বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্হিতি ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন ও অন্যন্য। অন্য দেশগুলোর সাথে মেলে না।
জাতীয়তাবাদী বিএনপি ও গণতান্ত্রিক আওয়ামীরা দুই পরিবার। স্বৈরাচারের তকমা লাগানো এরশাদের জাতীয় পার্টি আর রগকাটা জামায়াত দুই ‘সোয়া’ দল মিলে আধা। অন্য কোন রাজনৈতিক শক্তিকে ‘চোখ মেলতেই’ দেন না এই আড়াই দলের সমাঝোতার রাজনৈতিক জোট।
তবে জামায়াতের রয়েছে ‘খতরনক’ সাংগঠনিক শক্তিমত্তা। নামে-বেনামে জামায়াতের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় সক্রিয় রয়েছে বাংলা ভাইর মতো কিছু ব্যক্তিগত উপদ্রব আর হিজবুত তাহরীরের মতো বিভিন্ন জঙ্গি ও মৌলবাদী তালেবান সগঠন। ক্ষমতা হাসিলের চেয়েও জামায়াতীদের বেশী জোর টিকে থাকার সংগ্রামে, ক্ষমতার প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি আদায়ে আর অর্থনৈতিক শক্তিমত্তা বৃদ্ধির নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রবণতায়। অন্য দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ‘গোলযোগ-গন্ডগোলে’ জামায়াতীদের ‘অনুপ্রেরণা ও মদদ’ থাকে। দেশকে অস্হিতিশীল রাখায় তাদের ‘অশুভ’ রাজনৈতিক ফায়দা পূরণ হয়। প্রশাসনসহ বিভিন্ন ‘ইন্সটিটিউশনে’ জামায়াতীরা তাই ‘পাকি’ নাক গলায়। যতো বেশি বিভক্তি ও কোন্দল ততোই জামায়াতীরা নিরুপদ্রব! ধর্ম ভীরু মানুষের ধর্ম ভীতিকে ধর্মান্ধ মৌলবাদে পরিণত করার দূর্গন্ধময় গলির অন্নেষনে থাকে জামায়াতী ধর্ম ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশের ইন্সটিটিউশনগুলোকে ‘রাজনৈতিক’ পরিকল্পনায় মর্যাদাহীন ও বিতর্কিত করা হচ্ছে। একমাত্র সেনাবাহিনী ভিন্ন অন্য কোন ইন্সটিটিউশনের সার্বভৌম মর্যাদা অক্ষুন্ন নাই। সেনাবাহিনীই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ‘আমি’র চেয়েও ‘আমরা’ মন্ত্র অনেক বেশী সম্মানিত, পরীক্ষিত ও প্রয়োগকৃত।
আত্ম-বলিদানের এই মহতী মানসিকতার কারণে সেনাবাহিনী এখনো জাতির আস্হা ও আশা-আকাঙ্খার প্রতীক। এখনো সকল জাতীয় সঙ্কট মোকাবেলায় সেনাবাহিনী মোতায়নের জনদাবি উঠে। ভোটের নির্বাচন বিতর্কহীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার বাসনায় রাজনৈতিক দলগুলো এখনো নির্বাচনের দিন সেনাবাহিনীর উপস্হিতি প্রার্থনায় মাতেন। এই বিশ্বাস ও আস্হা সেনা বাহিনীর জন্যে বড়ই সম্মানের। গৌরবের। জাতিসংঘের নীল টুপির সম্মানজনক বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিষ্ঠা, সততা ও দায়িত্ব পালণের এক উজ্জ্বল উপমা। অন্যন্য ও অনস্বীকার্য দৃষ্টান্ত। সেনাবাহিনী এমন এক চেইন অব কমান্ডের প্রতিষ্ঠান যেখানে কোনো জেনারেল একক নন। সেনাবাহিনীতে জেনারেলরা আসেন ও যান কিন্তু সেনাবাহিনীর রীতি-নীতি, ইউনিফর্মের সম্মান ও মর্যাদা আর শপথের অংগীকার অভিন্ন থাকে ভালো ট্রেনিংয়ের গুণে।
অন্য যে কোনো বড় সংগঠনের মতোই সেনাবাহিনীতেও বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষের খোঁজ মেলে। অসন্তুষ্ট কয়েকজন বিরক্তি ছড়ায়। বিব্রত করে অন্যদের। এই স্বাভাবিক চলমান প্রক্রিয়ায় মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর সুশংখল চেইন অব কমান্ড যথেষ্ট।
প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়ার খাকি ‘সাফারি’ গণতন্ত্রে এক হাজারের বেশি সেনাবাহিনীর সদস্যকে ‘শৃংখলা’ রক্ষার নামে চূড়ান্ত বিচারের মুখোমূখি করা হয়েছিলো। এরশাদের জমানাও ভিন্ন কিছু ছিলোনা। সেনাবাহিনীর পদোন্নতি ও বদলীতে বারবার ‘ভাই-বেরাদারদের রাজনৈতিক প্রভাব’ বিস্তার হয়েছে। বহু প্রতিশ্রুতিশীল ও প্রতিভাবানেরা অগাধ বিস্ময়ে বাধ্যতামূলক অবসরের মোকাবেলা করেছেন। এই অনাকাংখিত
হস্তক্ষেপ সেনাবাহিনীর সার্বভৌম মর্যাদাকে ক্ষুন্ন ও বিব্রত করেছে। প্রতিষ্ঠানের চেইন অব কমান্ড রক্ষার দীপ্ত মানসিকতায় সেইসব রাজনৈতিক বিবেচনার বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। উচ্চ পদস্হ সেনা কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের ‘ইন্টিগ্রিটির’ স্বার্থে এইসব ‘বলীদান’ মেনে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌম মর্যাদাকে সম্মানিত ও গৌরবান্নিত করেছিলেন। সেনাবাহিনীর ‘সমষ্টিগত’ সিদ্ধান্ত সবসময় প্রশংশিত হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপও হয়েছে বহুবার। সেনাবাহিনীর সমষ্টিগত ঘাড়ে ভর দিয়ে জিয়া-এরশাদের একক ক্ষমতা গ্রহণের মতো ন্যাক্কারজনক অধ্যায় সেনাবাহিনীর মান-সম্মানে কালো দাগ। কিন্তু জাতীয় ঐক্য রক্ষার ওয়ান ইলেভেনে সেনাবাহিনীর কাংখিত হস্তক্ষেপ আম-জনতার তৃণমূলের সমর্থিত ও প্রশংশিত হয়েছিলো কারণ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক তৎপরতায় দেশ সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পেরেছিলো। কিছু ‘অবাধ্য, দূর্বিনীত ও চেইন অব কমান্ড ভাংগা’ কর্মকর্তা নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতায় ওয়ান ইলেভেনকে ব্যর্থ, বিব্রত ও প্রশ্নবিদ্ধ করলেও ওয়ান ইলেভেনের মূল কুশলীবরা সুষ্ঠু ভোটার তালিকা প্রণয়নের অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশকে গণতান্ত্রিক রাস্তায় ফেরত এনে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি ও মর্যাদাকেই সম্মান্নিত করেছিলেন। সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের আস্হা ও বিশ্বাস আরো নিবিড় হয়েছে।
সেনাবাহিনীতে হালে অসন্তোষের একটা সামান্য ঘটনা ঘটেছে জামায়াতী স্নেহধণ্য হিজবুত তাহরীরের প্রত্যক্ষ মদদে। একজন নির্বিষ (অবসরপ্রাপ্ত অর্থে) মেজর ও কের্ণল পদমর্যাদার সাবেক কর্মকর্তা প্রবাসী এক বাংলাদেশির সহযোগিতায় সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলো। কমনসেন্স বলে মোল্লার দৌঁড় মসজিদ অব্দি। এই দুই সাবেক সেনা কর্মকর্তা হয়তো সামান্য কিছুটা গুঞ্জন-অস্হিরতা সৃষ্টি করতে সামর্থ্য হতো কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল, সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধা সহ উচ্চপদস্হ সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা? বিশ্বাস হতে দিলে চায় না। সুশৃংখল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দক্ষতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তারা কেউই এই ‘অলীক ও আষাঢ়ে’ গল্পে নিবেদিত হবেন না। অথচ সেনাবাহিনীর এই অভ্যন্তরীন ঘটনা গুজব-গুঞ্জনের ডাল পালা মেলেছে। কেন, এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু সেনাবাহিনীর মধ্যে নেই। এই প্রশ্নের জবাব রাজনৈতিক দলগুলোকেই দিতে হবে। গুজব-গুঞ্জনের জন্ম দিয়েছেন সেনাবাহিনীর সাবেক গৃহবধু তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী ইন ওয়েটিং বেগম জিয়া। চাটগাঁর পলোগ্রাউন্ডের বক্তব্যে তিনি প্রথম দেশবাসীকে জানালেন সেনাবাহিনীতে ‘কিছু একটা ঘটেছে’। বেগম জিয়া সাবেক সেনা গৃহবধু হিসেবে, প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্বপালনের সুবাদে জানেন, রাষ্ট্রের কিছু কিছু গোমর গোমরেই রাখতে হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার দেশপ্রেমিক স্বার্থে। বেগম জিয়ার দায়িত্বহীনতায় সেনাবাহিনীকে মুখ খুলতে হয়েছে।
কিন্তু ঘটনার পরম্পরায় আরো কিছু আত্মঘাতী গুজব-গুঞ্জন ডানা মেলছে। গুজবঃ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদা পূরনের ব্যর্থতা ও তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে অনমনীয় অবস্হানের কারণে আশঙ্কার ‘রাজনৈতিক সংকটে’ আরেকটি ওয়ান ইলেভেনের ‘প্রয়োজনীয়তা’ উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিলো। ‘বাঘ’ আসিবার পূর্বেই ‘বাঘ আসিলো বাঘ আসিলো’ প্রচারণায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আরাজনৈতিক অভিলাষে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীন এই অনাকাংখিত দূর্ঘটনাকে প্রকাশ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মধ্যিখানে ফেঁসে গেছে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড মান্য করা মানসিকতা।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীন বিষয়গুলো সেনাবাহিনী নিজে হ্যান্ডেল করলেই গুজব-গুঞ্জন কমে।
ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com
বাংলাদেশ সময় ১১০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১২