানুষগুলো, তাদের উত্তরসূরীরা এখনও কতো আন্তরিক। প্রাণোচ্ছল!

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আগরতলার গৌরি বৌদিসহ সহযোগী মানুষগুলোর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে কিনা জানি না। আগরতলার দৈনিক সংবাদ পত্রিকাটিরও অনেক ভূমিকা ছিল আমাদের যুদ্ধ সংবাদ পরিবেশনায়। তবে চল্লিশ বছর পার হবার পরও মুক্তিযোদ্ধা, শরণার্থীদের খাবার, আশ্রয়, প্রশিক্ষণসহ সবকিছু দেবার জন্য সরাসরি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি তাদের জয় করে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগরতলার রাস্তায় অথবা বিবিধ মঞ্চে অপেক্ষমাণ হাজার মানুষকে হাত নেড়ে বাংলায় বলে এসেছেন, আমি তোমাদেরই।

কৃতজ্ঞতায় ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও প্রস্তাব করেছেন, পালটানা বিদ্যুত কেন্দ্রে তারা ভাগে যে বিদ্যুত পাবেন, এর ১০০ মেগাওয়াট বাংলাদেশকে দেবেন। প্রধানমন্ত্রীও ত্রিপুরার জন্য অনেক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন। টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতেও ত্রিপুরাবাসীর নৈতিক সমর্থন টানা সম্ভব।

মোট কথা, প্রধানমন্ত্রীর আগরতলা সফর সেখানকার মানুষজনের মনে থাকবে। মনে থাকবে শেখ মুজিবুরের মেয়েদের তারা সামনা সামনি চোখে দেখেছেন।

ফজলুল বারী: সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।