দীনেশ আমার বন্ধু ছিলো, এ দাবি আমি করতে পারি না। বন্ধুর প্রতি অনেক দায় থাকে।
দীনেশ কী আমার সহকর্মী ছিলো? ছিলো কিছু দিন। ৪৭ দিলকুশার সাততলাটি অনেক দিন ধরেই খুব বিখ্যাত। সাপ্তাহিক ঢাকা নামে একটা পত্রিকা বের হতো গেল শতকের আটের দশক থেকে। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী কলাম লিখতেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখতেন ‘নির্গুনের জার্নাল’। কবি মাসুক চৌধুরী, ব্যাংকার মাহফুজুর রহমান (রাজাকারের ডায়েরি খ্যাত), সাংবাদিক নঈম নিজাম, আশীষ সৈকত, মোস্তফা কামাল- আরও কতজন একসময় যুক্ত ছিলেন এর সঙ্গে।
১৯৮৮-৮৯ হবে। আমার যোগাযোগ ‘ঢাকা’র সঙ্গে। পড়াশোনা আর ঘুরে-ফিরে রিপোর্ট করি। ঢাকার প্রায় সব কাজ করে দীনেশ। লেখা থেকে পেস্টিং পর্যন্ত সব জানতো ও। অনেক উত্থান-পতন হয়েছে ‘ঢাকা’র। কখনো ৩২ পৃষ্ঠা নিউজপ্রিন্ট। আবার তা নেমে এসেছে ১৬ পৃষ্ঠায়। অর্থনৈতিক দৈন্য সওয়ার হয়েছে। হাল ছাড়েননি ইউনুস ভাই। এখন সাপ্তাহিক ঢাকা দৈনিক হয়েছে। ইউনুস ভাই লেগে আছেন, সেই আগের মতো। দিলকুশা, মতিঝিল, গুলিস্তান কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চলতে গেলে পথে তার সঙ্গে দেখা হয়। হাঁটছেন একা। এই শহরে এমনি অনেক মানুষ আছে। লেগে থাকে একা একা।
দীনেশকে আমার খুব একা মনে হতো সব সময়। অনেক কষ্ট, অনেক সংগ্রাম। তারপরও সাংবাদিকতা ছাড়েনি ও। অনেকে সুযোগ পেলেই অনেক কিছু করে, অনেক কিছু হয়ে যায়। পেশা বদলায়। দীনেশের তেমন ইচ্ছাই ছিলো না।
আমরা কয়েকজন একবার ঠিক করলাম দেখা হলে, কথা বলে প্রশ্ন করবো না কেমন আছেন, আছ বা আছিস? বলবো খেয়েছেন সকালে, দুপুরে বা রাতে? অভাবের মানচিত্রে এর চেয়ে ভালো সম্ভাষণ আর কী হতে পারে। দীনেশের সঙ্গে দেখা হলে এটা আমরা করতাম।
অনেক কিছু বদলেছে এ শহরের, কেবল সাংবাদিকতা ছাড়া। এখনো এটা পেশার পরিপূর্ণ মর্যাদা পায়নি অথচ ঝুঁকি আছে ষোলআনা। তার মধ্যে সবচেয়ে বাজে ঝুঁকিটি হলো চাকরি হারানো। আর নিয়মিত বেতন না হওয়া। করপোরেট দুনিয়ার মালিকরা মনের আনন্দে পত্রিকা খুলে বসেছেন। তাদের অধীনে অন্যসব প্রতিষ্ঠানে নিয়মমতো বেতন-ভাতা হয়। পত্রিকার বেলায় অনিশ্চয়তা। সাংবাদিকদের বোধকরি জীবন যাপন করতে হয় না! বাংলাদেশে সাংবাদিকতার চাকরি নাকি লোকালবাসের লেডিস সিটের মতো। যে কোনও সময় আসনটি ছাড়তে হতে পারে।
এতোসব অনিশ্চয়তার মধ্যেও দীনেশ এ পেশায় টিকে থাকার ব্রত নিয়েছিলো। সংগ্রাম করছিলো। প্রিয়তম স্ত্রী আর এক কন্যাকে নিয়ে একটু ভালোথাকার জন্যে দিনমান ছুটতে হতো তাকে। ‘সাংবাদিক’ এ পরিচয়ে অনেক কিছু করা যায়। অনেকে করে। দীনেশ ওপথে হাঁটেনি। তাই বেকার যখন, তখন বন্ধুদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে একটি চাকরির জন্যে। দীনেশের শহুরে বন্ধুদের অনেকে অনেক বড় পত্রিকার বড় পোস্টে আছে। তারা ওই পদবী ব্যবহার করে বানিয়েও নিচ্ছে। গুছিয়ে নিচ্ছে আখের। এমন এক ‘বড়’ পত্রিকায় তখন আমি রিপোর্টার। দীনেশ তার বন্ধুর কাছে গিয়ে তাকে ‘তুই’ সম্বোধন করতেই বড় পোস্টের বন্ধুটির মুখ একটু কালো হয়ে যেতে থাকে। ভাবটা এমন ‘এ কোন আপদ’!
অনেক অবহেলা, অনেক অপমান। তারপরও দীনেশ থেমে থাকেনি। একচুলও সরে যায়নি তার পথ থেকে। মোনাজাতউদ্দিন নামে এই শহরে একজন ‘ঋষীসাংবাদিক’ ছিলেন। সাংবাদিকতার দায় কতো মাটিবর্তী হতে পারে তা তিনি দেখিয়েছেন। দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে মোনাজাতের। তার নামে স্মৃতি সংসদ করে সাংবাদিকদের প্রতিবছর পদক আর পুরস্কার দিয়েছে দীনেশ। নিজের চাকরি নেই। পকেটে টাকা নেই। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রতাপে ভীষণ ক্লান্ত দীনেশ। অনেক কিছু থেমে গেছে তারপরও মোনাজাত স্মৃতি সংসদের কর্মকাণ্ড থামেনি। এতে ওর এক ধরনের দায় ছিলো। ছিলো আনন্দ।
অনেক অনেক বছর দীনেশ হেঁটেছে এই শহরে। ছুটেছে। আর যেদিন এই শহরেরই এক বাস ড্রাইভার ওর প্রাণ নিলো তার একটু আগেও ছুটছিলো ও। কেন, কিসের জন্যে? আমি ভাবি। এই যে আমরা ছুটছি, কেন? বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মরার আগে, পিচঢালা পথে মুখথুবড়ে পড়ার আগে স্ত্রী আর সন্তানের জন্যে কোনও সঞ্চয় ছিল না তার। উত্তরবঙ্গের ছেলে দীনেশ। জানি না সেখানে কী কী আছে ওর। একটু অন্য রকম বেঁচে থাকার জন্যে হয়তো এই শহরে এসেছিলো দীনেশ। সেই শহরে প্রাণটাই দিতে হলো তাকে। ওর পরিনতি দেখে প্রশ্ন করি- কেন এসেছিলি এই পোড়া শহরে? আমাদের জন্যেও একই প্রশ্ন!
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪০ ঘণ্টা, ১৬ জানুয়ারি, ২০১২