জাহাঙ্গীরনগরে সম্প্রতি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে নিহত ছাত্র জুবায়েরকে নিয়ে কিছু লিখব না। এ ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক লেখা হয়েছে এবং আশা করছি আরো হবে।
সাথে একটা খুশীর খবর দিচ্ছি, গত ১৬ই জানুয়ারি সন্ত্রাসের এক গড ফাদার, সহকর্মী পিটিয়ে হাত তাতানো পেশীবহুল শিক্ষক, জাবির কুনামধন্য প্রক্টর আরজু মিয়া পদত্যাগ করেছেন। উনি ঞ যুক্ত মিয়া নন। ঞ মিঞারা নাকি বিড়ালের স্বভাবজাত শান্ত প্রকৃতির হয়। কারণ ঞ দিয়ে বিড়ালের ডাক মিঞাও মিঞাও বানানের সাথে ঞ যুক্ত মিঞার মিল রয়েছে। বিড়ালের মতো কাপুরুষ মিঞা আরজু মিয়া নন। উনি অন্তস্থ য় যুক্ত হায়েনা সদৃশ মিয়া। হায়েনার সাথে য় যুক্ত থাকায় আরজু মিয়ার সাথে স্বাভাবজাত একটা মিল খুজে পাওয়া গিয়েছে। যে থাবা তিনি সহকর্মীর শরীরে মেরেছেন তাতে তাকে হায়েনা না বললে হয়না।
সে যাই হোক, এতো দূরে বসে বলতে পারছি না যে, এতেই সেখানকার ছাত্র শিক্ষকরা খুশী হয়ে মিষ্টি বিতরণ করতে করতে বাড়ি ফিরেছেন কিংবা ফিরবেন কিনা। আমাদের দেশের আন্দোলনের বেশীরভাগেরই পরিণতি এমনই। একটা ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু করলে সেখান থেকে হাজারটা ইস্যু এসে পঙ্গপালের মতো যোগ হয়। শেষ পর্যন্ত কোনটা যে মূল ইস্যু ছিল অনেক সময় গুলিয়ে যায়।
জুবায়ের হত্যাকান্ডের পরে আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল যে সব কারণে তার মধ্যে প্রধান তিনটি কারণ ছিল, জুবায়েরের হত্যাকারীদের বিচার, খুনীদের প্রশ্রয়দাতাদের বিচার এবং ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসমুক্ত করা্। খুনীদের বিচার শুরু হয়েছিল তাদের কয়েক মাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কারের মাধ্যমে। এরপরে সহযোগী হিসেবে দুর্বল পালের গোদার উপরে দায় চাপিয়ে বাকীরা পার পেতে চেয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে পদ খেকে সরিয়ে অন্যপদে বদলী করা হয়। এ যেন চুরি করার অপরাধে চোরের টাকা ডান পকেট থেকে সরিয়ে বাম পকেটে রাখার নির্দেশ দানের মতো `গুরুতর` শাস্তি!
এ সকল শাস্তির বিচারক কারা ছিলেন? খুনীদের প্রশ্রয়দানকারী পালের গোদা স্বয়ং ভিসি এবং তার সিপাহসালার প্রক্টর। আন্দোলনরত ছাত্রশিক্ষকদের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত পদের ভারে ন্যুজ প্রক্টরকে বিদায় নিতে হয়েছে। কিন্তু সেই পালের গোদা? যে জুবায়েরের মৃত্যুর পর পরই খুনীদের বাচাতে নির্লজ্জের মতো বলেছিল, ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা এমন কুকর্ম করতেই পারে না। সে এখনো বহাল তবিয়তেই আছে।
একটা আইনী প্রশ্ন। হত্যা একটা ফৌজদারী অপরাধ। সে কারণে যে বা যারা হত্যা করেছে এবং খুনীদের পৃষ্ঠপোষককারীরা সবাইকে ফৌজদারী দন্ডবিধির আওতায় বিচারের সম্মুখীন করা, সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য জরুরী। সে ব্যপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ কি? শুধু পদ পরিবর্তন কিংবা পদত্যাগের মতো কাজ করেই কি তারা ফৌজদারী আইন থেকে রক্ষা পাবে? ভালইতো! গুরু পাপে লঘু দন্ড! যে দেশে নির্দোষরা যুগের পর যুগ কারাভোগ করে এবং একের পর এক খুনীরা প্রেসিডেন্ড কর্তৃক ফাঁসির দন্ড মওকুফ পায় সে দেশে খামাখা খুনীদের দীর্ঘ সময় ব্যাপী মামলা চালিয়ে মামলা জট বাধানো অর্থহীন। এরাতো এক সময় ক্ষমা পেয়েই যাবে।
আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যে কারণে বা যে আদর্শে ছাত্র শিক্ষকরা জুবায়ের হত্যাকান্ডের পরে ক্লাশ রেখে রাস্তায় নেমে আসে সেই হত্যাকারীদের বিচার এবং সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের নিশ্চয়তা কিন্তু এখনো নিশ্চিত হয়নি। সত্যি কথা হোল, তিনটি বিষয়ই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। খুনী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিচার না হলে ক্যাম্পাসে আবারো হত্যাকাণ্ড ঘটবে। তাই ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসমুক্ত, ভয়মুক্ত রাখতে হলে প্রথমেই দরকার খুনী এবং তাদের গড ফাদারদের বিচার। সেখানটাতেই যতো গোলমাল। যে দেশে পুলিশ, প্রশাসন, আইন আদালত সব চলে সরকারের ইশারায়। সেখানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা কোন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ন্যায় বিচারের জন্য লড়াই করে যাবে, চ্যালেঞ্জটা সেখানেই। এই জায়গাটাতে সফলতা দেখাতে পারলেই আগামীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য আজকের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা একটা সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস উপহার দিতে পারবে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? আমি নিরাশাবাদী নই এক্ষেত্রে। অন্ততঃ বলব, দেখা যাক!!
সারা দেশের বিগত আন্দোলনগুলো কিংবা রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করলে শংকা তবুও থেকে যায়।
আগের একটা লেখায় বলেছিলাম বাসন্তী, ফালানী, নূর হোসেন, আসাদদের মতো নাম চুরি হওয়া মানুষদের কথা। বাসন্তীর জাল জড়ানো দরিদ্রতার ছবি প্রচার করে অনেকে ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু কেউ কি পেরেছে এরকম হাজারো বাসন্তীর দা্রিদ্র দূর করতে? এমনকি সেই বাসন্তী নিজেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চরম দা্রিদ্রতা ভোগ করে গিয়েছে। নূর হোসেনও তেমনি রাজনীতির হাটে বিক্রী হওয়া একটা নাম। যে যখন প্রয়োজন তার নামটি ব্যবহার করে রাজনীতি করছে। কিন্তু নূর তা হৃদয়ে যে স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন ধারন করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল, তার কি অবস্থা? পুরানো কথা না বলাই ভাল।
জাহাঙ্গীরনগরেও এরকম অনেক নাম রাজনীতির হাটে বিক্রী হয়েছে। দীপু নামের যে ছাত্রটি সন্ত্রাসের হাতে বলি হয়েছিল, ততকালীন দীপুর বন্ধুরা কামালউদ্দিন হল থেকে শুরু করে দীপু যে হলের ছাত্র ছিল সেই ভাসানী হল পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করেছিল দীপু স্নরণী। অনেক বছর পর ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখলাম সংরক্ষণের অভাবে নামফলক অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমার অগ্রজ, শিবিরের হাতে নিহত ছাত্রদলের নেতা কবীর ভাইয়ের নামে নির্মিত কবীর স্মরণীর অবস্থাও ছিল এক রকম। এখন কি অবস্থা জানি না। কবীর ভাইয়ের মৃত্যুর ১০ বছর যেতে না যেতেই অনেকে কবীর কে ছিলেন, কেন মারা গেলেন ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই তা বলতে পারেনি।
আজ যে জুবায়েরকে নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে, তার নামেও হয়তে কোন স্মরনী কিংবা অন্য কিছু হবে। তারপর? তারপরেও কি থেমে থাকবে ক্যাম্পাসে মৃত্যুর কাফেলা? আমি ভাবতে চাই না যে, জুবায়েরের নামও বিক্রী হয়ে যাক রাজনীতির হাটে। রাজনীতির হাটুরেরা যখন প্রয়োজন হবে শুধু তখনই মিছিলে চিতকার করে জুবায়ের নাম বেচে শ্লোগান দিবে, “জুবায়েরের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না। ”
আজ থেকে পাঁচ কি দশ বছর পরের সেই মিছিলে হয়তো জুবায়েরের খুনীদের উত্তরসূরীদের দেখা যাবে।
mahalom72@yahoo.com
বাংলাদেশ সময় ১০৩১ ঘণ্টা জানুয়ারি ১৭, ২০১২