১২ মার্চ কী ঘটতে যাচ্ছে? ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে চারদলীয় জোট আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ১২ মার্চ ‘চলো চলো, ঢাকা চলো’-কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এদিন রাজধানীতে মহাসমাবেশ হবে।
রোডমার্চ শেষে চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকে তিনি সরকারকে ব্যর্থ উল্লেখ করে অবিলম্বে পদত্যাগ করে জনপ্রিয়তা যাচাই করারও আহবান জানিয়েছেন।
‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা’ ফিরিয়ে আনার দাবিতে এখনও অনড় বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে বসে খালেদা জিয়া সবার আগে ওই ব্যবস্থা পুনর্ববহালের জোর দাবি করেছেন। ১৩ জানুয়ারি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল না হলে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ সফল হবে না। এই মুহূর্তে জাতির প্রধান ইস্যু তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেটা না হলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। এ নিয়ে অতীতেও পরিস্থিতি সংঘর্ষের দিকে গেছে, ভবিষ্যতেও যেতে পারে। ’
এমন আশঙ্কা ড. কামাল হোসেন ও ড. আকবর আলি খানেরও। তারাও বিষয়টি নিয়ে আশু রাজনৈতিক উদ্যোগ আশা করেন। এর অর্থ, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের আশায় রয়েছে। সেসঙ্গে ১২ মার্চকে তারা সরকারের জন্যে একটি ‘সতর্ক বাণী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
গেল বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের একটি কর্মসূচির পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। তাতে সায় ছিল জামায়াতসহ চার দলীয় জোট শরিকদের। জোটের শরিকদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সবশেষ বৈঠকে জামায়াত, বাংলাদেশের জাতীয় পার্টি (বিএজপি)সহ অন্য ইসলামি দলগুলো এখনি সরকার পতনে ‘অলআউট’ কর্মসূচি দেওয়ার জন্যে বিরোধী দলের নেতার ওপর চায় দেয়। একের পর এক হরতালসহ ঢাকায় অবস্থান নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়। তবে বেগম জিয়া তাদের মানাতে সমর্থ হন যে- এখনি নয়। সরকারকে আরেকটু সময় দিতে হবে।
নতুন বছরের ৬ জানুয়ারি চতুর্থ বর্ষে পা রেখেছে মহাজোট সরকার। তাহলে আন্দোলনের সেই সময় কি এসে গেছে? ১২ মার্চ কি ঢাকাকে অচল করার পরিকল্পনা রয়েছে বিরোধী দলের? এনিয়ে উদ্বিগ্ন গোয়েন্দারা- যদিও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা নাসিম বলেছেন, দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
১২ মার্চ ঘিরে ধংসাত্মক প্রস্তুতি জামায়াতের!
তবে ১২ মার্চকে ঘিরে রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় বড় কিছু ঘটবে এমন আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রমাণ নিকট অতীতে দিয়েছে বিএনপির প্রধানমিত্র হিসেবে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী। ১৮ ডিসেম্বর জামায়াত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাণ্ডব চালায়। তারা বোমাবাজি করে, বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করে। পুলিশের ওপরও চড়াও হয় তারা।
বিশ্লেষকদের মতে- এটা ছিল তাদের এক ধরণের মহড়া।
১১ জানুয়ারি বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি যখন বঙ্গভবনে হাস্যোজ্জ্বল পরিবেশে সংলাপ করছিলো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দিতে আসা জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে জেলে আটক রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেদিন জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা প্রতিবাদ মিছিল করেছেন। জামায়াত শিবির- জঙ্গিমিছিল করেছে পল্টনে। পরের দিন জামায়াত শিবির ক্যাডাররা দৈনিক বাংলা মোড়ে অতর্কিতে হামলা করে রক্তাক্ত করেছে এক পুলিশ অফিসারকে। ছিনিয়ে নিয়েছে তার অস্ত্রও।
এনিয়ে আরও ধংসাত্মক প্রস্তুতি জামায়াতের রয়েছে এটা জানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
জামায়াত এদেশের স্বাধীনতা-মানুষ কারও কাছেই দায়বদ্ধ নয়
জামায়াত তার অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া। এদেশ, এদেশের স্বাধীনতা, এদেশের মানুষ কোনও কিছুর কাছেই তারা দায়বদ্ধ নয়। তবে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি রাজনীতিকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে শঙ্কিত সচেতন মহল। তারা বলছেন, নতুন করে বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে। গত ৩ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ অবলম্বন ও বিচার বন্ধের দাবি জানিয়ে বিএনপি নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে এবং রাজনীতিকে নতুন করে সংকটের পথে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সবাই। এতে করে স্বাধীনতার পক্ষ অবলম্বনকারী দল অর্থাৎ নিরপেক্ষ মানুষের সমর্থন হারিয়েছে তারা।
প্রায় ৩ কোটি নতুন ভোটারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়
বিএনপি ভুলে গেছে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রায় ৩ কোটি নতুন ভোটার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে ভোট দিয়েছে। তাই এ বিচার থেকে সরে আসার কোনো পথ খোলা নেই কারও জন্যে।
সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দৃঢ় অবস্থানের কথা আবারও বলেছেন। যত বাধা আসুক এই বিচার তার সরকার করবেই। আর এ সরকারের মেয়াদেই প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে এ কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
এই যখন পরিস্থিতি তখন বিরোধী দলের ঢাকা চলো কর্মসূচির ওপর নজর এখন সবার। বিএনপি তাদের জোট সম্প্রসারণ করে কঠোর আন্দোলনে নামবে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্তকারীরা সরকারেও তৎপর!
এর বাইরে আরও খবর আছে। কিছুদিন আগে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল বিরোধী দল নয়, খোদ সরকারের মধ্যেও একটি অংশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিবেদনটি গত মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেওয়া হয়। এ রিপোর্টের আলোকে গত ১৯মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান সিকদার, পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস ও আইনসচিব শহিদুল করিমকে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
‘মানবতা বিরোধীদের বিচার স্বাধীনভাবে করা প্রসঙ্গে’ শিরোনামের গোপন ওই প্রতিবেদনে ১৭টি পরামর্শ দেওয়া হয়। তার একটিতে বলা হয়েছে, বিএনপির একটি অংশ, জামায়াতে ইসলামি এবং তাদের মিত্ররা অনেক আগে থেকেই কোটি কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা এবিচারের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে জনমত সৃষ্টির জন্যে ১৯টি বই প্রকাশ করেছে। ৮টি বই প্রকাশের অপক্ষায়। এছাড়া আরবী ভাষায় ২টি ও ইংরেজিতে ৪টি নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজও চলছে।
বিচার ঠেকাতে করা হবে বিমান ছিনতাই!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার আগে-পরে বড় ধরণের নাশকতার আশংকা করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, দুষ্কৃতকারীরা আন্তর্জাতিক রুটে বাংলাদেশের বিমান ছিনতাই করে যাত্রীদের জিম্মি করে আটককৃতদের মুক্তি দাবি করতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের জন্যে নিরাপদ দেশ হতে পারে মালয়েশিয়া কিংবা মধ্যপাচ্যের যে কোনও দেশ। এবিষয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দানজরদারিসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে পাইলটসহ বিমান-ক্রুদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, পারিবারিক ইতিহাস তলিয়ে দেখারও তাগিদ রয়েছে প্রতিবেদনে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ জামায়াতের যেসব নেতা জেল হাজতে রয়েছেন তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গিসহ নানা ধরণের অপরাধীচক্রের দাগী সদস্যদের অনেকে কারাবান্দী আছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তারা যে কোনো আত্মঘাতি ঘটনা ঘটাতে পারে।
‘সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সবই সম্ভব’
গোয়েন্দা রিপোর্টে আটককৃতদের আদালতে আনার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের তাগিদও দেওয়া হয়েছে। ‘সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সবই সম্ভব’ মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি নারায়ণগঞ্জ কারাগারে থাকাবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন।
রিপোর্টে বিষয়টি তদন্ত এবং তাদের সংশ্লিষ্ট কক্ষ ও স্থানগুলোতে সিসিটিভি স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। নইলে টাকা দিয়ে তারা সবাইকে হাত করে নিতে পারে বলে আশংকার কথা জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোনো দলীয় এজেন্ডা নয়, এটা গোটা দেশ ও জাতির দাবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ সম্পর্কে দেশে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি স্বচ্ছ ধারণা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতেও বলা হয়। এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তাই বিএনপি এবং সরকার বিরোধী দলগুলোর ভেতর যারা মুক্তিযোদ্ধা আছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবিষয়ে সমর্থন আদায় করার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, ১৪ জানুয়ারি, ২০১২