প্রথমেই একটা পরিপূর্ণ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা কল্পনা করি: একটি শিশু জন্ম নিল, শুরুতেই নিঃশ্বাসের সাথে অক্সিজেন নেওয়ার জন্য তাকে নিতে হবে অনুমতি, মানতে হবে আইন, দিতে হবে কর। কারণ অক্সিজেন উৎপাদন এবং বিপণন ব্যবস্থা তখন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এরপর আসবে ভাষাশিক্ষা এবং তার ব্যবহার। বাঙলা একাডেমীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বেসরকারি খাতে, এবং বাঙলা ভাষা শিক্ষা এবং তা ব্যবহারের জন্য প্রত্যেককে অবশ্যই নির্ধারিত ফি দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে একটি কর্পোরেট কোম্পানির কাছ থেকে। সাথে মানতে হবে প্রমিত বাঙলা ব্যাকরণের আইন, আইন ভঙ্গের শাস্তিও দেওয়া হবে। আপনি যদি ‘যামু গা খামু না’ ধরনের ভাষা ব্যবহার করেন, আপনার বাঙলা ভাষার ব্যবহারের ওপরে নিষেধাজ্ঞাও জারি হতে পারে। ও হ্যাঁ, কর দেওয়ার সাথে সাথে অবশ্যই যুক্ত হবে সরকারি মূল্য সংযোজন কর ১৫%।
এরপর প্রত্যেকটা (আক্ষরিক অর্থেই) জিনিস আমাদের কিনতে হবে বা সেটা ব্যবহারের জন্য অনুমতি নিতে হবে-তাদের তৈরি করে দেওয়া আইন মেনে চলতে হবে। যে যত বেশি টাকা দিতে পারবে, সে তত ভাল জিনিসটা পাবে, ঠিক যেমন আমাদের শিক্ষাকে তারা বানিয়ে ফেলেছে পণ্য। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বেঁচে থাকবার অধিকার, নাগরিক নিরাপত্তা তখন আমাদের কিনতে হবে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে। টিকাসহ জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধ চড়া দামে কিনতে হবে। ‘বেঁচে থাকতে চান? তাহলে টাকা ছাড়ুন। ’ দাবি করা হবে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তার আবিষ্কারকের মেধাস্বত্ব (ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি)। এটা ব্যবহার করতে হলে টাকা দিতে হবে!
এখন যেমন বিভিন্ন নিরাপত্তাদানকারী প্রতিষ্ঠান অন্য কোম্পানিগুলোকে নিরাপত্তা দেয় অর্থের বিনিময়ে, পুলিশ নিরাপত্তা দেয় উৎকোচের বিনিময়ে, ভাবুন সেই সবই বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হল। পুলিশের সেবা নিতে হলে নির্ধারিত ফি দিতে হবে, সন্ত্রাসী বাহিনীর হাত থেকে বেঁচে থাকতে হলে বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির দ্বারস্থ হতে হবে প্রত্যেক নাগরিককে। প্রতিটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করবে এক একটা কোম্পানি, দেশগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে আরও বড় কোম্পানি, বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে সবচেয়ে বড় কোম্পানিগুলো।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের চাপে ক্রমশ সব খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া হবে। তারা বলবে: সরকার কেন এই সব খাতে ভর্তুকী দেবে? এই সব হাভাতে হতদরিদ্র লোকজনদের জন্য এত নিরাপত্তার কী দরকার? নিরাপত্তা নিতে চাইলে, বেঁচে থাকতে চাইলে টাকা ফেল, মাগনা মাগনা পুলিশের সেবা নেবার দিন শেষ।
এটা কাল্পনিক এক বিশ্বের কথা বললেও আসলে আমরা কি সেই পথেই এগুচ্ছি না? কর্পোরেট দুনিয়া আমাদের ক্রমশ বেঁধে ফেলছে, নিত্য নতুন আইন করে দখল করে নিচ্ছে আমাদের কথা বলার অধিকার, নিঃশ্বাস নেবার অধিকার। আমাদের এখন তাদের আইন অনুসারে কথা বলতে হবে, তাদের তৈরি করে দেওয়া নিয়ম-কানুন অনুসারে নিঃশ্বাস নিতে হবে!
আমাদের সমস্ত অধিকারের ওপরে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ হচ্ছে, আইন তৈরি হচ্ছে। আমাদের কথা বলার, চিন্তা করার, জ্ঞানার্জন করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ইন্টারনেটে এখন আমরা মুক্তভাবে কথা বলতে পারছি, স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করতে পারছি, মানবসভ্যতার সব অর্জিত জ্ঞান আমাদের সামনে চলে আসছে নিমিষেই। বর্তমানে এই সব কিছুর উপরেই কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা চলছে। প্রতিটা ওয়েবসাইটে মনিটরিং, সেখানে পুলিশি কার্যক্রমের জন্য আইন হচ্ছে!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের প্রস্তাবিত দুইটি বিল হচ্ছে স্টপ অনলাইন পাইরেসি (সোপা) এবং দ্য প্রটেক্ট আইপি অ্যাক্ট (প্রিভেন্টিং রিয়াল অনলাইন থ্রেটস টু ইকোনোমিক ক্রিয়েটিভিটি এবং থেফট অব ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি অ্যাক্ট, ২০১১ বা পিপা)। মূলত কপিরাইট ও মেধাস্বত্ব রক্ষা করার জন্য এ বিলটি পাসের প্রস্তাব করা হলেও এটি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে, যা আসলে পুরো ইন্টারনেট বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণেরই একটি সাম্রাজ্যবাদী উদ্যোগ।
প্রস্তাবে মেধাস্বত্ব বা কপিরাইটের কথা বলা হলেও এই আইনে এমন সব ধারা উপধারা যুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ সামান্য অভিযোগেও যেকোনো ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিতে পারবে। ধারা ১০২(এ)(২)-তে কপিরাইট ভঙ্গের অভিযোগে বিদেশি যেকোনো ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলকে। আর যেহেতু ডটকম, ডটনেট এগুলো বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধণকারী প্রতিষ্ঠান, তাই বেশিরভাগ ওয়েবসাইট-এর আওতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
ফেসবুক, গুগলের মত বিশ্ববিখ্যাত ওয়েবসাইটও এই আইন মোতাবেক ঝুঁকির ভেতরে চলে যাচ্ছে। এই সব ওয়েবসাইটই গ্রাহকদের দ্বারা পরিচালিত এবং তারাই এগুলোকে জনপ্রিয় করেছে। তারা বিভিন্ন ধরনের ছবি, গান, লেখা, সিনেমা আদান-প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। কিন্তু এই সব ছবি, গান, লেখা বা সিনেমা কপিরাইট আইন ভঙ্গ করছে কি না, সেটা এই আইন মোতাবেক সেই সব ওয়েবসাইটকেই মনিটর করতে হবে, যা এক কথায় একটি অসম্ভব ব্যাপার। কোটি কোটি ব্যবহারকারী কোথায় কখন কি আদান-প্রদান করছে, সেটা মনিটর করা যেকোনো ওয়েবসাইটের জন্যেই অসম্ভব।
অর্থাৎ ইন্টারনেট বিশ্বকে মোটামুটি হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার জন্যেই প্রস্তাব করা হয়েছে এই আইনের। এর আগে উইকিলিকসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বর্তমানে যেভাবেই হোক, ইন্টারনেট বিশ্বকে দখলের অশুভ পাঁয়তারা শুরু করেছে। কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব শুধুই দেখানোর জন্য, এর মূল উদ্দেশ্য এই আইনের ধারা উপধারাগুলো পড়লেই স্পষ্ট হয়ে যায়।
একটি শিশু জন্মাবার সাথে সাথেই সে কিছু মৌলিক অধিকার নিয়ে জন্মায়। বেঁচে থাকার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, জ্ঞানার্জনের অধিকার। মানবসভ্যতা আজ এতদূরে চলে এসেছে, এটা কোনো ব্যক্তিবিশেষ, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বা পুঁজিবাদী দেশের কল্যাণে নয়। এর পেছনে অগুনতি মানুষের ঘাম, তাদের রক্ত মিশে আছে। এটা পাহাড়ে ওঠার মতন, নিচের সিঁড়িগুলো না থাকলে আমরা এই পর্যন্ত পৌঁছাতাম না। এই অর্জন কারও একার নয়, সবার, পুরো মানবজাতির। তাই মানবসভ্যতার এত বছরের জ্ঞান-বিজ্ঞান জানার অধিকার জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর, প্রত্যেক মানুষের। মানুষের এই অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
‘বিনামূল্যের জ্ঞান ব্যতীত একটি বিশ্ব কল্পনা করুন!’ শিরোনামের উইকিপিডিয়ার দেওয়া বার্তাটিতে বলা হয়েছে, প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা লক্ষ লক্ষ ঘণ্টা ব্যয় করে মনুষ্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জ্ঞানকোষটি তৈরি করেছে। কিন্তু ইউএস কংগ্রেস বর্তমানে এমন একটি আইনের কথা বিবেচনা করছে যেটা মুক্ত এবং বিনামূল্যের ইন্টারনেট সেবার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ২৪ ঘণ্টার জন্য তারা উইকিপিডিয়াকে ‘ব্ল্যাকআউট’ ঘোষণা করেছে।
এই আইনের ফলে সামাজিক যোগাযোগ সাইট এবং মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও বিনামূল্যে বিতরণের সাইটগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উইকিলিকসের মত বিখ্যাত ‘তথ্য জানার অধিকার’ বিষয়ক সাইটকে নিমিষেই বন্ধ করে দেওয়া যাবে, মানবাধিকার এবং জ্ঞানচর্চা ও বিনামূল্যে বিতরণের অনেক শুভ উদ্যোগই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই কালো আইনের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে, নতুবা ক’দিন পরে এই আইন আমাদের গলায় চেপে বসবে, আমাদের তৈরি করা এই অন্তর্জালিক মুক্তবিশ্বটি আমরা সাম্রাজ্যবাদের পণ্য হতে দেব না কিছুতেই।
তাই উইকিপিডিয়ার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছি, ‘The Internet Must Remain FREE’.
লেখক: ব্লগার ও সোশাল অ্যাকটিভিস্ট।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১২