ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আর কথা নয় মমতার সঙ্গে!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১২
আর কথা নয় মমতার সঙ্গে!

বাংলানিউজে ‘বাংলাদেশ ইজ অন দ্য বর্ডার অব পাকিস্তান’ শিরোনামে কল্লোল কর্মকারের লেখার প্রতিক্রিয়ায় কলকাতা থেকে ‘গান্ধিজিকে কবিগুরুর লেবুর সরবত ও মমতার ইতিহাস জ্ঞান’ শিরোনামে অরিন্দম চ্যাটার্জির লেখাটি পড়লাম। পশ্চিমবঙ্গে পৃথিবী প্রাচীন লালদূর্গ ফেলে দেবার ‘বিশেষ জননায়িকা’ মমতা ব্যানার্জির সাম্প্রতিক নানা বিষয় নিয়ে এরমাঝে সেখানকার অনেকেই মুখখোলা, লেখালেখি শুরু করেছেন।



মিখাইল গর্বাচেভ অথবা লেচ ওয়ালেসাও এরমাঝে ইতিহাসের পাতা থেকে নিখোঁজ। পরিবর্তনের  শ্লোগান ফেলে দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নামধারী ছাত্র-গুন্ডারা এখন সেখানে নানান ব্যক্তিগত দাবিতে প্রায় নানা কলেজের প্রিন্সিপাল-শিক্ষকদের পেটাচ্ছে। নানান স্বার্থদ্বন্দ্বে এলাকায় এলাকায় প্রায় প্রতিদিন খুনোখুনিসহ নানান ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে তৃণমূল কংগ্রেসের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা কর্মীরা। তাদের নেতা মমতা ব্যানার্জির বাংলাদেশকে পাকিস্তান সীমান্ত মনে হবে এটা খুব স্বাভাবিক। একটু কল্পনায় ভাবুনতো, এমন একজন মমতা ব্যানার্জি যদি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গের নেতৃ্ত্বে থাকতেন, তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াত বাঙালি আর মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তার? তার ব্যাপারে মনে হয় আমরা আমাদের স্বভাবসুলভ আগ্রহ-আল্লাদ একটু বেশি দেখিয়ে ফেলেছি। এসব নিয়ে একটু নতুন করে চিন্তাভাবনা করা দরকার। সমমর্যাদার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে তিস্তার পানির হিস্যাসহ আমাদের পাওনা দিল্লির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আদায় করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের মূখ্যমন্ত্রী মমতাকে ‘দিদি দাও, দাওনা দিদি’ বলে ইলিশ-জামদানি পাঠিয়ে তোষামোদির মাধ্যমে নয়।
 
সীমান্তে বিএসএফ’এর মানুষ খুন সম্পর্কে ভারতীয় এক নেতা একবার আমাকে কিছু কথা বলেছিলেন। সেখানকার বিএসএফ’এর কাজ মূলত পাকিস্তান আর বাংলাদেশের সীমান্ত পাহারা দেওয়া। এক গ্রুপ বিএসএফ কিছুদিন পাকিস্তান সীমান্তে দায়িত্ব পালন শেষে  তাদেরই আবার বাংলাদেশ সীমান্ত পাহারায় মোতায়েন করা হয়। তখন এদের অনেকে অনেকদিন ঘোরের মধ্যে থাকে। এটি পাকিস্তান না বাংলাদেশ সীমান্ত সেটি ধাতস্থ করতে সময় লাগে। হিন্দিসহ ভারতীয় নানান আঞ্চলিক ভাষাভাষি বিএসএফ’এর এসব সীমান্ত রক্ষী বাংলাদেশ সীমান্তের লোকজনের ভাষাও বোঝেনা। একটু অন্যরকম কিছু মনে হলেই গুলি চালিয়ে দেয়! পাকিস্তান সীমান্তে গুলি চালাতে দশবার ভাবলেও বাংলাদেশ সীমান্তে তা ভাবেনা। সেই নেতা অবশ্যই আলোচনায় বিএসএফ’র এ ভূমিকাকে সমর্থন করেননি। মমতার দৃষ্টিভঙ্গি যে এক না তা তার সর্বশেষ বক্তব্যে স্পষ্ট। সীমান্তে ফালানীর ঘটনায় ভারতীয় মানবিক মানুষগুলোরও প্রাণ কেঁদেছে। মমতার কাঁদেনি। কাঁদলে তিনি অন্তত ঘটনার নিন্দা করতেন।

তিস্তা চুক্তিকে আটকে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। শুধু আটকে দেওয়া নয়, বিশেযজ্ঞ দিয়ে বলিয়েছেন, তিস্তা থেকে বাংলাদেশকে পানি দেওয়া সম্ভব না। বর্ষায় এক-আধটু দেওয়া যেতে পারে! এ যেন তার বা তাদের দয়া করার বিষয় তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা কারও দয়ার বিষয় না। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী। এর ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশের প্রাপ্য। এই প্রাপ্য বাংলাদেশকে দিতেই হবে। কাজেই তিস্তার পানির পাওনা ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বাংলাদেশকে চলতি ভুল পথ বাদ দেয়া উচিত। উপঢৌকন ঘুষের নামে মমতাকে ইলিশ-জামদানি দিয়ে  তোষামোদি না করে দিল্লির সঙ্গে শক্ত দরকষাকষির আলোচনায় যাওয়া উচিত। এভাবে সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আন্তর্জাতিক ফোরামে যেতে হবে। এতে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ বিশ্বের পরিবেশবাদীদের সমর্থন পাবে। লজ্জা পাবে আন্তর্জাতিক ফোরামে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হতে ব্যাকুল ভারতের আগ্রহ। বন্ধুত্ব গাঢ় করতে চাইলে আমরা অরিন্দম চ্যাটার্জির মতো লোকজনের  সঙ্গে করব। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্মানজনক বন্ধুত্বের সম্পর্কে আগ্রহী এমন কোটি কোটি অরিন্দম চ্যাটার্জি সারা ভারতে এবং সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা তার সর্বশেষ আগরতলা সফরে দেখে এসেছেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য আমরা ভারতের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ। এক-দু’জন মমতা ব্যানার্জির কারনে সে সম্পর্ক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব দু’দেশের জনগণের।

এখন ভারত কার্ড নিয়ে আমাদের খালেদা-এরশাদসহ যারা খেলতে মজা পান, এ খেলার ভালো প্লেয়ার, তাদের উদ্দেশে কিছু কথা। এরশাদ এ ইস্যুতে সিলেটের পর রোডমার্চ নিয়ে গেছেন উত্তরবঙ্গে। ক্ষমতায়তো ৯ বছর ছিলেন, তা কি করলে কি হয় সব জানা থাকা সত্ত্বেও এসব সস্তা সেন্টিমেন্টের কাজ-কর্ম কেন তারা করেন, তা তারা ভালোই বোঝেন। তা রোড মার্চ নিয়ে সীমান্তের দিকে না গিয়ে গুলশানের ভারতীয় হাইকমিশন বা বেনাপোল, হিলি সীমান্তের দিকে যান না কেন? কলকাতাগামী ট্রেন-বাস, কলকাতা-দিল্লিগামী ফ্লাইটের সামনে গিয়ে দাঁড়াননা কেন? বাংলাদেশ থেকে বছরে দশ লাখের বেশি মানুষ ভিসা নিয়ে বৈধপথে ভারত যায়। ট্রিটমেন্ট-শিক্ষা, আজমীর জিয়ারতসহ নানা নামে যায়। পঞ্চাশ হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রী পড়ে ভারতে। এভাবে প্রতিদিন-প্রতিবছর কী পরিমান ডলার ভারতে নিয়ে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে সে হিসাব আছে? বেনাপোল-হিলিসহ অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে কী পরিমান ভারতীয় পণ্য ঢুকে বাংলাদেশের বাজারে? তিস্তা রোডমার্চের নামে সস্তা পলিটিক্যাল শোডাউন বাদ দিয়ে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না দিলে এসব ব্যবসা-বাণিজ্য শান্তিতে চলতে দেওয়া হবেনা, সে ঘোষনা দিলে কী তা বেশি কার্যকর হবেনা? ভারতীয় অর্থনীতির কতভাগ মানুষ-ব্যবসাবাণিজ্য এভাবে বাংলাদেশ নামের বিশাল বাজারের ওপর নির্ভরশীল? অর্থনীতিবিদ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যে বাংলাদেশের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্ক চান তা বাজারটি আরও ভালো করে দখলে রাখার জন্য চান। আর আমাদের হিপোক্র্যাট রাজনীতিকরা চান ভারত কার্ডটা খেলতে। কোন কারনে সহজ খেলার কার্ডটি হাতছাড়া হোক তা তারা চাননা। আর আরেকদল সবকিছু খুলে দিয়ে আসতে চান! মমতা ব্যানার্জিরাও তাই বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান-সার্বভৌমত্ব নিয়ে ঠাট্টামস্করার মন্তব্যে দুঃসাহস দেখান।
 
মমতার শাসন নিয়ে বিখ্যাত একজন ভারতীয় কলামিস্ট তাপস সিংহ’র সাম্প্রতিক লেখা থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে লেখাটা শেষ করছি। ‘পরিবর্তনেরও বয়স হবে’ শিরোনামের লেখায় তাপস সিংহ লিখেছেন, ‘পরিবর্তনও একদিন পুরনো হয়ে যাবে। তার গায়েও মেদ জমবে। ক্ষমতার ভাষাও শিখতে শুরু করবে সে। হয়ত বা করেছেও! সমালোচনা সহ্য করার সহনশীলতা কমবে ধীরে ধীরে।   সে বলত শুরু করবে,  ‘টাচ মি ইফ ইউ ক্যান!’

কিন্তু ‘পরিবর্তন’ তো স্বপ্নও দেখতে শিখিয়েছে! কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকায় আর একটু পরিবর্তনের স্বপ্ন! ক্ষমতার ভাষাকে একটু পাল্টে দিয়ে স্বপ্ন দেখি না কেন, হয়তো কোনও দিন উন্নয়নের ডানা মেলে উড়াল দেবে আমাদের রাজ্যও! বলবে, ‘ক্যাচ মি, ইফ ইউ ক্যান!’ মমতার পরিবর্তনের বেলুন ফুটো হয়ে আসার আভাস ভারতীয়রা দেখা শুরু করেছেন।

বাংলাদেশ কী তা জানতে পারছে?

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক   

বাংলাদেশ সময় ১২৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১২

মতামত দিতে এখানে ক্লিক করুন

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।