ধর্ষণ বাড়ছে, বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যাও। একই সঙ্গে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা।
সামাজিক অবক্ষয়, মাদকের বিস্তার, কর্মহীনতা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা, পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রসার; সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষের হীন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতরা হয়ে পড়ছে অপ্রতিরোধ্য। শিশু থেকে কিশোরী, যুবতী থেকে বৃদ্ধা, স্কুল ছাত্রী থেকে পোশাককর্মী, ডাক্তার, আইনজীবী এমন কি ভিখারিনীও রেহাই পাচ্ছে না মানুষরূপী এসব হায়েনাদের হিংস্র থাবা থেকে। ধর্ষকরা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত থাকছে না, ঘটনা ধামাচাপা দিতে ঘটাচ্ছে নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
একাধিক সংস্থার হিসাবে গত ছয় বছরের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে যতটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে গত ৬ মাসেই তা ছাড়িয়ে গেছে। সে হিসাবে এ ভয়াবহ অপরাধ এখন দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। ধর্ষিতাদের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ হচ্ছে, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন হচ্ছে দেশের আনাচে কানাচে। মিছিলে স্লোগান উঠছে, অপরাধীর ফাঁসি চাই। আল্টিমেটাম দেওয়া হচ্ছে কখনো ৪৮ ঘণ্টার, কখনো আবার তিন দিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত। পরে অন্য ঘটনার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পুরনো সব ঘটনা।
ধর্ষণ রুখে দিতে প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, প্রতিটি পরিবারে যেমন কন্যা সন্তান আছে, তেমনি ধর্ষকরাও কোনো না কোনো পরিবারের সন্তান। তাই ধর্ষণের মতো সামাজিক মরণব্যাধি নির্মূলে প্রতিটি পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে হবে, পাশাপাশি মিডিয়াতে এ ধরনের ঘটনা প্রচারে আরো কৌশলী হতে হবে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি, তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে বা পরবর্তী সময়ে স্কুল-কলেজে যথাযথ জ্ঞানচর্চা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। এ ধরনের ঘটনার মধ্যে সাইকোলজিক্যাল একটি ব্যাপারও কাজ করে। কোনো স্থানে একজন করল, তা প্রচার হওয়ার পর দেখা যায়, এক নাগাড়ে এখানে-ওখানে হতেই থাকে।
এটা হওয়ার কারণ, যাদের মধ্যে সেই আদিম মনোবৃত্তি দমানো যায়নি তারা ঘটনার সংবাদ জেনে উদ্বুদ্ধ হয়। নিউইয়র্ক শহরে প্রচুর খুনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারা সেটা সেভাবে প্রকাশ করে না ওই একই কারণে। যখন কেউ ধর্ষণ করে বা হত্যা করে তখন সে আনকনশাস থাকে। অবদমিত প্রবৃত্তি তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ ধরনের ঘটনা বাড়তে দিলে তো সামাজিকীকরণ থাকবে না। আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত, পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন ও মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কটা বাড়াতে হবে।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। মূল্যবোধ, আদর্শের অবক্ষয় হচ্ছে। বিকৃত যৌন আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবারে অভিভাবকের শাসনটাও হচ্ছে না, শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যৌন শিক্ষার ধারণা না থাকায় যৌন আগ্রহটা বেশি। ধর্ষণের সময় ধর্ষক মনে করছে আমরা এনজয় করছি। চারদিকে দেখছি ধর্ষকের পর এভাবে মেরে নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অশিক্ষিত ধর্ষকরা তারই অনুসরণ করছে।
পুলিশ ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতাদের মতে, থানায় দায়ের হওয়া মামলা এবং পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে নারী ও শিশু ধর্ষণের প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা ভিকটিমের পরিবার গোপনের চেষ্টা করে। কিন্তু এরপর যে তথ্য পাওয়া যায় সেটা ভয়াবহ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সচেতনতার অভাবে বাড়ছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। এসব পরিবার সব সময় নানা ধরনের টানাপড়েনের মধ্যে থাকে। এর সুযোগ নেয় এক ধরনের নরপশু। তারা সুযোগ বুঝে এসব পরিবারের শিশুদের নিজের কাছে নেয় এবং অবুঝ শিশুরা তাদের লালসার শিকার হয়। সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে বেশিরভাগ নারী বিচার চাইতে যান না। আবার যেসব নারী বিচার চাইতে যান, তাদের পুলিশ, প্রশাসন ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে যথেষ্ট হেনস্তা হতে হয়। ধর্ষণের অভিযোগগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রমাণ হয় না। এর মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে ঘটনার তদন্ত প্রভাবিত হওয়া।
ধর্ষণের শিকার অধিকাংশ নারীর বয়স ১৮ বছরের মধ্যে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর বেশিরভাগ সময় ধর্ষণের শিকার ওই নারীর সাথে ধর্ষকের বিয়ে দিয়ে অথবা ভুক্তভোগীর পরিবারকে টাকা দিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করে ফেলা হয়। স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে পড়েও অনেক ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়।
আন্দোলনের মুখে আইন সংশোধন
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনার ধারাবাহিকতায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ রাতে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে এক গৃহবধূকে স্বামীর সামনে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন কয়েকজন। ওই ঘটনার কদিন পর ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে একদল যুবকের পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
পরে ৯ অক্টোবর বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে ‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নারী নির্যাতন বিশেষ করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি জানানো হয়। শাহবাগ থেকে সেই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০- এর কয়েকটি ধারা সংশোধন করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো— ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আগের আইনে ধর্ষণের শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
গত ১৪ অক্টোবর এ সংশোধিত আইন অধ্যাদেশ আকারে জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ।
শুধু আইন করেই নয়, ধর্ষণ বন্ধে ‘বিচার নিশ্চিত’ প্রয়োজন
দেশজুড়ে একের পর এক ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে তুমুল আন্দোলনের মুখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে সম্প্রতি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। আগে কেবল সংঘবদ্ধ ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকলেও আইনের সংশোধনীতে ধর্ষণেরও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়।
কিন্তু আইনের এমন সংশোধনীর পরও বন্ধ হচ্ছে না ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের ঘটনা। এক্ষেত্রে অতীতে বিচারহীনতার নজিরকেই দায়ী করছেন আইনবিদরা। তারা বলছেন, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত না করলে আইন সংশোধন করেও কোনো ফায়দা হবে না। বিচার নিশ্চিত না করে যত কঠোর আইনই হোক, ফলপ্রসূ হবে না।
আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণ-নারী নির্যাতন বন্ধে সমাজে এই মেসেজ বা বার্তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে, অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে। সেজন্য দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন, ঘটনার সঠিক অনুসন্ধান ও তদন্ত এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছা জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক