ঢাকা: সহিংসতা ছাড়ছেই না জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ জনসাধারণের সামনে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ধর্মাশ্রয়ী এই দলটি সংঘর্ষ-সহিংসতাকেই যেন রাজনৈতিক মূলমন্ত্র হিসেবে নিয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলোও বলছে, কখনো এককভাবে, কখনোবা সমমনা দলের ওপর ভর করে সহিংস পথেই রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধীতাকারীরা।
একাত্তরে নজিরবিহীন বিভীষিকা তৈরি করে তারা হয়ে উঠেছিলো আতঙ্কেরই সমার্থক নাম। মুক্তিযুদ্ধে জাগ্রত বাঙালির মরণকামড়ে পাকিস্তানের লজ্জাজনক পরাজয়ের পর কৌশলগত কারণে কিছু দিন থমকে থাকে তারা। পরে পরিবর্তিত রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে আবারো শুরু করে বিভীষিকাময় কর্মকাণ্ড।
বিগত শতাব্দীর ৮০ ও ৯০ দশকে জামায়াত সমর্থক ছাত্রশিবির সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শুরু করে প্রতিপক্ষের হাত-পায়ের রগ কাটার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জামায়াত-শিবির কর্মীদেরই সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলে বেশি। ২০০৬ সালের অক্টোবর সহিংসতার মূলেও ছিলো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামায়াত। সম্প্রতি তারা প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ঘাড়ে ভর করে একের পর এক রাজনৈতিক সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্রমতে, বড় কোন কর্মসূচির আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জামায়াত ক্যাডারদের এনে রাখা হয় শিবিরের মেসগুলোতে। যারা সহিংসতায় অংশ নেন তাদের পোশাকও থাকে আলাদা। প্যান্ট-শার্ট পরা জামায়াত কর্মীরা নিয়মিত মিছিল বা সমাবেশে অংশ নিয়ে সরাসরি পুলিশ বা প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হওয়া জামায়াত কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদেও এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্র।
সূত্র আরো বলছে, কখনো সখনো জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেধে নাশকত ছড়াচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও হিযবুত তাহরীরের মতো জঙ্গি সংগঠনও।
সর্বশেষ সোমবার রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় জামায়াত। এতে তাদের একজন কর্মী নিহত হলেও জামায়াত নয়, তাদের হয়ে বিএনপিই নেমেছে মাঠে। মঙ্গলবার আধা বেলা হরতালও করেছে রাজশাহী বিএনপি।
শুধু তাই নয়, গত দু’দিনে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোতে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে জামায়াত। এর মধ্যে রাজশাহী ছাড়াও লক্ষ্মীপুরে বিএনপির কাঁধে ভর করে পুলিশের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়েছে জামায়াত। আর চাঁদপুরে বিএনপি ক্যাডারদের উস্কানি দিয়ে চড়াও হয়েছে পুলিশের ওপর। এসব ঘটনায় বিএনপির লাভ-ক্ষতি যাই হোক, পড়ে গেছে ৫ লাশ। আর জামায়াতের হয়ে মাঠে নেমেছে চার দলীয় জোট নেতা বিএনপি।
এর আগে গত ১১ জানুয়ারি সাবেক আমীর গোলাম আযমকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাজধানীতে হঠাৎ করেই সহিংসতা ছড়ায় জামায়াত। তাদের চোরাগুপ্তা হামলায় পল্টন এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় সাধারণ গাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি পুলিশের গাড়িতেও আগুন দেয় জামায়াত ক্যাডাররা। ছিনিয়ে নেয় পুলিশের অস্ত্র।
তার আগে ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশকে কেন্দ্র করে কাকডাকা ভোরেই গ্যাঞ্জাম বাধিয়ে দেয় জামায়াত। দুপুরে পর রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে এ সমাবেশ হওয়ার কথা থাকলেও খুব ভোরেই বিএনপি কর্মীদের ফুসলিয়ে মাঠে নামায় তারা। উস্কানি দিয়ে চালায় নাশকতামূলক তৎপরতা। তাই রাজধানীর শান্ত সকাল হঠাৎ করেই হয়ে ওঠে উত্তপ্ত। বিভিন্ন স্থানে বোমা আর ককটেল বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে জনমনে।
ওই দিন মতিঝিলে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় আরিফুজ্জামান নামে একজন নিহত হন। সিলেট থেকে আরো এক জনের নিহত হওয়ার খবর আসে।
এর আগে ১৯ সেপ্টেম্বর জামায়াত ক্যাডারদের রুদ্ররোষে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীতে। ওই দিন জামায়াতের হামলায় অন্তত ৪০ পুলিশ আহত হয়।
জামায়াতের এ সহিংসতা যেন ২০০৬ সালের অক্টোবর সহিংসতার সময় থেকেই আরো জোরালো রূপ নিয়েছে।
এক মানবাধিকার সংগঠনের হিসেবে, ২৮ অক্টোবর পল্টন ময়দানে যে সহিংসতা শুরু হয় তার জন্যও মূলত জামায়াতকেই দায়ী করা চলে। ওই দিন পল্টন ময়দানে লাশ পড়ার যে নজির তৈরি হয়, পরবর্তী দশদিনে সারা দেশ মিলিয়ে তা পৌঁছে যায় ৫০ জনে।
ওই ১০ দিনের রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে ২০ জন বিএনপি, ১৩ জন আওয়ামী লীগ ও ৯ জন জামায়াত কর্মী। এর বাইরে ইসলামী ঐক্য জোটের ২, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ১ ও পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির ২ জন নিহত হন। এছাড়া ১ জন সাধারণ নাগরিক ও ২ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরও লাশ পড়ে ওই সময়।
নির্মম সেই সহিংস ঘটনার ভিডিও সিডি করে বাজারে ছাড়ে জামায়াত। পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়েও তা প্রচার করা হয়। ওই সিডিতে কেবল জামায়াত কর্মীদের মৃত্যুর জন্য দোয়া কামনা করে ভোট চাওয়া হয়।
এছাড়া ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিসংতার জন্য চার দলীয় জোট সরকারের ২৫ মন্ত্রীসহ ২৬ হাজার ৩৫২ জনকে চিহ্নিত করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। কমিশনের রিপোর্টে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে এসব নির্যাতনের অন্যতম হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আগামীতে জামায়াতের এ সহিংসতা আরো বাড়বে বলেই আভাস মিলছে গোয়েন্দা সূত্রগুলোতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১২