ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ভাঙা বেতের জন্মদিন!

স্যার ফ্রাংক পিটারস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১২
ভাঙা বেতের জন্মদিন!

কিছু শিক্ষক দেশের জন্য লড়তে প্রস্তুত। জীবন দিতে প্রস্তুত।

কিন্তু তাদের যদি বলা হয়, বেঁচে থেকে দেশের জন্য যা সঠিক তা করুন, তা হলে মনে হবে তাদের বেশি কিছু করতে বলা হয়েছে।

যদি প্রতিহিংসা সমস্যার সমাধান করতে পারত তাহলে আগামীকালই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সমাধান হতো মল্লযুদ্ধের মঞ্চে।
Na-Cane১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর মধ্যে একটি, যা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আলোকিত অধ্যায় হিসেবে মনে রাখবে।

এটা হলো সেইদিন যেদিন (২০১০ সালের ১৭ জুলাই) মাননীয় উচ্চ আদালত, সামাজিক সচেতনতামূলক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা ব্লাস্ট এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শিশুদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে।


বিভাগীয় বেঞ্চের বিচারক মো. ঈমান আলি ও বিচারক শেখ হাসান আরিফ বাংলাদেশের স্কুল-মাদ্রাসায় কায়িক শাস্তি (শারীরিক শাস্তি) নিষিদ্ধ করেছেন এবং একে ঘোষণা করেছেন নিষ্ঠুর, অমানবিক, হীন ব্যবস্থা যা সুস্পষ্টভাবে শিশুদের জীবন ও স্বাধীনতার অধিকারের লঙ্ঘন।
যদিও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এখন আনন্দিত হয়ে এই শুভ উপলক্ষটি উদযাপন করছে। কিন্তু এটা অবাক না হয়ে পারা যায় না যে, আইনে স্বীকৃত শিশুদের এই মৌলিক অধিকারটি গ্রহণ করতে কেন ৩৯ বছর সময় লাগল। কেউ বলতে পারেন, কোনো আইনের প্রয়োজনীয়তা আদৌ ছিল কি? কেন এখানে সাধারণ শিষ্টাচার বোধ কাজ করে না যে, মানুষের সাথে নির্দয় আচরণ করা ঠিক নয়। বিশেষ করে নিষ্পাপ ও আত্মরক্ষার জ্ঞানশূন্য শিশুদের ওপর!

কবে কখন প্রতিহিংসা কোনো কিছুর সমাধান করতে পেরেছে? শিক্ষক ও প্রধানশিক্ষকদের চেতনাবোধ কি সবসময় ঘুমিয়ে থাকে? যখন নৈতিকতা, শিষ্টাচার এবং শ্রদ্ধাবোধ ভূলুণ্ঠিত হয় তখন তারা কোথায় থাকেন?

যুদ্ধের সময় দুর্বল সবলের ভৃত্য হয়ে যায় এবং শান্তির সময় গরীব ধনীর ভৃত্য হয়ে যায়। শিক্ষা হলো এযুগের মুদ্রা, যা না থাকলে আপনি গরিব এবং যার আছে তার ভৃত্য। যদি আমরা দাবি করি যে, আমরা একটি সভ্য সমাজে বাস করি তবে দৈহিক শাস্তিকে আমাদের সম্পূর্ণভাবে সমূলে বিনাশ করতে হবে। সেটাই সভ্য সমাজ যেখানে সব নারী, পুরুষ ও শিশুদের সমানভাবে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়।

১৯৭৩ সালে আমি আমার জীবনের একটি বড় শিক্ষা পেয়েছিলাম যা আমার চক্ষু খুলে দিয়েছিল। এই শিক্ষা আমাকে স্টিফেন হকিং বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেয়নি, দিয়েছিল ছোট্ট দু’টি বাচ্চা। যাদের বয়স নয়ের বেশি ছিল না। আমি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের একটি ছোটদের স্কুলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন তারা আমার মনযোগ কেড়ে নিল। একটি ছেলে আরেক ছেলের গলা চেপে ধরে তার পেটে ঘুষি মারছে। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বলতে যাচ্ছিলাম যে, ‘থামো, ওকে ছেড়ে দাও’। আমি তাদের বাধা দিতে যাওয়ার সময় শুনলাম, যে বালকটি মার দিচ্ছে তাকে অপর বালকটি চিৎকার করে বলছে, ‘তুমিই আমার বন্ধু হবে, তুমিই আমার বন্ধু হবে। ’

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি যা ভেবে রেখেছিলাম যে জোরে বলব ‘থামো’ তা বলতে পারলাম না। চিন্তার জন্য আমার সময়ের প্রয়োজন হয়েছিল। যে মূল্যবান শিক্ষাটি আমি পেয়েছিলাম তা হলো, কারও মধ্যকার ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের ওপর আঘাত করা অসম্ভব। যে মুহূর্তে কোনো মাত্রার প্রতিহিংসা প্রয়োগ হয় তখনই শ্রদ্ধাবোধ চলে যায় এবং আর ফিরে আসে না।

শারীরিক শাস্তিকে ভুলবশত শাসনের সমতুল্য ধরা হয়। কিন্তু শাসনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বিপরীতক্রমে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বহুল প্রয়োগে বয়ে আনে বেদনা, অবমাননা এবং লঙ্ঘন করে শিশু অধিকারকে। এটা শিক্ষা দেয় ঘৃণা, উগ্রতা, গ্লানি, প্রতিশোধ স্পৃহা এবং অশ্রদ্ধা। আর যদি এই সমাজ আপনারা চান, তবে আপনারা এটাকে লালন করে যেতে পারেন।

যদি শিক্ষকরা প্রতিহিংসার শিক্ষা দেয়, শিশুরা তাই শিখবে। কেননা, শিশুরা তাদের বিশ্বাস করে।
Na-Cane

বাংলাদেশের সর্বত্রই প্রতিহিংসার একই রূপ। জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রতিহিংসার বর্ণনামূলক প্রতিবেদনে পরিপূর্ণ থাকে। আমরা সেই ভয়াবহ খবরগুলো পড়ি এবং সেই সব মারাত্মক ছবিগুলো দেখি যেখানে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাপাতি, হকি খেলার লাঠি, দা, বেসবল ব্যাট এবং অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এগুলো ছোটবড় কাটা-ছেঁড়া ও রক্ত ঝরাতে ব্যবহৃত হয়। আমাদের প্রশ্ন জাগে, প্রকৃতপক্ষে তারা কি শিখছে?

আমি অভিভাবকদের একটি বিষয়ে চিন্তা করতে বলি, যারা তাদের জীবনের সব কষ্টার্জিত সঞ্চয় তাদের সন্তানের পিছনে ব্যয় করছেন, তারা কি একবারও অনুভব করেছেন যে তারা তাদের কষ্টার্জিত অর্থ প্রতারণার পিছনে ব্যয় করছেন এবং বিনিময়ে কী পাবেন? প্রতিহিংসা ও সামাজিক বদ অভ্যাসের ডিগ্রি?

আমি নিজেকেও প্রশ্ন করি, এই পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলার জন্য কি ভূমিকা রাখবে? যদি এতে শুধু রাজনৈতিক প্রভাব থাকে অথবা উভয়ই থাকে।

এটা জানা কথা যে, প্রতিহিংসা কোনো কিছুর সমাধান করতে পারে না। যদি প্রতিহিংসাতেই সমাধান হত তবে দেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সমাধান আগামীকালই মল্লযুদ্ধের মঞ্চে সমাধান করা যেত। কিন্তু তারা অনেক বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত যে তারা এ বিষয়ে নিজেদের অত্যন্ত ছোট করা থেকে বিরত রয়েছেন।

যখন বাংলাদেশের হাজারো শিশু ১৩ জানুয়ারিকে শারীরিক শাস্তি দূরীকরণ দিবস হিসেবে উদযাপন করছে, তখন আমরা লক্ষ্য করি যে, এটি এখনও ঘটছে যা দুঃখজনক হলেও সত্যি। আইন বা অন্য কিছু এবং প্রয়োজনে যদি শিশুদের স্বার্থের বিষয়টি উল্লেখ করতে হয় তবে শিশুদের ও জাতির মঙ্গলের জন্য এটা বন্ধ করতে হবে।

এটা জরুরি যে, উচ্চ বিবেকবোধ সম্পন্ন শিক্ষকরা তাদের পেশা এবং তাদের নিজেদের মর্যাদা রক্ষার্থে বিদ্যালয়ে এই বিষয়ের বিরুদ্ধে কথা বলবেন এছাড়া যথার্থ  উদাহরণ দিয়ে শিক্ষা দেবেন কোনটি সঠিক, কোনটি শিষ্টাচার।

কিছু শিক্ষক দেশের জন্য লড়তে প্রস্তুত, দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু যদি তাদের বলা হয়, বেঁচে থেকে দেশের জন্য সঠিক কিছু করো। তবে মনে হতে পারে তাদের বেশি কিছু করতে বলা হয়েছে। ২০১১ সালে যে পরিবর্তনটি শুরু হয়েছিল, ২০১২-তে সবার স্বার্থে আমি সেটি চলমান দেখতে চাই। সর্বোপরি, পরবর্তী ৪০ বছর পর এই পবিত্র মাটিতে কোনো শিক্ষার্থী চাপাতি, হকি খেলার লাঠি, দা, বেইসবল খেলার লাঠি ইত্যাদি বহন করবে না।

অনেক মানুষের (বিশেষত ইসলামী দেশগুলোতে) প্রাপ্য অনুযায়ী তাদের সম্মানে হয়তো কখনো কোনো খাড়া ভাস্কর্য তৈরি হবে না। কিন্তু তাই বলে এটা বলা যাবে না যে, তাদের কম মূল্যায়ন করা হয়েছে। আমরা যাদের ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি ও সম্মান করি এবং তাদের কোনো দৃশ্যমান ভাস্কর্য তৈরি করি না (যেমন আমাদের বাবা-মা, আমাদের ভালোবাসার মানুষ এবং যাদের আমরা জানি এবং শ্রদ্ধা করি), তবে আমাদের হৃদয়ে তাদের ‘ভাস্কর্য’ বহন করার জন্য কোনো বাধা থাকে না। যেখানে যাকে প্রয়োজন তাকে সেখানে তাদের কৃতিত্ব দিতেই হবে।

বিচারক মো. ঈমান আলি ও বিচারক মো. শেখ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সামাজিক সচেতনতামূলক প্রতিষ্ঠান আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা ব্লাস্ট এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ভাস্কর্য আমার মনের ভেতর বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি তাদের সেই ভাস্কর্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, সম্মান জানাচ্ছি। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তারা যথার্থ অবদান রেখেছেন। আমি বাংলাদেশের সব শিশুর পক্ষ থেকে তাদের দিতে চাই অজস্র ধন্যবাদ এবং বজ্র উল্লাস ধ্বনি।

স্যার ফ্রাংক পিটারস : পত্রিকা ও সাময়িকীর সাবেক প্রকাশক ও সম্পাদক, আন্তর্জাতিক কলাম লেখক, মানবাধিকারকর্মী, ইউরোপ এবং সৌদি বাদশাহর ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের বন্ধু।

বাংলাদেশ সময় : ১২৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।