ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘রাজনৈতিক লাশ’ উপহারদাতা পুলিশের বিচার চাই

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১২
‘রাজনৈতিক লাশ’ উপহারদাতা পুলিশের বিচার চাই

রাজনীতিকে কেউ কেউ দাবা খেলার চালের সঙ্গে তুলনা করেন। কোথাও কেউ কোনো একটা চালে ভুল করলে তা সৃষ্টি করে গোল! গোল থেকে গণ্ডগোল অথবা জিরো যাই বলুন না কেন, ভুল চাল চালনেওয়ালা সরকারি দল হলে এর মাশুল অটোমেটিকলি সরকারের কেয়ারঅফে যায়!

বিএনপি’র গণমিছিলকে কেন্দ্র করে তেমন একটি ভুল চালে তেমন কি একটি গোলের মধ্যে পড়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার? খালেদা জিয়ার গণমিছিলের পাল্টা নগর আওয়ামী লীগের অনুজ্জ্বল একটি পথসভার ছবি দেখতে কেমন লেগেছে শেখ হাসিনার? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, পরিবেশ বিবেচনা করে সমাবেশের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ।

তা এভাবে কি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ সরকারি দলের অনুকূলে এসেছে না অনুকূলে-পক্ষে আসে? এসবও কী আওয়ামী লীগের মতো একটি আন্দোলনে চ্যাম্পিয়ন দলকে কারো কোচিং করানোর বা দেওয়ার দরকার আছে?

সর্বশেষ ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কিছুটা আপারহ্যান্ডের পাশাপাশি বিএনপি যেন কিছুটা ডাউনহ্যান্ডে চলে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের চরম সমালোচকরাও এভাবে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতনের বিষয়টি সমর্থন করেননি। অভ্যুত্থান স্বপ্নওয়ালাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সখ্যের কারণে বিএনপি কিছুটা হলেও বিব্রত-বেকায়দায় পড়েছে। খোদ খালেদা জিয়া পর্যন্ত ব্যর্থ অভ্যুত্থান বা কোনো বিষয়েই কোনো বাতচিত করেননি কয়েকদিন। এরপর আবার ভুল চালটি কিনা চাললো আপারহ্যান্ডে থাকা সরকারি দল!

পুলিশ-ৠাব সঙ্গে আছে বলে সরকারি দল বিএনপি’র পূর্ব ঘোষিত গণমিছিল কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে বসে! সেখানে তুলনামূলক রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে বিএনপি তাদের পূর্ব ঘোষিত রোববারের গণমিছিল কর্মসূচি একদিন পিছিয়ে সোমবার করে। এরপর আবার সরকারি দলকে পেয়ে বসে পাল্টা জেদাজেদির ব্যারাম! সোমবারও মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে সমাবেশের কর্মসূচি দিলে তা পরিস্থিতিতে উত্তেজনা ছড়ায়। যেখানে উত্তেজনা প্রশমনের দায়িত্ব সরকারি দলের, তারা করে উল্টো!

এর আগেই অবশ্য রোববার চাঁদপুর-লক্ষীপুরে বিএনপিকে ‘আন্দোলনের লাশ’ উপহার দিয়ে পরিস্থিতিকে নতুন ক্লাইমেক্সে নিয়ে যায় পুলিশ! সোমবার আবার রাজশাহীতে বাড়ানো হয় লাশের সংখ্যা! চারের জায়গায় পাঁচ!  

এর সবকিছু মিলিয়ে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতির সারসংক্ষেপ দাঁড়াল, বিএনপি নানা কিছু করে যেখানে আন্দোলনটা জমাতে পারছিল না, সরকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে জমিয়ে দিল আন্দোলন! গণমিছিলের পাল্টা জেদাজেদিতে ঢাকায় করলো তুলনামূলক ফ্লপ একটি পথসভা! এখন অনেকে ক্ষোভে মজা করে বলছেন, আইজিপিকে সিনিয়র সচিব করার দিনেই তিনি যা শুরু করে দিলেন না! এক্কেবারে রসগোল্লা! এখন বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কিনা কৃতজ্ঞতায় তাকে ফিল্ড মার্শাল বানিয়ে দেয়!

এবং আবার মাঠে নামানো হয়েছে সেই মায়া চৌধুরীকে! ১৯৯৬-২০০১’ জমানার মায়া চৌধুরীর কথা কী ভুলে গেছে বাংলাদেশ? শেখ হাসিনা এই লোকটাকে আগেও টয়লেট পেপার হিসেবে ইউজ করে সময় মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন! তার অধীনে রাজনীতি করা সাহারা খাতুন, কামরুল ইসলাম এখন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, আর মুক্তিযোদ্ধা মায়া চৌধুরীকে আবার মাঠ দখল সার্ভিস কাম সোজা বাংলায় রাজনৈতিক মস্তানিতে নামানো হয়েছে, যাতে এই লোকটা আর যাতে মেয়র নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারেন, অথবা দাঁড়ালেও বিপুলভাবে হারেন!

নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ এক সাগরেদ আমাকে বলেছিলেন, তার নেত্রী এক্সপেরিমেন্ট পছন্দ করেন। তার সেই এক্সপেরিমেন্টে ইতোমধ্যে শামীম ওসমান সেখানে পুরা সাইজ! এখন ঢাকার মাঠ দখলের রাজনীতিতে মাঠে নতুন করে নামানো মায়া চৌধুরী আর পুলিশ দিয়ে বিএনপির হাতে লাশ উপহারসহ শেখ হাসিনার নতুন এক্সপেরিমেন্ট তাকে কোথায় নিয়ে যায়, আল্লাই মালুম!

এমনিতে নানা কিছুতে ব্যর্থতা-সাফল্য সত্ত্বেও পুলিশ দিয়েতো সরকার গত তিন বছর বিএনপির আন্দোলন ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে। লিমনের পায়ের বিনিময়ে হলেও সরকারকে ভালো সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে ৠাব। কিন্তু আকস্মিক এমন মারমুখো কেন পুলিশ? না তাকে এমন ইজাজত দেয়া হয়েছে? যার কারণে পরপর ধারাবাহিকভাবে দু’দিনে চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর-রাজশাহী তিন জায়গায়ই গুলি চালাতে হলো? উপহার দিতেই হলো পাঁচটি লাশ!

অস্ট্রেলিয়ায় কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে আদিবাসীদের একটি গ্রুপ প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড আর বিরোধীদলের নেতা টনি অ্যাবোটের ওপর হামলা চালায়। সে হামলার আগে মব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা অফিসাররা এসে তাকে বলেন, আমাদের এখনই এখান থেকে চলে যেতে হবে। টিভি রিপোর্টের ফুটেজে দেখানো হয় জুলিয়া গিলার্ড তখনই তার চরম রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলছেন, তাহলে এখানে টনি অ্যাবোটের কী পরিস্থিতি হবে। তাহলে তাকেও আমার সঙ্গে নিয়ে চলেন। এরপর দু’জনকে সেখান থেকে প্রায় পাজাকোলা নিরাপত্তা দিয়ে সেখান থেকে বের করে নেবার সময় আদিবাসী গ্রুপটির ক্ষুব্ধ সদস্যরা যে যেভাবে পেরেছেন তাদের উদ্দেশে কিল-ঘুষি ছুঁড়ে মেরেছেন। ওই ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে জুলিয়া গিলার্ডের একপাটি জুতো খোয়া যায়। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলের নেতাকে উদ্ধার অভিযানে গুলি-টিয়ার গ্যাস দূরে থাক, একটা লাঠিও ব্যবহার হয়নি।

অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে মুক্তস্বাধীন মতপ্রকাশের দেশের এমন একটি অভাবিত ঘটনার উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশের পুলিশের কাছে তেমন আশা করার বিষয় নেই। বাংলাদেশের পুলিশকে সেভাবে গড়ে তোলা অথবা নির্দলীয় নিরপেক্ষ মানবিক করে গড়ে তোলা হয়নি। বিরোধীদল পুলিশকে প্রভোগ করে বা করবে এটা ঠিক, কিন্তু পুলিশেরও পোলাইট থাকার ট্রেনিং তা ভুললে চলবে কী করে? এক ছবিতে একটা লাশ যেভাবে পুলিশ মরা বেওয়ারিশ কুকুরের মতো টেনেহিঁচড়ে নেওয়া, বেআব্রু করার অকল্পনীয় দৃশ্য যেটি দেখা গেছে, তা কী কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানবিক মানুষ সমর্থন করতে পারেন? পুলিশ বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তরফে কী এর একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা আশা করাটা অযৌক্তিক ছিল?

এই সরকারকে বারবার করে যেকথা বলে আসছি, তাহলো তার কাছে আমাদের মূল দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তাড়াতাড়ি শেষ করা। নানা স্বপ্নভঙ্গের বিষয় থাকলেও অন্তত দেশের বেশিভাগ মানুষ এখনও এ ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে আছেন। কিন্তু পুলিশ যদি এভাবে গুলি চালিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিরোধীদলের হাতে লাশ তুলে দেয় আর সে লাশকে বেআব্রু, উলঙ্গ-ল্যাংটা করে, তাহলে কী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ছাড়াও দেশের কোনো পরিস্থিতি সরকারের অনুকূলে থাকবে? এই লাশ তৈরি আর লাশের অবমাননার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। সরকার এ নিয়ে কোনো টালবাহানা করলে পরিস্থিতি আরো বিপক্ষেই যাবে সরকারের।

বিএনপি’র হালের সবচেয়ে উজ্জ্বল সুশীল(!) এক বুদ্ধিজীবীর মঙ্গলবারের প্রকাশিত একটি লেখায় একটি বার্তা আছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত করতে তিনি বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা আগামী শীত পর্যন্ত স্থগিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। খালেদা-তারেকের বিরুদ্ধে চলমান মামলা আর যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারই যে এখনই সরকারকে ফেলে দেবার মূল নিয়ত তা ওয়াকিফহাল মাত্র জানেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে নিজেদের মামলা প্রত্যাহার আর বিএনপিরগুলো বহালের মাধ্যমে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। আগামীতে ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রত্যাহার করা মামলা সব পুনরায় চালুর ঘোষণা বিএনপির আছে। ঘোষণা না থাকলেও তারা তা করতো বা করবে। কিন্তু বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে যৌক্তিক মামলা থাকলে তা প্রত্যাহার বা স্থগিতের আবদার কেন? আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্থগিত বা বন্ধ?

সরকার যদি কারও কথায় বা চাপে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে বা আগ্রহ দেখায় তা আমরা কী মানবো? কখনোই না। প্রশ্নই ওঠে না। অন্তত এই ঐতিহাসিক কাজটি নিরুপদ্রপ শেষ করতে সরকারের কাজেকর্মে রাষ্ট্রনায়কোচিত বিজ্ঞতা থাকা চাই। আল্লাহর ওয়াস্তে এভাবে দু’একটি গণমিছিলের পাল্টাপাল্টির মতো রাজনৈতিক ছেলেমানুষির চেষ্টা যাতে আর করা না হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পণ্ডের চেষ্টা যারা করবে তাদের প্রতিহত করতে লোকজনকে দাওয়াত দিয়ে আনা লাগবে না। মনের ভেতর যা থাকুক বিএনপির মতো মুরব্বি সংগঠনও এখন যুদ্ধাপরাধীদের প্রকাশ্যে পক্ষ নিয়ে বলার সাহস হারিয়েছে। গোলাম আযমের গ্রেফতার নিয়েও তারা প্রকাশ্যে বিপক্ষে কিছু বলার দুঃসাহস দেখায়নি। সরকার যেন রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে এই অর্জনটুকু ধ‍ূলিসাৎ করে না বসে।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।