ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় কষ্ট লাগলো কার কার?

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১২
অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় কষ্ট লাগলো কার কার?

শুরুতে কুচক্রীদের সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেওয়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন। এক্সক্লুসিভ রিপোর্টটি সাহস করে সবার আগে লেখার জন্য আমার বন্ধু কাজী হাফিজকে সাব্বাশি।

ভয়ঙ্কর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ-পণ্ড হওয়ায় আরেকটা উল্টো হাঁটার বিপদ থেকে রক্ষা পেল বাংলাদেশ।

এই প্রথম নজিরবিহীন প্রেস কনফারেন্স করে একটি অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেবার খবর দিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পরিবর্তিত সময়ে এর মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর স্বাভাবিক আনুগত্য প্রকাশ তথা পুরো বিষয়টির সঙ্গে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি ভালো লেগেছে।

সব সামরিক অভ্যুত্থানের নিয়তওয়ালাদের মতো এই অভ্যুত্থানওয়ালাদেরও নিশ্চয়ই দেশে আরেকটি হত্যাকাণ্ড তথা শেখ হাসিনা হত্যার পরিকল্পনা ছিল! এমন স্বপ্নচারীরা সফল হয়ে গেলে রেডিও-টিভি দখল করে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম’ বলে এতোক্ষণে দেশের মানুষকে সবক দেওয়া শুরু করতেন! সব টিভি-মিডিয়া অবশ্য দখল করাও লাগতো না। ‘গণতন্ত্রের শত ফুল ফুটতে দাও’ এর সুযোগে মাশাল্লা বাংলাদেশে এর মাঝে এমন কুচক্রী অভ্যুত্থানকারীদের অতীতের মতো ‘বিপ্লবের মহানায়ক’ নাম দিয়ে তোষামোদির প্রতিযোগিতা করার মতো মিডিয়াও বেশ গড়ে উঠেছে।

দেশের এক পত্রিকার একটা লেখা দেখে চমকে উঠলাম! এ ধরনের একটি অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেওয়ায় সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদতো নয়ই, উল্টো সেনাবাহিনী কেন এভাবে প্রেস কনফারেন্স করলো, কেন স্বীকার করলো অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার কথা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে! সেনাবাহিনীতে জঙ্গি আছরের কথা স্বীকার করায় নাকি এখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বের করে দেবে, ইত্যাদি! কষ্টটা কোথায় গিয়ে লেগেছে বোঝাই গেল!

আহা শেখ হাসিনাকে উৎখাতের, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের চেষ্টাটা মাঠে মারা গেল, কত কষ্ট! মজার ব্যাপার বিএনপি’র লাইনটিও এক মিলে গেছে! অভ্যুত্থান ব্যর্থ করায় সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানাতে কৃপণতা দেখিয়েছে বিএনপিও!

আজকাল রাজাকাররা একটা কথা প্রায়ই বলে। তা হলো, আওয়ামী লীগ সবকিছুতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভণ্ডুলের ষড়যন্ত্র দেখে! এমন ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগের নেতারাও অহোরাত্রি বলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গণবিরোধী যা যেখানে দেখি, অকপটে সমালোচনা করি। কিন্তু পাশাপাশি একথা তো শতভাগ সত্য যে, আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলেই যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া ভণ্ডুল হবে। জেল থেকে তরতর করে বেরিয়ে যাবে  গোলাম আযমসহ দেশসেরা দাগী সব যুদ্ধাপরাধী।

তাদের বিচার করার জন্যেতো বিএনপি বা খালেদা জিয়া তাদেরকে জোটে রেখে ক্ষমতায় যাবার আন্দোলন করছেন না। এখন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ভণ্ডুল হবার পর বিএনপি বলেছে, তারা এর পেছনে জড়িত না। কিন্তু অভ্যুত্থানের স্বপ্নচারীদের সঙ্গে বিএনপির গন্তব্য এক। সেনা সদর দফতর ধারাবাহিক যে ঘটনাক্রম দিয়েছে তা মেলালে মনে হবে ‘ডাল মে কুছ কালা হায়!’

সেনাবাহিনী বলেছে, অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাটি তারা প্রথম টের পায় ১৩ ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হবে এমনটি আশা করা হচ্ছিল। সে দিনটিকে সামনে রেখেই কী ১৩ ডিসেম্বর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার উদ্যোগ নেওয়া হয়? যাতে এর আগেই ক্ষমতা দখল তথা শেখ হাসিনাকে হটাতে পারলে আর গোলামের জেলে যাওয়া লাগবে না! ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দলীয় আলোচনা সভায় খালেদা জিয়া কেন অনুপস্থিত ছিলেন? এর মাঝে ১৬ ডিসেম্বরের প্রোগ্রামে তিনি প্রধান অতিথি থাকবেন, এটাতো আগে ভাগেই মিডিয়াকে জানানো হয়েছিল। সেদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন এটাও বলা যাবে না বা বলা হয়নি। কারণ, সেদিন সকালে তিনি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান। ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সকাল বেলায় সারা ঢাকাজুড়ে কী অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিল? বিএনপি বলেছে, ১৮ তারিখের নৈরাজ্যের সঙ্গে তারা জড়িত ছিল না। তাহলে কী বিএনপির প্রোগ্রামকে সামনে রেখে সে পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যে অভ্যুত্থানের কুশীলবরা জড়িত ছিল?

পরে জানা গিয়েছিল, ইঞ্জিনীয়ার্স ইনষ্টিটিউটের সংবর্ধনা শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিল নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনে বসে পড়ে ওভাবে তিনদিন অবস্থান করে তাহরির স্কোয়ার স্টাইলের বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা হয়েছিল! এর জন্যে ঢাকার বাইরে থেকেও নেতা-কর্মীদের আনা হচ্ছিল! একদিকে সেনাবাহিনীর ভেতর এক গ্রুপ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছে, আরেকদিকে প্রেস ক্লাবের সামনে তাহরির স্কোয়ার, সবই যেন বিপ্লব বিপ্লব খেলা! দুজনে দুজনার!

এরপর সেনাবাহিনী যেখানে অভ্যুত্থানের নস্যাতের কাজ করছে সেখানে হঠাৎ করে চট্টগ্রামের জনসভায় খালেদা জিয়া সেনাবাহিনীকে গুম চলার দাবি কেন করলেন? সেনাবাহিনীর কী উচিত ছিল, অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারীদের আদর করা? বিএনপি হয়তো বলবে যে ঘটনাক্রমগুলো বলা হয়েছে, এর সব কাকতালীয়। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে এ সবের কোনো সম্পর্ক নেই! কিন্তু যে কোনো অভ্যুত্থান তো ঘোলাপানিতে মাছ শিকারিরাই করে। পানিটা তো ঘোলা করেছে বা এখনও করছে বিএনপি। কসম করে বলেছে, এ সরকারকে কোনো অবস্থায় নির্ধারিত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে দেবে না। অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলকারীরা এসব থেকে আস্কারা পায় কী?

দেশে এখন রাষ্ট্রপতি শাসিত না, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত। বঙ্গবন্ধু আর এরশাদের সরকার ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত। বঙ্গবন্ধুকে খুন আর এরশাদকে আন্দোলন করে ক্ষমতা থেকে ফেলে দেওয়া গেছে। জিয়াকে খুন করার উদ্দেশ্যও ছিল ক্ষমতা। কিন্তু এরশাদ কৌশল করে তখনই ক্ষমতা না নিয়ে একটু ঘুরিয়ে নিয়েছেন। বিএনপি’র বিচারপতি সাত্তারকে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা নিয়ে বলেছেন, ‘আমিতো নেইনি, উনি ক্ষমতা হাতে তুলে দিয়েছেন!’ খালেদা জিয়া তার দু’বারের পূর্ণ একবারও নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেও ক্ষমতা ছাড়েননি। এখন যে তিনি একটি নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ শেষ করতে না দেবার নিয়ত নিয়েছেন, সামরিক অভ্যুত্থানের স্বপ্নবাজদের স্বপ্নদ্রষ্টা তাহলে কে?

ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কুশীলবদের পেছনে নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের ইন্ধনের বলা হয়েছে। হিযবুত তাহরীর, জামায়াতে ইসলামী, ফজলুল হক আমিনী, জেএমবি সবার স্বপ্ন বা মূল কর্মসূচি বাংলাদেশকে পাকিস্তান মার্কা ইসলামী রাষ্ট্র করা। যে পথটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বর্জন করে এসেছে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন-পরিকল্পনা বিএনপি’র নেই। কারণ, তাহলে খালেদা জিয়াও বিএনপি’র নেত্রী থাকতে বা প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না। জিন্নাহ যেমন ব্যক্তি জীবনে ধর্মকর্ম না করেও মুসলমান ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জাতির পিতা হয়ে গিয়েছিলেন তেমনি জিয়া-এরশাদও ক্ষমতা আর রাজনীতির স্বার্থে যেখানে যতোটুকু দরকার ধর্মকে ব্যবহার করেছেন ততোটুকু। আর আজকের বিএনপি তো জিয়াউর রহমানের সেই আদর্শেরই দল।

জিয়ার চাইতে খালেদা জিয়া একটু এডভান্সও। কারণ, ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নচারী অথবা হোল সেলারদের নিয়ে তিনি জোট করছেন। তিনিই তাদের নেত্রী এবং অভিভাবক। সেজন্য তার বোনাস নিরাপত্তার বিষয় হলো, তিনি ক্ষমতায় থাকলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা বা তাকে মারতে গ্রেনেড হামলা হয় না। একটা প্রচার আছে, ব্যক্তি জীবনে খালেদা জিয়ার চাইতে বেশি ধর্মকর্ম করেন শেখ হাসিনা। বিএনপি’র চেয়ে আওয়ামী লীগে গোলটুপিওয়ালা নেতাও বেশি। কিন্তু শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের সমস্যা হলো, তাদের বিরুদ্ধ বলার ধর্মভিত্তিক দল দেশে বেশি। খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তারা সবাই বলেন, শেখ হাসিনা আল্লাহ-খোদা মানেন না। যারা অভ্যুত্থান করতে চেয়েছে তারাও একজাতের। রসুনের গোঁড়া সব এক জায়গার! অতএব ব্যর্থ অভ্যুত্থানের দায়-দায়িত্ব কোনো না কোনো ভাবে বিএনপি’র কেয়ার-অফে চলে যায়। কেউ স্বীকার করুক, আর না করুক।

যে পত্রিকার মন্তব্য প্রতিবেদন নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম সেখানে আবার যাই। সেখানে লেখা হয়েছে, এভাবে সেনাবাহিনী প্রেস কনফারেন্স করে অভ্যুত্থানের কথা, জঙ্গী আছরের কথা স্বীকার করায় জাতিসংঘ বাহিনীতে বাংলাদেশ আর্মি’র অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে! সত্যি কী তাই? না এটি অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার রাগে হাত-পা ছোঁড়া? বা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার কষ্টের রাগে-দুঃখে সেনাবাহিনীকে পাল্টা অভ্যুত্থানে উস্কানি দেবার সামিল! যেন সেনাবাহিনীর জওয়ানদের উস্কিয়ে  বলা হচ্ছে, ‘সর্বনাশ, এখন জাতিসংঘ বাহিনী থেকে তোমাদের চাকরি যাবে। কাজেই এর প্রতিবাদে আরেকটা অভ্যুত্থান করে বলো, না কথাটি সত্য না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কোনোদিন কোনো জঙ্গি আছর লাগেনি!’

একটি পেশাদার বাহিনী হিসাবে নিজস্ব উজ্জ্বল স্বকীয়তার গুণেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আজকের অবস্থান। এটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। আর জাতিসংঘ বা তার ডোনার কান্ট্রিগুলো কী এতোটাই গর্ধব যে, আমাদের সেনাবাহিনীর ভেতরে কি মাল আছে না আছে, তা না জেনেই এতো জওয়ান শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নেয়? ক্লিনটন যখন বাংলাদেশে আসেন তখনও বাংলাদেশ সরকার স্বীকার করতো না যে, দেশে জঙ্গি আছে। কিন্তু জঙ্গি অস্তিত্বের মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে তখন সাভার স্মৃতিসৌধসহ ক্লিনটনের ঢাকার বাইরের সমস্ত কর্মসূচি বাতিল করা হয়। এখন মুষ্টিমেয় কিছু জঙ্গি বিপথগামীর কারণে গোটা সেনাবাহিনীর গায়ে জঙ্গি আছর কেন লাগবে? উল্টো জঙ্গি সংশ্রবের অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেবার সাফল্যের কারনে জাতিসংঘ বাহিনীতেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান তো আরও ভালো হবার কথা।

কষ্ট লাগার কথা উল্লেখ করেছি সে কারণে। তাদের কষ্ট পেতে দিন। বুক চাপড়ে কান্না করতে দিন। আসুন, আমরা আমাদের সেনাবাহিনীর পিঠ চাপড়ে তাদের আবার অভিনন্দিত করি। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় লাভ হলো আমাদের, যারা চাতক পাখির মতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ দেখার অপেক্ষায়। আশা করা হচ্ছে, এখন এ প্রক্রিয়া আরও জোরদার হবে।

অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় এটি শেখ হাসিনার আরেকটি এক্সটেনশন লাইফ। সরকারের তিন বছরের ভুলগুলোকে স্বীকার করে শুধরে নেবেন কী এক্সটেনশন লাইফের শেখ হাসিনা?

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

‌বাংলাদেশ সময় :১৮৩৭ ঘন্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।