ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বন্ধ হোক পাল্টাপাল্টি’র মরণ খেলা!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১২
বন্ধ হোক পাল্টাপাল্টি’র মরণ খেলা!

এক খবরে দেখলাম সরকারি দল পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির পথ নিচ্ছে। এর মানে বিএনপি যেদিন যে কর্মসূচি দেবে তারা দেবে এর পাল্টা কর্মসূচি! আল্লাহ’র ওয়াস্তে সে পথে যাবেন না।

এ পথ একটা দায়িত্বশীল সরকারি দলের না।

এমন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির ফল কি হয়, তা আমরা সর্বশেষ বিএনপির গণমিছিলকে কেন্দ্র করে দেখেছি। ১৯৯৬-২০০১’র আওয়ামী জমানায় দেখেছি। রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের অবশ্যই নিজস্ব কর্মসূচি দেবার এখতিয়ার আছে। কিন্তু তা বিএনপির কর্মসূচির দিন দিতে হবে কেন? আগে-পরের কোন একটি দিন দিন। একইদিনে কর্মসূচি দিতে গেলে পুলিশ কি করে তাতো আমরা গণমিছিলকে কেন্দ্র করে দেখেছি। পুলিশকে এমন বেয়াড়া-মারমুখো লাগামহীন ছেড়ে দেবেন না। এর সবকিছুই সরকারের বিরুদ্ধে যায়। মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে বলে যা খুশি করার লাইসেন্স কাউকে দেয়নি। ইতিহাসের সোজা এ হিসাবটি যদি ভুলে যাওয়া হয়, ইতিহাসে এর পরিণতি যা লেখা হয়, সেখান থেকে কারও মুক্তি নেই। গণমিছিলকে কেন্দ্র করে দুদিনে ৫ মৃত্যুর ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দূঃখ প্রকাশ করেছেন, এটি একটি ভালো দৃষ্টান্ত। কিন্তু শুধু দু:খপ্রকাশই যথেষ্ট নয়। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। লিমনসহ আরও কিছু ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন, তা যেন তিনি ভুলে না যান।

একটা কথা বহুবার লিখেছি। এ দফায় ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার কথাবার্তায় যে বিনীত-পরিমিতিবোধ ছিল তা হঠাৎ উবে গেল কেন? এত বিপুলভাবে পাবলিকের ভোট পাবার পরও তার কথাবার্তার ধরনে পাবলিক সন্তুষ্ট ছিল। সবাই মনে করেছিল, জেল জীবনে আত্মপোলব্ধিতে আওয়ামী লীগ নেত্রী সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া একজন মানুষ। যার কারনে এমন বিপুল ম্যান্ডেট পাবার পরও তার মাথা ‌‘আওলাইয়া’ যায়নি। এরপর যখন তিনি মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তখন থেকে ফুটে ওঠা শুরু করে ভিন্ন এক চিত্র! ‘চমকের মন্ত্রিসভার’ নামে আনুগত্যের চমকধারীদের নিয়ে তিনি যে যাত্রা শুরু করেন, তখন পাবলিক বলা শুরু করলো, তাদের ভোট নিয়ে আওয়ামী নেত্রী শুরু করেছেন, বিশেষ এক সাইজিং মিশন! সরকার কী করে ভালো হাঁটবে চলবে সে খবর নেই, দলের একে সাইজ করেন, তাকে সাইজ করেন, এরশাদকে সাইজ, মেনন-ইনুকে সাইজ, সারাদিন শুধু সাইজ আর সাইজ! নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একলাই এত বেশি আসন পেয়ে গিয়েছিল যে, মহাজোটে এসে পড়ায় মান-ইজ্জতের ভয়ে কারও কিছু করার-বলারও ছিল না।

একটা শাসন কার্যক্রম কীভাবে সুষ্ঠু চলবে, তার কোন বালাই নেই, ক্ষমতা পেয়েছি বলে যারে পারি তারে সাইজ করার এমন আত্মঘাতী প্রবণতা দেখে প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মুসা ভাই লিখেছিলেন, শিক্ষানবিশ দিয়ে দল চালানো যেতে পারে, সরকার চালানো যায় না। তার এই কথাটি আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। দলের অভিজ্ঞ সিনিয়রদের সাইজ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা যাদের নিয়ে শুরু করেছিলেন তাদের প্রায় সবাই চরমভ ব্যর্থ হয়েছেন। উল্টো সরকার যেন নিজেই এখন সাইজড অবস্থায়! এমনকি সরকারবান্ধব বলে পরিচিত যুগান্তর পত্রিকাটিও লিখেছে, আজ নির্বাচন হলে এসব চমকের মন্ত্রীদের সঙ্গে হেরে যাবেন মতিয়া চৌধুরীর মতো মন্ত্রীও!

সরকারের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশ পরিচালনায় তিনি বিরোধীদলের কোন সহযোগিতা পাননি। কথা সত্য। চারদলীয় জোট কাম হাওয়া ভবনের ব্যানারে বিপুল স্বেচ্ছাচারে ক্ষমতা চালানো খালেদা জিয়ার দল ২৯ আসন পাবার পর নির্বাচিত সরকারকে সহযোগিতা দিয়ে যাবেন, বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতি এমন আচানক বদলে যায়নি। এদেশের রাজনীতি হলো, যে যখন ক্ষমতায় আসতে পারেন না তখন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোটার জনগণকে অপমান করা হয়। এটা কখনো শেখ হাসিনা করছেন, কখনো এবং সর্বশেষ করেছেন খালেদা জিয়া। এখানে ভোটে হারলে বিরোধীদল সংসদে যায় না। অথচ বিদেশ ট্যু’র সহ সব সুযোগ কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেয়। এটা আগে শেখ হাসিনা নিয়েছেন, এখন নিচ্ছেন খালেদা জিয়া। আগামী দিনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হারলে বিরোধী দলে গেলে যে নিয়মিত সংসদে যাবে এর ন্যূনতম কোন গ্যারান্টি আছে কি? এসব বিষয়ে নিজস্ব নৈতিক জায়গাটি দুর্বল থাকায় আজ পর্যন্ত সরকার কোনদিন একটা প্রেসব্রিফিং করে দেশের মানুষকে বললো না, যে সংসদে না গিয়েই বিরোধীদলের নেত্রী সহ বিএনপির এমপিরা কি করে সব টাকাপয়সা অনৈতিকভাবে নিয়েই চলেছেন!

বিএনপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত নির্বাচনে মানুষ আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে ভোট দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার দুই ছেলের বিদেশে টাকাপাচারের প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও সরকার কী এসব মামলা পরিচালনায় মোটেও মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে? দুর্নীতির বিশেষ কুশীলব সাবেক এক রাজনৈতিক সচিব এখনও বিদেশে পালিয়ে আছেন। আরেকজন কি কারণে সাফসুতরো হয়ে গেলেন? কেন মওদুদ আহমদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেনদের মতো লোকজনের নসিহত দেশের মানুষজনকে সকালসন্ধ্যা শুনতে হয়? না নিজেদের দলের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়াতে এ বিষয়টি নিয়েও জোশ হারিয়েছে সরকার? শেয়ারবাজারের ফতুর লোকজন আজ আত্মঘাতী হচ্ছে। দরবেশ চাচা সহ মানুষের টাকা লুটপাটকারীদের ছত্রছায়া দেবার জবাব কী? ফারুক খানকে বাণিজ্য, আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় দিয়ে বাজার আর দেশের রাস্তাঘাটের কী হালটাই না করা হয়েছে! এসবের দায় কার?

আর শাহজাহান খানের মতো মন্ত্রী যিনি দেশের ভোটার মানুষজনকে গরু-ছাগলের চেয়ে কমদামি মনে করার প্রকাশ্য ধৃষ্টতা দেখানোর পর তাকে মূল্যবান মনে করা হয়, এসব দেখে জেনেশুনে মানুষকে আবার আওয়ামী লীগকে ভোট দিতেই হবে, এমন ভাবার কারণ কী? সরকারের ব্যর্থতায় তারেক রহমানের মতো চিহ্নিত একজন দুর্নীতিবাজ, বিদেশে টাকাপাচারকারীর দেশে নায়কের বেশে ফেরার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মধ্যে একমাত্র যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি অনেক দুর্বলতার মধ্যে হলেও এখনও চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এখন পর্যন্ত কোন নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেনি। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্যে খালেদা জিয়া যে মরিয়া ভূমিকা নিয়েছেন, তা দেশের কারও জানতে বুঝতে বাকি নেই। পারলে তিনি এ বিচার ঠেকান, সেটি দেশের মানুষ দেখবে। কিন্তু পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে কেন প্রতিপক্ষের হাতে রাজনৈতিক অস্ত্র তুলে দেয়া হবে? আওয়ামী লীগকে এসব আত্মঘাতী পরামর্শ কারা দিচ্ছে? নিজেরা না পারুক, সো্কল্ড চমকের মন্ত্রিসভার(!) অনুগত লোকজনের শেখ হাসিনার সামনে সত্য কথা বলার সাহস না থাকতে পারে, চৌদ্দ দলের নেতাদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করলে কী এমন অরাজনৈতিক পথে একটি রাজনৈতিক সরকার যেতে পারে?

আজকাল খালেদা জিয়াওতো প্রায় তার দলের স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বসেন। শেখ হাসিনার দলে যতো সিনিয়র প্রাজ্ঞ রাজনীতিক আছেন, তাদের সঙ্গে সপ্তাহে একদিন বসলেওতো অনেক সওয়াব হাসিল হয়। এর জন্যে শেখ হাসিনাকে অবশ্যই ২০০৮’র নির্বাচন-পরবরর্তী মানসিক অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। শুনতে হবে দায়িত্বশীল লোকজনের পরামর্শ। এ দুনিয়ায় একজনই সবকিছু জানেন না। একজন যা জানেন, এর বাইরেও জানার-বোঝার অনেক কিছু আছে-থাকে। একজন যদি মনে করেন, তিনিই সবজান্তা অথবা সর্বশ্রেষ্ঠ, তাকে কিন্তু কিছু বলা বা বোঝানো কঠিন। হাতে সময় খুব কম। এর মাঝে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারটি যা যেখানে হারিয়েছে তা চিহ্নিত-স্বীকার করে শোধরানোর কাজ শুরু না করলে শুধু শেখ হাসিনা বা চৌদ্দদল নতুন বিপদে পড়ে যাবে বাংলাদেশ। যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের গাড়িতে চোখের সামনে আবার রক্তাক্ত জাতীয় পতাকা ওড়াবো। এমন দুঃস্বপ্ন প্রতিরোধের এখনই সময়। শেখ হাসিনা মানুষের কথা না শুনলে দেশের মানুষ নির্বাচনের সময় তার উপযুক্ত জবাব দেবে।
 
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।