গত কয়েকদিনের কিছু সংবাদ পড়ে সারা বিশ্বের দুর্বৃত্তদের একটা কমন চরিত্র চোখে পড়েছে। কিছুদিন আগে মৃত তালেবান সেনাদের গায়ে কাপুরুষের মতো মার্কিন সেনাদের মুত্র ত্যাগের সচিত্র খবরটি পড়লাম এবং দেখলাম।
তালেবান নির্যাতনের খবরের রেশ কাটতে না কাটতে আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশের সীমান্ত রক্ষীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাবিবের ওপর চালালো পাশবিক নির্যাতন। সে খবর এবং সঙ্গে ভিডিও চিত্রটাও দেখলাম। সেখানেও হাবিবের বস্ত্রহরণ! খবরে জানলাম, হাবিবের বস্ত্র হরণ করে ওরা যৌনাঙ্গে পেট্রোল ঢেলে দেয়। শরীরের এতো অংশ থাকতে বিকৃতচারীরা ওখানটাতে পেট্রল দিতে গেল কেন?
একাত্তর সালেও পাক হানাদারেরা পথে পথে মানুষের কাফেলা থামিয়ে পুরুষদের লুঙ্গি খুলে, উঁচিয়ে ধর্ম পরীক্ষা করতো। আজ একাবিংশ শতাব্দীতে এসে বন্ধুর হাতে লুঙ্গি খুইয়ে হাবিব প্রিয়জনদের লজ্জায় ঘটনার এ অংশের বিবরণ চেপে যায়। পাকিস্তানি সৈন্য কিংবা সভ্য দাবিদার অসভ্য পশ্চিমা সৈন্যদের ওই বিশেষ অঙ্গপ্রীতি কিংবা হাবিবের ওপর বিএসএফের নির্যাতন, বস্ত্র হরণ এবং সেই সাথে যৌনাঙ্গে পেট্রল ঢেলে দেওয়ার খবরগুলো নিয়ে একটু ভাবলে দুটো প্রশ্ন সামনে এসে পড়ে। প্রথম প্রশ্ন হলো— পৃথিবীর সব দেশের দুর্বৃত্তদের নির্যাতনের সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ওই বিশেষ অঙ্গ কেন? প্রশ্ন দুই— পাক সেনাদের বিশেষ অঙ্গ দর্শন ছিল শত্রু-মিত্র চেনার একটা কৌশল। কিন্তু বিএসএফের বেলায় সেই কারণটা কি? হতে পারে সেটা প্রথম প্রশ্নের উত্তরের সাথে সম্পৃক্ত এবং কিছুটা বাড়তি যোগ!
সারাবিশ্বে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরন্তন। ঠিক তেমনি কিছু বিকৃতচারী মানুষ কারো প্রতীকী সম্মানের স্থান মাড়িয়ে দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পায়। মানুষের দেহের কিছু জায়গা যেটা তার একান্ত আপন, সেই আপনকে ঘিরে তৈরি হয় কিছু প্রতীকী অহংকার, নিজস্বতাবোধ। প্রতীকের একটা মনস্তাত্বিক প্রভাব সবখানে, সব যুগেই ছিল। একাবিংশের এই যুগেও তার এতোটুকু ঘাটতি নেই। প্রতীককে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় তার নিজস্ব পরিচয় এবং অহংকারের স্থান। যেমন— যে কোনো দেশের পতাকা সেই জাতীর প্রতীকী অর্থে আত্ম পরিচয়ের মাধ্যম এবং সেটা তার অহংকার। এ কারণে দেখা যায়, বিজয়ী দল কোনো দেশ দখল করে প্রথমেই সে দেশের পতাকা মাড়িয়ে দেয়। সে মনে করে, এর মাধ্যমে গোটা জাতিকেই পায়ের নিচে মাড়িয়ে দিল।
একজন ব্যক্তির জননাঙ্গ প্রতীকী অর্থে তার অহংকার হিসেবে বিবেচিত। তাই ধর্ষণের মতো পাশবিক কাজে একদিকে যেমন বিকৃত জৈবিক চাহিদা কাজ করে, তেমনি পুরুষ আধিপত্য সমাজে একজন বিকৃতচারী পুরুষ মনে করে, এর মাধ্যমে সে নারীর আত্ম পরিচয়কে মাড়িয়ে দিল। এটাকে মনে করে নারীর ওপরে পুরুষের বিজয় বা আধিপত্য। একজন ধর্ষণকারীর উল্লাস যতোটা না জৈবিক তৃপ্তির কারণে, তার চেয়ে বেশি তার বিকৃত পুরুষ আধিপত্য মানসিকতার জন্য।
কিন্তু পুরুষের বিশেষ অঙ্গ দর্শনে কিংবা যৌনাঙ্গকেন্দ্রিক নির্যাতনে পুরুষের উল্লাস কেন? সেখানেও আছে কিছু মিথ এবং সেই মিথ কেন্দ্র করে বিকৃত বিজয়ের আনন্দ কাজ করে। বিকৃত মানুষের উল্লাসই হচ্ছে পাশবিক কাজ সমাপনের মাধ্যমে। পুরুষের যৌনাঙ্গ নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে শৌর্য বীর্যের মিথ চালু রয়েছে। এ কারণেই হয়তো হিন্দু ধর্মে শিবলিঙ্গের পূজা চালু হয়েছিল। শিবলিঙ্গ পূজার আরো অনেক উদ্দেশ্য থাকলেও অন্যতম একটা উদ্দেশ্য হলো, শিবলিঙ্গকে মনে করা হয় পুরুষরূপী ঈশ্বরের সৃষ্টিক্ষমতা (সূত্র: উইকিপিডিয়া)। তো একজন পুরুষের সেই ক্ষমতাকে মাড়িয়ে দেওয়ার মানেই হচ্ছে, তার ক্ষমতার ওপরে বিজয়। বিশেষ অঙ্গ কেন্দ্রিক নির্যাতনের আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক কারণে হতে পারে, মানুষের লজ্জায় বিকৃত তৃপ্তি বা আনন্দ পাওয়া।
এ কারণেই হয়তো বা দুর্বৃত্তরা যুগে যুগে ওই বিশেষ অঙ্গ কেন্দ্রিক নির্যাতন থেকে পাশবিক আনন্দ খুঁজে পায়। পাকিরা বাঙালিদের যে বিশেষ অঙ্গ দর্শন করতো, তার বাস্তব ফলাফলের সাথে সম্প্রতি হাবিবের বস্ত্রহরণ এবং পেট্রল ঢেলে বিশেষ অঙ্গ নাশে বিএসএফের অপচেষ্টা নিয়ে ফ্যান্টাসি জগতটা ঘুরে আসা যেতে পারে।
পাক হানাদারেরা বাঙালির লুঙ্গি উঁচিয়ে বিশেষ অঙ্গ দর্শনের জেরে মুসলমানরা কিছুটা আশ্বস্ত থাকলেও অন্য ধর্মের মানুষদের কিন্তু তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। ধর্মের মাধ্যমে শত্রু সনাক্তের দুটো পরীক্ষা; যেমন মুসলমানের বিশেষ অঙ্গ এবং কলেমা জানা, দুটোতেই মুসলমানেরা সহজে পরিত্রাণ পেলেও অন্য ধর্মের লোকদের ছিল কেয়ামতের পুলসিরাত পার হওয়ার মতো কঠিন অবস্থা। প্রাপ্ত বয়সে বিশেষ অঙ্গের বাড়তি অংশ কেটে মুসলিম অঙ্গে রূপান্তরের চিরস্থায়ী ঝুঁকি না নিয়ে কলেমা মুখস্ত করে তখন ভিন্ন ধর্মের অনেকেই বাঁচার শেষ চেষ্টা করেছিল। আর ব্যর্থতায় ছিল নিশ্চিত মৃত্যু।
কিন্তু হাবিবের বিশেষ অঙ্গে বিএসএফের পেট্রল ঢালার হেতু কি? শিবলিঙ্গের পূজার সেই তত্ত্বে গিয়ে যদি দেখি, লিঙ্গ হচ্ছে পুরুষরূপী ঈশ্বরের সৃষ্টি ক্ষমতা। অর্থাৎ মানব প্রজন্ম বৃদ্ধিতে ওই অঙ্গের ভূমিকা আছে। অতএব হাবিবের ওই অঙ্গ জ্বালিয়ে দাও। প্রতীকী অর্থে হয়তোবা বিএসএফ জওয়ানদের কাছে হাবিবের বিশেষ অঙ্গটা ছিল তাবৎ বাঙালির একান্ত বিশেষ অঙ্গ। ওদের এই অঙ্গ জ্বালানো প্রকল্পের আওতায় একে একে সবাই চলে এলে কয়েক যুগ পরে আমাদের দেশ প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে মানবশুণ্য হয়ে পড়বে। তখন কি দরকার কড়িডোরের জন্য চিঠি চালাচালি করে! সবইতো দখলে। অথবা হতে পারে হাবিবের বিশেষ অঙ্গ মাড়িয়ে তাবৎ বাঙালির শৌর্যবীর্যকে প্রতীকী অর্থে অপমান করা। হাবিবের অঙ্গ দর্শন এবং পেট্রল ঢালার পেছনে কতিপয় বিএসএফ সদস্যের পুরুষতান্ত্রিক হীন চিন্তার বিকৃত চেষ্টা কিনা কে বলতে পারবে? (এই প্যারার পুরোটাই ফ্যান্টাসি। দয়া করে কট্টর ভারত বিরোধীরা ‘লিঙ্গ বাঁচাও’ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না)।
হাবিবের খবরটা যেহেতু গুরুতর, তাই পত্রিকায় প্রকাশের পরপরই বিভিন্ন সামাজিক সাইটে পোর্স্টং হতে থাকলো। পাঁচ মিশালী মন্তব্যও আসতে থাকলো ঝাঁকে ঝাঁকে। কেউ কেউ লিখল, ভাইরে, ওপারে একটা লুঙ্গি ফেলে এসেই মনটা এতো খারাপ! ওরাতো ভিনদেশি। অন্যায় একটা করেই ফেলেছে। নিজ দেশে রাস্তাঘাটে, রিমান্ডের নামে পুলিশ হেফাজতে এ রকম কতো হাবিব যে লুঙ্গি হারাচ্ছে তার খবর ক’জন রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো চেহারা মনে পড়ে গেল। রাজপথের আন্দোলনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির বস্ত্র হরণের চিত্র। থানার ভেতরে কাদেরকে কোপ খেতে হলে রিমান্ডে নিলে কি হয় কে জানে! জানতে চাইলেও যেতে চাই না সেখানে! সে রকম কিছু হলে লজ্জায় হাবিবের মতোই চেপে যেতে হবে। যদি না কোনো বোকা পুলিশ সেটা মোবাইলে ধারন করে! (আমার অবশ্য লজ্জা কম। বেঁচে আসতে পারলে সব বলে দেব)। পরকে গালি দেওয়ার আগে নিজেরা শুধরে নিই আগে। বিএসএফ একটা লুঙ্গি নিয়েছে ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু স্বদেশে যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, তাদের হাতে লুঙ্গি হারানোর বেদনা হাবিবেরা কাকে জানাবে?
অনেক সিরিয়াস কথার পরে এবার একটা কৌতুক দিয়ে মনটা হালকা করা যাক।
গ্রামের সবচেয়ে বোকা এবং দুর্বল লোকের সঙ্গে, সবচেয়ে টাউট এবং ধুরন্দর এক প্রতিবেশীর বন্ধুত্ব হলো। টাউট বন্ধুটা নিজের স্বার্থ উদ্ধারের সময় বোকা বন্ধুর সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহার করে তার গাছের আমটা, কাঁঠালটা, পেয়ারাটা বাগিয়ে নেয়। বোকা লোকটি বন্ধুর জন্য কিছু একটা করতে পেরে খুশীতে বাকুম বাক। ধোঁকা দিয়ে বন্ধুর কার্যসিদ্ধির কৌশলটা সে বুঝতো না। ভাবতো, এটাই বুঝি দোস্তালী। কাজ ফুরোলেই টাউট বন্ধুটা খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসে বিভিন্নভাবে বোকা বন্ধুকে উত্যক্ত করতো। গ্রামের লোকেরা একদিন বোকা লোকটিকে সাবধান করে দিতে গেলে পাল্টা সে বললো, তোমরা অযথাই ওকে মন্দ ভাবছো।
গ্রামের লোক: তাই বুঝি! ওযে তোমার কান ধরে টানলো?
বোকা লোক: ওটা তো দোস্তালী।
গ্রামের লোক: এবার যে লাথি মারলো।
বোকা লোক: মারতেই পারে। দোস্তালী।
গ্রামের লোক: করে কি, করে কি! দোস্ত যে তোমার জামা লুঙ্গি ধরে টানাটানি করছে! এবার?
বোকা লোক: আরে এটাতো মশকরা! দোস্তালী!
গ্রামের লোক: সর্বনাশ! এবার যে লুঙ্গি খুলে ফেলল!
বোকা লোকটি ফিক করে হেসে বললো, এটা ফ্রেন্ডশিপ।
ভারতের সাথে আমাদের দোস্তালীটাও ওপরের কৌতুকের মতো নয় কি? বোকা লোকটির মতো আমরা ওদের ট্রানজিটের মতো বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে দিলেও তিস্তার পানিতো দূরের কথা, মাসে মাসে লাশ ছাড়া কি পাচ্ছি? এবারতো হাবিব ওপারে লুঙ্গিটাই হারিয়ে ফ্রেন্ডশিপ করে এলো।
mahalom72@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১২