বাংলা ব্লগের প্লাটফর্ম হিসেবে সদ্য পরিচিত হলাম ব্লগ বাংলার সাথে। জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজের ব্লগ হিসেবে এটি বিকশিত হওয়ার পথ করে নিয়েছে।
ব্লগার হিসেবে লেখালেখি শুরু করেছিলাম বছর তিনেক আগে। লেখালেখির অভ্যাস তখনো অতটা হয়ে ওঠেনি। তখনকার ব্লগিং বলতে মনে হতো শুধু ভাল ভাল লেখা গ্রোগ্রাসে গিলতে থাকা আর নিজের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা। পরবর্তীকালে যখন লেখালেখির ধারায় আসি ধীরে ধীরে ব্লগিং এর পটপরিবর্তন হতে দেখা যায়। বাংলাদেশে রাজনীতির আকাশে ঘোর অমানিশার প্রভাবে কিছু ব্লগার বাংলা ব্লগের মতো মুক্ত স্বাধীন প্লাটফর্মগুলোতেও এর কালো ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করতে থাকে।
একসময় ব্লগারদের মধ্যে সৃষ্টিশীল ও মানসম্মত লেখার তুলনায় একে অন্যকে আক্রমণ করা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, পোস্টের হিট বাড়ানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে। একসময় মনে হয়েছে ব্লগ আর মাতৃভাষায় মুক্তমত প্রকাশের স্থান হিসেবে টিকে নেই। এটি পরিণত হয়েছে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে। আরো অবাক হয়েছি মধ্যরাতের দিকে যখন বেশিরভাগ মডারেটর নিদ্রা যেতেন, তখন মডু ঘুমায় নামে অশ্লীল ১৮+ পোস্ট দিয়ে আড্ডা জমানো হতো ব্লগপাড়ায়। পরিস্থিতি আরো চরমে ওঠে যখন দেখি প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একধাপ এগিয়ে যেতে এক এক গ্রুপ একে অন্যকে অশ্লীল সব ট্যাগ করা শুরু করেছে। কেউ ছাগু, কেউ ভাদা, কেউ হাম্বা, কেউ ভিম্পি ইত্যকার নানা আজগুবি সব শব্দচয়ন দেখে মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার অবস্থা হতো। ভাবতাম, হায় বাঙালি! তোরা স্বাধীনতার চার দশক পার করেও বাংলাদেশি হতে পারলি না! উন্নতি-উন্নয়নের চেষ্টা না করে এখনো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বেই আটকে আছে। এরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, স্বাধীন বাংলাদেশের আলো-বাতাসে এদের বেড়ে ওঠা কিন্তু মতের কতো অমিল!
কেউ দেখা গেছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কথা বলছে, কেউ সব লাজলজ্জার মাথা খেয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সারিন্দা বাজাচ্ছে। কেউ দেখা গেছে বাংলাদেশের সাথে ভারতের বা পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলার দিন বাংলাদেশ টিমের বিরুদ্ধে পোস্ট করেছে। কাউকে দেখা গেছে বাংলাদেশের অবস্থা বাদ দিয়ে পাকিস্তান বা ভারতের নানা বিষয় নিয়ে মেতে উঠেছে।
এর পরেও কিছু ব্লগারকে দেখা দেখা গেছে রাজনৈতিক ক্যাচালের উর্দ্ধে থেকে, দেশ ও জাতির নানা সমস্যা নিয়ে ব্লগে ঝড় তুলতে। কেউ কেউ গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী প্রভৃতি নিয়ে রুচিশীল লেখনীর পরিচয় দিয়েছেন। কথা প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে নন্দিত ব্লগার ইমন যুবায়েরের কথা যার ব্লগ হয়ে উঠেছে বাংলালেখনীর একটি সমৃদ্ধ আর্কাইভ, ব্লগার নাফিস ইফতেখার যার নাম তার পরিচয় বহন করে, ব্লগার জুলভার্ন ভ্রমণকাহিনীর লেখক হিসেবে পুরো বাংলাব্লগ জগতে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। সীমান্তে বিএসএফ এর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ, টিপাইমুখ বাঁধ, ভিকারুননিসা কিংবা রুমানা মঞ্জুর ট্রাজেডিতে ব্লগপাড়াকেই প্রথম সরগরম হয়ে উঠতে দেখা গেছে।
ব্লগীয় নতুন পরিভাষা হিসেবে গদাম (পশ্চাৎ দেশে লাথি ঝাড়া), পাকি (পাকিস্তান সমর্থক), ভিম্পি/বিম্পি (বিএনপি), আম্লিগ/হাম্বা (আওয়ামিলীগ), ভাদা (ভারত এর দালাল), পাদা (পাকি দালাল) ভাকুর (ভারতীয় কুকুর), ছাগু/জাশি (জামাত শিবির), টেকি (প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নাম), খিকচ (চাপা হাসির বহিঃপ্রকাশ), ধইন্যা (ধন্যবাদ), ল্যাঞ্জা বাইর হওয়া (বিতর্কে হেরে যাওয়া), কুত্তালীগ (ছাত্রলীগ), লুলামী করা (মেয়েঘেষা কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া), ছাইয়া (ছেলে হয়ে মেয়ের ভান করা), তেনা পেঁচানো (অযথা তর্ক করা), পিছলানো (পাশ কাটিয়ে চলা) ইত্যাদিকে অনেক বোদ্ধা বাংলা ভাষাশৈলীর বিকৃতি হিসেবে মনে করেন।
কিন্তু আমরা যারা ব্লগার আমাদের কাছে এগুলোকে নিছক হাসির খোরাক বলেই মনে হয়। কারণ, ওইসব বোদ্ধারা তাদের বেশির ভাগ কথার মধ্যেই বাংলা-ইংরেজি মিশ্রণ দিতে পছন্দ করেন। তবে আমাদের মাতৃভাষার আংশিক রূপান্তর এর মাধ্যমে কিছু শব্দ যেমন শিরাম/সৈরাম (সেরকম), চ্রম (চরম), মুঞ্চায় (মন চায়), ভাল্লাগ্লো(ভালো লাগলো), পিছলানো (কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া), তেব্র (তীব্র), পিচলামি (ইসলামি), মালানি (হিন্দুয়ানী), জসিলা (জটিল)- ইত্যাদির পৌনপুনিক ব্যবহার আমাদের সমস্যায় ফেলতে পারে। একজন ব্লগার হিসেবে এইসব শব্দের বহুল ব্যবহারের ধারাবাহিকতায় পরীক্ষার খাতায় এই ধরণের কিছু শব্দ মনের অজান্তেই ব্যবহার করে ফেলি যেটি পরীক্ষকের কাছে নিতান্তই আজগুবি লেগেছে।
ব্লগের ক্ষেত্রে সবথেকে মজার ব্যাপারটা আমার মনে হয়েছে বিদেশি শব্দকে নিজের মতো করে ব্যবহার করাটা। এতে অনেক বেশি মজাও পাওয়া যায় পাশাপাশি একটু গুরুগম্ভীর ভাবটাও কাটানো যায়। যেমন বিদেশি শব্দ প্লাচাইলাম (ইতিবাচক রেটিং বা ভোট দেয়া), ব্যান (নিষিদ্ধ), ব্লগান (ব্লগিং করা), পোস্টান/পুস্টানো (লেখা দেয়া), ইউজান (ব্যবহার), হেল্পান (সহযোগিতা করেন), স্লিপান (ঘুমানো), ইটাচ্ছি (খাচ্ছি), কম্পু (কম্পিউটার), ল্যাপু (ল্যাপটপ) ইত্যাদির ব্যবহার নিতান্ত বেরসিককেও হাসাতে পারে বলে আমার বিশ্বাস, তবে বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণটা জরুরি।
একটু ভিন্নভাবে দেখতে গেলে ব্লগারদের মজার মজার নাম অনেক ক্ষেত্রে হাসির কারণ হতে পারে। ব্লগ ইউজারের নিকনাম হিসেবে চিকন মিয়া, গেদু চাচা, চেয়ারম্যান, খালি ব্যান খাই, পিরীতির নাম কাডালের আঠা, পুলার নাম লিপিস্টিক খান, ছেড়ে দে শয়তান, আজীব পোলা, দুলাভাই, আমার শালী লণ্ডনে, ডিজিটাল পোংটামি, ডিজিটাল হাসি, ভেজা বিলাই, জাকারবার্গের চেলা, স্টিভ জবস আমার শালা, ভাদাইম্যা, বদনা দে নয়তো উষ্টাদিমু, বিজলী এখন ঢাকায়, ধর সাইকেল কমাইয়া আসি, বদমাশ, অধমের নাম বলদা ছেলে- তখন মনের অজান্তেই অনেকের হাসি পেতে থাকে।
এর পাশাপাশি যোগ হয়েছে বাংলা বাক্য ও শব্দের নতুন রূপ। হাহাপগে (হাসতে হাসতে পড়ে গেলাম), হাহালুখুগে (হাসতে হাসতে লুঙ্গি খুলে গেল), চ্রম (চরম), খ্রাপ(খারাপ), পুত্তম(প্রথম), তেব্র(তীব্র), বেয়াপক/বেফুক(ব্যপক), মজাক লইলাম (খুশি হলাম), পালাদিমুচা (পাছায় লাথি দিতে মন চায়), আবুআ (আয় বুকে আয়)- এসব নিয়ে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
আমার কয়েকজন ব্লগার বন্ধু আছেন যারা বই কেনাকে একটি হাস্যরসের বিষয় উল্লেখ করে উড়িয়ে দিলেন। মূলত তাদের অভিমত হলো যে, ‘বর্তমান এই (ইন্টারনেটের ব্লগ) যুগে টাকা দিয়ে বই কেনার কোনো মানে হয়না। ’ তাছাড়া ঘনবসতিপুর্ণ ঢাকায় বই কিনে লাইব্রেরি দেয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গাও আমার নাই। তাই আমি সব বইয়েরই সফট কপি সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে একটি বিশাল লাইব্রেরি তৈরি করেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার অনলাইন লাইব্রেরির সমৃদ্ধির হেতু- বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত চার বছরের ছাত্রজীবনে কতদিন লাইব্রেরিতে গেছি তা খুব সহজেই হাতে গুণে বলতে পারি। এটা এই বাংলাব্লগে ব্লগিং করার অর্জন বলতে পারেন।
তিউনিসিয়া ও মিশরে গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ভারতীয় চ্যনেল ইএসপিএন এর ধারাভাষ্যকার নভোজিৎ সিং সিধুর কটুক্তি, কিংবা বিশ্বের আনাচে-কানাচে বাংলাদেশের কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা এর কিছুই চোখ এড়ায়নি বাংলাদেশের ব্লগারদের।
বাংলা ব্লগ প্রসঙ্গে এককথায় বলা যায়- এটি বিভিন্নজনের নানা বিশ্লেষণধর্মী লেখা সবার হাতের নাগালে এনে দিতে পেরেছে যেখানে নিজের অভিমতটিও প্রকাশ করা যায়। এখানে একই সময়ে সকলের মতামত প্রকাশ করার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে যা অন্য কোনো মাধ্যমে কস্মিণকালেও সম্ভব হতোনা।
অনেক দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি জীবনের প্রয়োজনে অন্নসংস্থানের আশায় দেশের বাইরে অবস্থান করেন। মা, মাটি, মাতৃভাষা আর দেশের জন্য তাদের প্রাণ আকুল হলেও একটি কথা বলার সুযোগ তারা পাননা। কিন্তু ব্লগের কল্যাণে তারা নিজেদের জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছেন। সারাদিন অর্থ উপার্জন করার মাধ্যমে এই সকল মানুষ একদিকে নিজের পরিবারকে স্বচ্ছল করার পাশাপাশি দেশের রেমিটেন্স বাড়ানোতে যেমন ভুমিকা রাখছেন অন্যদিকে সন্ধ্যার পর অবসরকে এই ব্লগের কল্যাণেই পার করছেন দেশের ব্লগারদের সাথে একান্ত আপনজনের মতো। এখানে শুধু সশরীরে উপস্থিত হওয়াই সম্ভব নয়- এছাড়া জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে এই তিনের আনন্দ আর আমোঘ বিধিতে দুঃখের নিনাদ সুরমূর্ছনার মতো ঠিকই বেজে ওঠে পুরো ব্লগ পরিবারে। তাই এই সকল মানুষের কাছে ব্লগের আবির্ভাব একটি আশীর্বাদ বলা যায়।
আবহমানকাল থেকে বাঙালির পরিচয় তারা পেটুক, তারা খায় খাওয়ায় আর তারা আড্ডাবাজ। এই হচ্ছে সাধারণত বাঙালির সংস্কৃতি। আগে দেখা যেত গ্রামে কোনো এক বাড়িতে কিংবা কোনো দোকানে বসে বিভিন্ন বয়সী লোক মিলিত হয়ে গল্প, পাল্টা গল্প কিংবা গ্রামের কোনো মজাদার কাহিনীর নানা দিক নিয়ে রসাত্মক বিশ্লেষণ ইত্যাদি করে সময় পার করতো। কিন্তু বাংলা ব্লগে প্রচলিত এ আড্ডা পোস্টের মাধ্যমে এখন আর সশরীরে কোন নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হতে হয়না। কেবল কম্পিউটারের সামনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোন স্থান থেকেই এ আড্ডায় যুক্ত হয়ে আড্ডা বা গল্পে গল্পে সময় পার করা যায়।
আমার পরিচিত প্রায় অর্ধশতাধিক ব্লগার আছেন যারা তেমন আড্ডাবাজ ছিলেন না, কিন্তু ব্লগে এসে একান্ত আপনজনের মতো অন্যদের সাথে ঠিকই সময় পার করেন। আমাদের কৃষ্টি কালচার সংস্কৃতিক ঐতিহ্যসহ সকল আঙ্গিক বিবেচনা করলে বাংলা ব্লগ এক নতুন যুগের সূচনা করেছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে ছেলেমেয়েরা এর ভালো দিকগুলোকে কাজে না লাগিয়ে সাধারণ সময় কাটানোর মাধ্যম ভাবলে এটা ক্ষতির কারণ হবেই- এমন ভেবে বসে থাকার অবকাশ নেই। পৃথিবী আজ এগিয়ে গেছে। এগিয়ে যেতে হবে আমাদেরকেও।
২০০৬ সালের দিকে বাংলা ব্লগের যাত্রা শুরু হওয়ার পর আজ এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে- অনেক বলে থাকেন বাংলাদেশে ব্লগার থেকে ব্লগ বেশি। সামহোয়্যারইন, সচলায়তন, আমার বর্ণমালা, চতুর্মাত্রিক ব্লগ, নাগরিক ব্লগ, প্রতীক ব্লগ, সোনার বাংলাদেশ ব্লগ, ওপেস্ট, রঙমহল, বিডি নিউজ-২৪ব্লগ এগুলোর সাথে যুক্ত হলো দেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ বাংলানিউজ এর ব্লগ বাংলা। ব্লগার হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা প্রচলিত ধারার বাইরে এসে ব্লগ বাংলা হয়ে উঠবে স্বাধীনদেশে স্বাধীনভাবে মাতৃভাষায় মনের কথা বলার এক অনন্য মাধ্যম হিসেবে। মডারেশণ বোর্ডের স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা আর নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় অনেক ব্লগ প্রতিষ্ঠার পর মাথাতুলে দাঁড়াতে পারেনি। অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্লগ তাদের নীতিগত অস্পষ্টতা আর বুদ্ধিভিত্তিক দৈন্যতার কারণে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে যেখানে সংবাদপত্র হিসেবে তার প্রচার, প্রসার ছিল আকাশচুম্বি। অনেক ব্লগ তার সার্ভারের অন্ধকার থেকে প্রচার জগতের আলোর মুখ দেখতে পায়নি। আমরা আশা রাখছি- ব্লগ বাংলা এইসব নীতিগত দৈন্য থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পথের সন্ধান দিতে সম্ভব হবে। নিউজ এজেন্সি হিসেবে বাংলানিউজ যে স্বচ্ছতা ও সম্মান অর্জন করেছে ব্লগ বাংলার মডারেশনে সেটি ধরে রাখতে সক্ষম হবে - এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
আদনান আরিফ সালিম অর্ণব, ব্লগার ও কলামিস্ট
aurnabmaas@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৪ ঘণ্টা, ২৭ জানুয়ারি, ২০১২