প্রিয় কবি সাযযাদ কাদির মানবজমিনে তার লেখার শেষটায় চমৎকারভাবেই ইতি টেনে বলেছেন, নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়? সাযযাদ কাদির একাধারে একজন তুখোড় লেখক, কবি, সাংবাদিক, সরকারি চাকুরে, বাংলাদেশের বিরাজমান সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণু অবস্থাকে একটিমাত্র বাক্যে এতো সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন, সেজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় কবি সাযযাদ কাদির ভাই।
ইংল্যান্ড,আমেরিকায় কিংবা ইউরোপের কোনো দেশে জাতির এই বিরাজমান সমস্যা নিয়ে স্বনাম ধন্য কোনো কবি-লেখককে কলম ধরতে দেখলে সরকারের উপর মহল থেকে নড়ে-চড়ে বসতো, তড়িত ব্যবস্থা নিতো সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়তো, আইনসভায় সরগরম হয়ে উঠতো, কিন্তু আফসোস আমাদের দেশের সরকার তথা প্রশাসন একেবারে নির্বিকার।
গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় দল-মত নির্বিশেষে সকলের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, মিছিল, মিটিং, সভা, সমাবেশ করার অধিকার থাকবে, এটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু মহাজোট সরকার বিরোধীদলকে কোনো ধরনের সমাবেশ, মিছিল, মিটিং করতে দিতে নারাজ। যখনই কোনো মিছিল-সমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়, তখনই দেখি পুলিশ ও গোয়েন্দা দিয়ে নতুন এক ভেলকিভাজি- যে, জঙ্গি ও নাশকতার নানান কল্প কাহিনী ছড়িয়ে দমন-পীড়ন এর মাধ্যমে বিরোধী মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার নতুন নতুন পরিকল্পণাতে সরকার ব্যস্ত। এটা গণতান্ত্রিক শাসনের লক্ষণ নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পূণর্বহালসহ আরো কিছু দাবিতে বিরোধীদলের ডাকা গণমিছিলকে পণ্ড করে দেওয়ার জন্য একের পর এক ১৪৪ ধারা জারি, পাল্টা-পাল্টি কর্মসূচি, কোনো কিছু করে যখন জনতার অংশগ্রহণ বন্ধ করা যায়নাই, তখন রাস্তায় লাশ ফেলে দিয়ে অত্যন্ত অমানবিক কাণ্ড ঘটানো, বিএসএফ এর বর্বরতার ন্যায় গুলিতে নিহতের লাশ যেভাবে টেনে-হিঁচড়ে খাটিয়ায় তুলে পুলিশ নিয়ে গেলো, টেলিভিশনের পর্দায় সেই দৃশ্য দেখে যে কোনো সুস্থ্য ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। চার,চারটি তাজা প্রাণ রাজপথে নিভে গেলো, রক্তাক্ত হলো, অথচ গণতান্ত্রিক সরকারের দাবিদার মহাজোট সরকার ব্যস্ত নাশকতা আর জঙ্গির খোঁজে, পুরো প্রশাসন যন্ত্র যেন এই একটি কাজে খুব পারদর্শী।
কি আশ্চর্য, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা, এ যেন তুঘলকি কাণ্ড, যাকে জিজ্ঞেস করার যেন কেউ এখানে বর্তমান নেই। সবাই কি এক ব্যক্তির তোষামোদীতে ব্যতিব্যস্ত? এরই নাম কি গণতন্ত্র? এই রকম গণতন্ত্র আর এই রকম গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য আর কতো মায়ের কোল খালি করতে হবে, আমাদের নেতা-নেত্রীরা আর কতো লাশ ফেলে খুশি হবেন! জনগণের কাছে যদি খোলাশা করে বলতেন, তবে জাতি হিসেবে আমরা খুব উপকৃত হতাম। বহু মাও খুব উপকৃত হতেন, অন্তত তিনি কিছুটা হলেও বুঝতে পারতেন, কখন কোন মিছিলে, মিটিংয়ে গেলে তার সন্তান গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার শংকা রয়েছে।
সারা পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নানা মত, নানা পথের পার্থক্য লালন-পালন করে, সকল মত ও পথকে ধারন করে, জনগণের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে সরকার এবং প্রশাসনযন্ত্র ব্যস্ত থাকে, সরকারের কর্মকাণ্ড অন্তত জনকল্যাণমুখী হয়ে থাকে, আর আমাদের দেশে তার পুরোটাই উল্টোচিত্র ধঅরণ করে আছে। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং তার প্রশাসনযন্ত্র যেন সর্বদা অগণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থাকেও হার মানায়।
সর্বত্র চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নমূলক বিবেক-বিচার বহির্ভুত অত্যাচার, অযাচার, শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক সহিংসতা, ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা, আশান্ত শিক্ষাঙ্গন, ছাত্র রাজনীতির নামে যখন-তখন চড় দখলের মতো হল দখল, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, সরকারি ছাত্র সংগঠণের অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ, লাগামহীন সন্ত্রাস, তার ওপর দলীয় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য, বাসা-বাড়ি, জায়গা-জমি গিলে খেতে হবে- হজম হোক বা নাই হউক, ঘুষ, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন আমাদের প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থাও আজ কলুষিত-এই হলো আমাদের সামগ্রিক চালচিত্র।
তারপরেও সরকার তার স্তুতি আওড়াতে ব্যাস্ত। যখন মানুষের লাজ, শরম, বিবেক, বিচারবোধ লোপ পেয়ে যায়- তখনই কেবল এই রকম অবিবেচনা প্রসূত কর্মকাণ্ড করে থাকে। প্রশাসনযন্ত্রও তা সমর্থন করে থাকে। কিন্তু এটাতো কেবল আদিম, বর্বর সমাজে হয়ে থাকে, আধুনিক সভ্য সমাজেতো এই সব অবিচার-অনাচার চলতে পারেনা, চলতে দেওয়া যায়না।
সীমান্তে প্রতিবেশী দেশের অমানবিক হিউম্যান-শ্যুটিং অনুশীলনের বিরুদ্ধে সারাবিশ্বের বিবেকবান মানুষ যখন সোচ্চার, এমনকি ভারতের সব মানবতাবাদী সংগঠন এবং সেদেশের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’ পর্যন্ত যখন এই ধরনের বর্বরতার বিরুদ্দ্বে তাদের অবস্থান নিয়েছে, তখন আমাদের ক্ষমতাশালী দলের ক্ষমতাধর মন্ত্রী, দলীয় সাধারণ সম্পাদকের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তি রাবন রাজার মতো স্তূতিবাক্য আওড়ান। এমন ঘটনা দেখে লজ্জায় প্রতিবেশী দেশটি পর্যন্ত ভিমড়ি খেয়ে যায়। এই যখন নেতা-নেত্রীর আসল রূপ, জনকল্যাণ সেখানে তো সুদূঢ় পরাহত।
১৬ কোটি বাঙালি এখন প্রতিনিয়ত হিংসা আর জেদা-জেদী, জ্বালাও-পোড়াও, দুর্বৃত্তায়ন, নোংড়া নেতিবাচক লাশের রাজনীতিতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন, আমার কেন জানি মনে হয়- বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগণ প্রতিটি দিন যেভাবে শুরু করেন এই নেতিবাচক রাজনীতির পংকিলতা, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ নিয়ে, এই একই রকম ময়লা, দুর্ঘন্ধযুক্ত জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতির এই পংকিল আবর্জনার স্তূপ মন-মননে শ্রবণ আর ধারণ করে ঘুমুতে যান খুব যত্নের সাথে।
কোনোদিন এরকম না হলে বোধ হয় নিদ্রাভ্রম হবে, কেননা তারা বুঝেই গেছেন এই ধংস্বাত্ত্বক অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই। এ যেন আজব এক হীরক রাজ্য। এরকম বস্তা-পচা, দুর্ঘন্ধযুক্ত রাজনৈতিক মন-মনন দিয়ে আগামী প্রজন্ম কি করে পরিশীলিত হতে পারে, এটাওতো সমাজ বিজ্ঞানীদের এখন বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। কতটুকু অসহিষ্ণু হলে নিজ দলের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার পরিচালিত টক শো হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এটিএন বাংলাকে বাধ্য করতে পারে।
এই টক শো‘তে তো সরকারি এবং বিরুধীদল-উভয়ের আলোচনা করার সমান সুযোগ দেখানো হচ্ছিলো, তাও সরকার সহ্য করতে পারে নাই। আসলে সরকার বড় অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, ভিন্নমতের কোনো স্থান এখানে দিতে চায়না।
রাতারাতি সব কিছুই যে পাল্টানো যাবেনা, এটা যে কেউই ভালোভাবে বিশ্বাস করেন। তাই বলে কি একটা একটা করে আস্তে-আস্তে সুন্দর স্বচ্ছ পরিকল্পণা এবং তার ধীর-স্থির বাস্তবায়ন নিয়ে আগানো যায়না?অসম্ভব বলে পৃথিবীতে কিছুই নাই-সরকার কেন সুন্দর-স্বচ্ছ পরিকল্পণা নিয়ে এগোতে পারেনা? না পারারতো কোনো কারণ দেখিনা।
যে বাঙালি ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে মাধ্যমে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্টিত করতে পারলো, অযূত শত্রুর বিরুদ্ধে ১৯৬৬’র ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে নিজের অধিকারের প্রশ্নে আপোষহীন গণআন্দোলনের সূচনা করতে পারলো, ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে সশশ্র মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্বকে জানিয়ে দিলো- বাঙালি পারে তার অধিকারের জন্য রক্ত দিতে, সংগ্রাম করে জন্মভূমি বাংলাদেশকে বিস্বসভায় প্রতিষ্টিত করতে। কিন্তু এতসব করেও যদি এখন দেখায়- সেই বীর বাঙালি দেশ গড়তে পারেনা, একথা অবচেতন মনেও মন মানতে চায়না।
নেতা-নেত্রীদের এই সব ধংস্বাত্মক কার্যকলাপের জন্য আজও আমাদেরকে নানান বিচিত্র আখ্যায় আখ্যায়িত হতে হয়। অতি সম্প্রতি ইকোনোমিস্ট পত্রিকা তাদের প্রধান কলামে সেই মোঘল যুগের উপমা উল্লেখ করে সে দিকে আমাদেরকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
আমাদের বিরোধীদলও খুব একটা দায়িত্বশীল আচরন দেখাতে পারে নাই, গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থায় যা অপরিহার্য। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ আর ভিশন ২০২০ নামে সব মালই আমার মাল, সব কিছুই আমার, অন্য কাউকে দেবোনা, আমার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারবেনা- মোটামুটি ভিশন ২০২০ সব কল্পকাহিনী আজ জনগণের সামনে পরিস্কার, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমাদের বিরোধীদলওতো সরকার পরিবর্তন করে কোন ভিশন দেখাতে চায়, তাওতো পরিষ্কার নয়। আসলে দেশ এবং এর নেতা-নেত্রীরা যে কোন পথে যাচ্ছে, দেশটাকে কোন দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, কারো কাছে কোনো ধারণা নেই।
চলমান মিছিল, আন্দোলন আর রাজনীতির বর্তমান চালচিত্রে মনে হয় দেশে আরো সংঘাত, সহিংসতা আসন্ন। দেশ উদ্ধারে সরকার আর বিরোধীদলের ভাবগতিকে স্পষ্ট- তারা কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ, সকলেই জনগণের জন্য কাজ করতে বদ্ধ্ব পরিকর! তা হলে জনগণের এত দূর্ভোগ কেন? জনগণের জান-মালের নিরাপত্ত্বা বিধানই সরকারের কর্তব্য আর দায়িত্ত্ব। কিন্তু এই ‘দায়িত্ব-কর্তব্য’কে সরকার এখন ‘লাইসেন্স টু কিল পিপল’ ভেবে নির্মম শুরু করেছে। এতে করে আন্দোলন দমিয়ে রাখা যাবে- এই ভুল থিওরি অতীতে কখনো কার্যকরী হয় নাই। তাহলে এবারো কি হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে ১৪ দলের সমন্বয়ে গঠিত মহাজোটকে চিরস্থায়ী ক্ষমতাসীন করে রাখতে পারবে ওই থিওরি? এই প্রশ্নের জবাব আগামীর জন্য রইলো।
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
Salim932@googlemail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৩ ঘণ্টা, ৩০ জানুয়ারি, ২০১২