ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ইঁদুর দৌড় খেলা! 

শাখাওয়াৎ আলম রনো, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০২১
ইঁদুর দৌড় খেলা! 

ইঁদুর দৌড় বা র‍্যাট রেস! একটা গেমিং মডেল! খেলাটি যিনি প্রোগ্রাম করেন তিনি সাধারণ মানুষের জীবন চলার পথে ব্যবহৃত বেশ কিছু প্রচলিত ধারণা ও অভ্যাসকে পর্যবেক্ষণ করেন! বলতে গেলে তার নিজের জীবন থেকেই নেওয়া! কিছুটা মনোপলি গেমটি খেলা, যারা খেলেছেন তারা বুঝবেন!

সংসার জীবন শুরুর সময় থেকে এই র‍্যাট রেসের সূচনা বলা যায় বা তারও আগে। কিংবা তারও আগের আগে।

সংসার শুরু মানে বিয়ের আয়োজন, তা যতই যৎসামান্য হোক না কেন। পরিবার ও অভিভাবকদের থেকে একটা বড় অংশ, বাকিটা নিজের কিছুটা সঞ্চয়, ব্যাংকের লাইফস্টাইল লোন, এমন কি ধার কর্য! অনুষ্ঠান যতটা সুন্দরভাবে আয়োজন করা যায় নববধূ আর নতুন বরের জন্য। যৌতুক, উপঢৌকনের বাড়তি সামাজিক সমস্যা এখানে উহ্য রাখি।

সংসার শুরু হলো। আর সংসার শুরু হওয়া মাত্র রেসের পরবর্তী অধ্যায়। হানিমুনের মুড চলে যেতে সময় লাগে না সঞ্চয়ের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আর ব্যাংকিং নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে করতে। চাকরি, বেতন, প্রোমোশন সব প্রতিযোগিতায় দৌড়াতে হবে পাল্লা দিয়ে। স্বামী-স্ত্রী দু'জনকেই।  

ভবিষ্যৎ অর্থাৎ ফিউচার সুনিশ্চিত করতে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে ক্রেডিট কার্ড, গাড়ি কেনার লোন, ফ্ল্যাট কেনার লোন, কনজুমার লোন, লাইফস্টাইল লোন ইত্যাদি ইত্যাদি। স্ট্যাটাসের সাথে কম্প্রোমাইজ করা যাবে না কোনভাবেই। ধীরে ধীরে একদিন সব শোধ হয়ে যাবে।

এক সময় লোনের কিস্তি বা ইন্সটলমেন্ট দেওয়ার পালা চলে এলো। এর মাঝে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে খরচের ব্যাপ্তি বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিন বাড়তি ইন্টারেস্ট গুনতে হচ্ছে। ও হ্যাঁ, গাড়ি-বাড়ির সাথে লাইফ ইন্স্যুরেন্স কিন্তু লাইফস্টাইলে জায়গা করে নিয়েছে পাকাপোক্তভাবে। এসব করতে করতে জীবনটা কিস্তি, কিস্তি আর কিস্তি! র‍্যাট রেস আর কি!

কিস্তি নিয়মিত রাখতে চাকরিতে দায়িত্বের বাইরে গিয়ে প্রতিযোগিতা, কর্পোরেট পলিটিক্স, সরকারি ক্ষেত্রে ঘুষ আর বেসরকারি ক্ষেত্রে কমিশন সব জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মিলেমিশে একাকার।

ব্যাস হলো তো! এবার স্ট্রেস আসার পালা শরীর-মন সবখানে। ঘরে-বাইরে-পরিবারে। সোসাইটি আর রাষ্ট্র বাদ যাবে কেন? র‍্যাট রেসে একবার যখন নেমেছি ‘আমিই জিতবো’ ভাবনাটা বাদ দিলে চলবে না।

মাঝখান দিয়ে যদি সৌভাগ্যক্রমে বা নেহাতি ভুলবশতঃ আবেগ ভালোবাসার মিলনে নতুন কোন জীবন পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়ে যায়, বেচারা না বুঝেই র‍্যাট রেসের সামনের দিনের প্রতিযোগী হয়ে যাবে।  

সন্তান এলো- কিছুদিন আনন্দ হৈ হুল্লোড় চললো পরিবার পরিজনদের নিয়ে। যাহ বাবা! সেও একদিন স্কুলে যাওয়ার বয়সে পৌঁছে গেছে। খোঁজ শুরু হলো ভালো স্কুলের, নামকরা স্কুল, সহজে ভর্তি হওয়া যায় না এমন স্কুল হতে হবে। ডোনেশন লাগলে দেব, অসুবিধা নেই। আমাদের দাদা-নানা ভালো স্কুলে পড়েছেন, আমাদের বাবা-মা নামীদামী স্কুলে পড়েছেন, আমরা পড়েছি। সন্তানকেও ভালো, নামীদামী স্কুলে ভর্তি করতে হবে। না হলে মানুষ হবে কিভাবে?

জীবনটা চাকরি, বেতন, পার্ট টাইম, উপরি, কিস্তি, ইন্টারেস্ট, সেভিংস, একটার জায়গায় দুটা, দুটার জায়গায় তিনটা ক্রেডিট কার্ড, লোন আর ইন্স্যুরেন্স নেওয়ার পালা শেষ হয় না আর।

পাশাপাশি চলে সন্তানকেও র‍্যাট রেসের জন্য তৈরি করা। পড়শোনা, পড়াশোনা, পড়াশোনা আর প্রতিযোগিতা। সবকিছুতে প্রতিযোগিতা। আর্ট, অ্যাথলেটিক্স, এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিস, স্পেলিং, ম্যাথ অলিম্পিয়াড, ইংলিশ অলিম্পিয়াড সব চাই সব।  

এক সময় আমাদের সন্তানরাও র‍্যাট রেসে দৌড়াবে নিজেদের অজান্তে। প্রিয় সন্তানকে আমরা অনেকেই হয়তো বলিনি ‘নিজের মতো করে বাঁচো, নিজের মতো জীবনকে গড়ে তোল। আমি তোমার পাশে আছি। ’

নতুন সম্ভাবনা আসবে কোত্থেকে?

লেখক: কর্ণধার, ব্র্যান্ড কন্সোর্টিয়াম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।