ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এখন কী আর মামলা না?

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১২
এখন কী আর মামলা না?

আয়কর ফাঁকি মামলায় জামিন নিয়ে বেরিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বক্তব্যে চোখ আটকালো। ওখানে তিনি বলেছেন, বিএনপি যখন ইতিবাচক রাজনীতির পথে হাঁটছে, সংলাপে গেছে তখন সরকার হাঁটছে হিংসার পথে।

দিচ্ছে মামলা।

বিএনপি সংলাপে গেছে, সদস্যপদ ধরে রাখতে হলেও সংসদের আগামী অধিবেশনে যাবে, এসব অবশ্যই ইতিবাচক। দেশের প্রধান বিরোধীদল হিসাবে এটি দেশবাসীর প্রতি বিএনপির দয়া নয়, দায়িত্ব। কারণ, এ দলটি এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল এবং আগামীবারও যাওয়ার আশা করছে। কিন্তু এসবের সঙ্গে দুর্নীতি মামলার কি সম্পর্ক?

আইইবি’র কনভেনশনে খালেদা জিয়া বলেছেন, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে এই সরকারের দুর্নীতির তদন্ত করবেন। খুবই ভালো কথা। কিন্তু বিএনপি জমানার সুনির্দিষ্ট যে সব দুর্নীতির প্রমাণ সরকারের হাতে আছে, সেগুলোর মামলা চালিয়ে যেতে আপত্তি-সমস্যা কোথায়? এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে নিজেদের দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার করে বিএনপির গুলোর করছে, আগামীতে বিএনপি এসে নিজেদের গুলো বাদ দিয়ে একইভাবে আওয়ামী লীগের গুলোর যে বিচার চালাবে, এটা জানার জন্যেতো রাজনৈতিক পণ্ডিত-জ্যোতিষ হওয়া লাগে না। অথচ সারা বছরইতো দেশের ছিঁচকে চোরদের বিচার চলছে। রাঘব বোয়ালদের ধরা হচ্ছে না বা ধরা যাচ্ছে না।

কিন্তু রাঘব বোয়াল দুর্নীতিবাজ তারা বিএনপি বা আওয়ামী লীগের যে দলেরই হোক, রাজনৈতিক ‘ইতিবাচক পরিবেশের স্বার্থে তাদের বিচারের বাইরে রাখতে হবে’ এটা  কোন আবদার?

মওদুদ আহমদ কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যমিথ্যা নিয়ে কিছু বলেননি। অনেক বড় দাগের আইনজীবী তিনি। কোর্টে গেলেই জামিন পেয়ে যান। আমাদের রাঘব বোয়াল আইনজীবীরা সারা বছর বড় বড় মক্কেলদের আয়কর সহ নানা মামলা কোর্টে ফাইট দেবার বিনিময়ে মাশাল্লা কামাই খারাপ করেন না। কিন্তু তাদের নিজেদের অনেকের যে এই আয়করের ফাইলটি সফেদ  সাফ-সুতরো না, তা গত ১/১১’র শাসন সময়ে দেখা গেছে।

এই যে আওয়ামী লীগে এত সব বাঘা আইনজীবী থাকতে ব্যারিস্টার শফিক আহমদ আইনমন্ত্রী হয়ে গেছেন, এটা কি অনেকে কল্পনায় ভাবতে পেরেছেন? অ্যাডভোকেট কামরুল আইন প্রতিমন্ত্রী, আব্দুল মান্নান খান পূর্ত প্রতিমন্ত্রী হয়ে গেছেন, এরা সবাইতো ওই সময়ে ছিলেন শেখ হাসিনার মামলার আইনজীবী। শেখ হাসিনা জেলে যাবার পর দলের অনেক বাঘা বাঘা উকিল তার পক্ষে কোর্টে দাঁড়াতে না পারার কারণ একটাই, তাদের নিজেদের আয়করসহ সম্পদের কাগজপত্রের রেকর্ড ভালো  না। এর জন্যে অনেক বিজ্ঞ(!) ব্যক্তিরা তখন ক্যাপ্টেন পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের দেখেই কাপড় নষ্ট করেছেন!

আমাকে একজন শীর্ষ স্থানীয় আইনজীবীর স্ত্রী তখন বলেছেন, কবে যে তারা মিরপুরে কোথায় একটা প্লট পেয়েছিলেন, সেটি তাদের নিজেদেরই মনে নেই। সম্পদের বিবরণীতে সে প্লটের উল্লেখ না করাতে ১/১১’ওয়ালা ধরে ফেলেছে। এখন সে প্লট দেখিয়ে দেখাচ্ছে ভয়। সে কারণে তার পতিদেবতা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর হাসিনার হয়ে মামলা লড়তে দাঁড়াতে পারেননি। ব্যারিস্টার শফিকদের সে সমস্যা না থাকায় তারা তা পেরেছেন। একইভাবে বিএনপির অনেক বাঘা উকিল থাকতে ব্যারিস্টার রফিকুল হককেই ছুটতে হয়েছে সবার আগে।

১/১১ জমানায় অবশ্য হাসিনা-খালেদা থেকে শুরু করে অনেক নামিদামি রাঘব বোয়ালের উকিল ছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক। তার গাজীপুরের এতিমখানার খরচ তুলতে শুধু ওই সময়টাতেই তিনি মাশাল্লা একচেটিয়া কামিয়েছেন ভালো! উল্লেখ্য, দেশের শীর্ষ এই আইনজীবী আইন ব্যবসার টাকা দিয়ে দীর্ঘদিন নিভৃতে একা চালিয়ে আসছেন বড়সড় একটি এতিমখানা।

ব্যারিস্টার মওদুদের অবশ্য তখন খালেদার জন্যে কোর্টে দাঁড়ানোর সুযোগ-সুবিধা হয়নি। অথবা ফ্রি থাকলে তার মতো চালাক-চতুর মানুষ খালেদার জন্যে ওই অবস্থায় কোর্টে দাঁড়াতেন কিনা তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে। অভিযোগ মাথায় নিয়ে তিনি নিজেই তখন জেলে। ১/১১’র শাসন কেন টিকলো না এ ব্যাপারে জোকস হিসাবে অনেকে ব্যারিস্টার মওদুদকে ‘ভুল করে’ গ্রেফতারের কথা বলেন। কারন এর আগে জিয়া-এরশাদের মতো সামরিক শাসকরা মওদুদের সার্ভিস নিয়েছেন এবং তিনি দিয়েছেন। শুধু জেলে চলে যাওয়াতে ১/১১’ওয়ালাদের সে সার্ভিসটি তিনি দেবার চান্স পাননি। বাইরে থাকলে হয়তো সে ব্যাপারে প্রতিযোগিতায় নামতেন!

উল্টো তারা তখন মওদুদকে শুধু গ্রেফতার, দুর্নীতির মামলা দেওয়াই না, তার গুলশানের বিশাল বাড়িটা নিয়েও নানা আজেবাজে কথা বলেছে! ওই বাড়িটা তার বানানো না। অর্পিত সম্পত্তি। রাজনৈতিক জোকসটিতে বলা হয়, এমন সঠিক জায়গায় সঠিক  মানুষকে(!) চিনতে ভুল করাতে ব্যর্থ হয়েছে ১/১১! এখন উল্টো তাদের দেশান্তরি ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে।

মওদুদ আহমদ প্রশ্ন তুলে বলতে পারতেন, যদি ফালুরা নিরাপদ হয়ে যেতে পারেন, তাহলে তাকে নিয়ে কেন এমন টানা-হেঁচড়া চলবে। বিএনপিতে মওদুদের জানি দুশমন চিহ্নিত, সাম্প্রতিক কোনঠাসা আরেক ব্যারিস্টার নেতা সাবেক জমানায় লন্ডনের এক রাস্তায় নগদ টাকায় তিনটি বাড়ি কিনেছেন। চোরের টাকা যেমন বাটপারে খায়, তেমন তার অনেকগুলো টাকা তখন লন্ডনের এক বিএনপি নেতা মেরে দেন। সে ঘটনায় মনের দুঃখে পুড়লেও চুরির টাকা হওয়ায় মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেননি। সম্রাট শাহজাহান যেমন স্ত্রী মমতাজ মহলের নামে তাজমহল গড়েছেন, তিনিও তার স্ত্রীর নামে বরাদ্দ দিয়ে ফেলেছেন, ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ একটি আলোচিত সরকারি জমি।

শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর একজন গুরুত্বপূর্ণ, বিতর্কিত উপদেষ্টার ঘনিষ্ট আত্মীয় হওয়ায় সরকার তাকে কিছু বলছে না, অথচ তিনি নিজে ফরিদপুরের জামাই, বঙ্গবন্ধুর বিশেষ ঘনিষ্ঠ পল্লীকবি জসিমউদদীনের জামাই হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি-বঞ্চিত করা হচ্ছে এ আবদার-অভিযোগটি মওদুদ করতে পারতেন! তাও করলেন না, নিজের মামলাটি ভূয়া কিনা, এতোগুলো টাকা আয়কর ফাঁকির অভিযোগ যদি কোর্টে সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে কি কেলেঙ্কারির দৃষ্টান্তই না হবে!

সে কারণেই কি এসব মামলার পরিবর্তে এখন এভাবে ‘ইতিবাচক রাজনীতির’ বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন, সামরিক শাসকদের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ?

এখন আমাদের বিপুল ভোটের প্রত্যাশার সরকারের উদ্দেশে একটু বলি। খালেদা জিয়া, মওদুদের মতো লোকেরা যে আজ আঙ্গুল তুলে বলতে পারছেন, এগুলোর কী একেবারেই ভিত্তি নেই? এক শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতাদের পিঠ বাঁচাতে নির্লজ্জভাবে যা করা হলো, আগামী ভোটের ময়দানে গিয়ে কী জবাব দেবে আওয়ামী লীগ? আবুল মন্ত্রীদের পিঠ বাঁচানোর মায়া-মহব্বতের দায়-দায়িত্ব কার? নিজেদের লোকজনের দুর্নীতির মামলা ঢালাও প্রত্যাহার, এমনকি লক্ষীপুরের বিপ্লবের মতো একজনকে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে ক্ষমা করিয়ে সরকার কী আইনের শাসনের ক্ষেত্রে কোনো রোল মডেল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছে? ঢাকায় সবার সামনে কামাল মজুমদারের হাতে একজন নারী সাংবাদিক নিগৃহীত হলো, সারা দেশে ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডারা বেপরোয়া-দুর্বার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সারাদিন এতো কথা বলেন, কিন্তু দলের লোকজন দেখলে বোবা হয়ে যান!

অথচ কত আশা নিয়ে মানুষ এদেরকে ভোট দিয়েছিল! স্বপ্নের মতো দীর্ঘ প্রত্যাশার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে দেশে। সবকিছু ম্লান করে কিছু অসুন্দর। ভয়াল কিছু সন্ত্রাস। ব্যারিস্টার মওদুদের মতো চিহ্নিত চরিত্রের লোকজন যে আজ দেশের মানুষকে আইন-সংবিধানের সবক দেওয়ার সাহস দেখায়, এসবের পটভূমিও সরকারের তৈরি করা।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।