একজন মধুসূদন ঘরামীর কান্নায় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত লোকজন কেঁদেছেন(যুদ্ধাপরাধী পক্ষ ছাড়া)! বাংলানিউজসহ দেশের প্রধান সব মিডিয়ার রিপোর্টে এর বৃত্তান্ত পড়ে চোখের পানি সামাল দিতে পারিনি। ৮১ বছর বয়সী অশীতিপর বৃদ্ধ, অসুস্থ মধুসূদন ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দেশের মানুষকে বলেছেন, আজকের জামায়াত ও চারদলীয় জোট নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দুর্বৃত্তপনায় মুক্তিযুদ্ধকালীন তার দুর্বিষহ জীবন লাঞ্ছনার কথা।
এমন কী কোনো পাষণ্ড আছে, একজনের জীবন লাঞ্ছনার বৃত্তান্ত শুনে যার প্রাণ কাঁদবে না? একাত্তরের বাংলাদেশে এমন হাজার হাজার মধুসূদন ছিলেন। তাদের অনেকে পরবর্তীতে হয়েছেন জন্মভূমি ছাড়া, দেশান্তরি। অনেকে এর মধ্যে মারা গেছেন। নিভু নিভু জীবন নিয়ে হয়তো বেঁচে আছেন কেউ কেউ। এই মধুসূদন ঘরামী তাদের প্রতীক, প্রতিনিধি। হয়তো দেশের মানুষকে তার জীবনের সত্য জানিয়ে যেতে এত দীর্ঘায়ু পেয়েছেন মধুসূদন ঘরামী। তিনি আরো দীর্ঘায়ু হোন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ, সাজা দেখার পরও নতুন এক বিশ্বাস-উপলব্ধির দেশে বেঁচে থাকুন, সে কামনা করি।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী শয়তানের হাতে তার ধর্ষিতা স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধ শিশু সন্ধ্যা কী আজ বেঁচে আছেন? তার প্রতি আমাদের সহানুভূতি রইল। নিজের দেশে ফিরে এসো বোন। আমরা ভাইরা তোমার দায়িত্ব নেবো। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিশোধ নেবো দুর্বৃত্ত-দস্যুতার।
সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ নিয়ে সাম্প্রতিক এক বুদ্ধিজীবী প্রশ্ন তুললেও এ বিষয়গুলো নিয়ে ১৯৮৭ সাল থেকে মিডিয়ায় রিপোর্ট হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধসমূহের কারণে দেশ স্বাধীন হবার পর পিরোজপুরের পাড়েরহাটের সাঈদখালী গ্রামের রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন এলাকা থেকে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি নামের সঙ্গে সাঈদী যোগ করে ওয়াজি মাওলানা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর আবার আকস্মিক নামের সঙ্গে নিজে নিজে যোগ করে নেন ‘আল্লামা’ পদবী! এভাবে পার্লামেন্টের এমপিদের নামের তালিকাতেও নিজের নাম ‘আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’ লিখিত করে নিতে পেরেছেন! পাকিস্তানের জাতীয় কবি ইকবালের পর আর এই তল্লাটে আর কাউকে এভাবে ‘আল্লামা’ সাজতে দেখা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পরপর রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইনের খুলনা এলাকায় আত্মগোপনের খবর জানা গিয়েছিল। গ্রেফতারকৃত যুদ্ধাপরাধী হিসাবে তার মামলাটি ট্রাইব্যুনালে আসার কারণে এখন জানা গেল যশোরের এক গ্রামেও তিনি আত্মগোপন করেছিলেন! খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ধরতে গেলে তিনি পর্দা-পুষিদার(!) বোরকা পরে গরুর গাড়িতে গ্রামীণ নাইওরির সাজে সেখান থেকে পালিয়ে যান। সাক্ষীদের বক্তব্য-জেরায় এমন আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসবে জানা যাচ্ছে বর্তমান জামায়াত ও চারদলীয় নেতার ফুলের মতো চরিত্রের(!) বৃত্তান্ত!
অনলাইনে এখন জামায়াতিদের ছড়িয়ে ভিডিওগুলোতে তাকে পবিত্র একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে চিহ্নিত করে তার পক্ষে সহানুভূতি সংগ্রহের আপ্রাণ চেষ্টা আছে। এমন একটি ভিডিওর প্রচ্ছদে আছে, ট্রাইব্যুনালের কারা হেফাজতখানায় তার নামাজ পড়ে দোয়ার ছবি। সঙ্গে তার তেলাওয়াতের রেকর্ড! এসবের মাধ্যমে জামায়াতি প্রপাগান্ডায় বলার চেষ্টা হচ্ছে, ইনি একজন সুফি কিসিমের মানুষ। একাত্তরে লুট করেননি, ধর্ষণ করেননি, কাউকে জোরপূর্বক ধর্মান্তর, খুন করেননি! মুক্তিযুদ্ধের পর এমনি এমনিই হাওয়া বদল উপলক্ষে এলাকায় কিছুদিন ছিলেন না, এমন আর কী! এই জামায়াতিরা একাত্তরে এই বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতার সময়ও ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রচার-প্রপাগান্ডায় ছিলেন ধর্মদ্রোহী, ভারতীয় দালাল, দুষ্কৃতকারী! তাদের প্রচার-প্রপাগান্ডার স্টাইলটি এখনও অবিকল সে রকম! আমরা যারা এর বিচার চাচ্ছি তারা এখন ভারতীয় দালাল! আর যারা বাংলাদেশটাই চায়নি, তারা হয়ে গেছে সাচ্চা জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশি! ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়ে কিছু মিডিয়ার রিপোর্ট আমি মনোযোগ সহকারে পড়ি। সংগ্রাম-নয়া দিগন্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে প্রকাশ্য ভূমিকাটি ঠাওর করা যায়। আরো কিছু মিডিয়ার রিপোর্ট একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে অাঁচ করা যায় তাদের ছদ্মবেশ!
যেমন, এদের সম্মিলিত প্রচার-প্রপাগান্ডার মূল সুরটি হলো একাত্তরে রাজাকার বাহিনীটি খুব খারাপ ছিল। এরা খুন-ধর্ষণ-লুচ্চামি সব করেছে। কিন্ত আটক জামায়াত-বিএনপির যুদ্ধাপরাধী নেতারা ছিলেন ফেরেস্তা প্রকৃতির! তারা এসব কিছুর চৌহদ্দি অথবা নিকট দূরত্বেও ছিলেন না। সাঈদীর ব্যাপারে এরা প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা করছে, একাত্তরে ওই এলাকায় দেলোয়ার সিকদার নামের আরেক রাজাকার ছিল। যে পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। সেই দেলোয়ার সিকদার অথবা দেলাওয়ার হোসাইন আজকের ‘আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’ এক নন ইত্যাদি!
মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী বলার ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছে। এখন প্রমাণের চেষ্টা করছে, ট্রাইব্যুনালে যতো সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে এসেছেন-আসছেন, প্রচারের চেষ্টা করছে, তারা সবাই ঠগ-জোচ্চর শ্রেণীর লোকজন! এরা আওয়ামী লীগ করেন কিনা বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, সেটিও অপরাধ হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে! পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধারা যেন সবাই মরে গেছেন, আর কী! ক্ষুদ্র দলীয় রাজনৈতিক কারণে ট্রাইব্যুনালে কি বিএনপির মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ সাক্ষ্য দিতে আসছেন বা আসবেন? সাদেক হোসেন খোকা কি এসেছেন?
মধুসূদন ঘরামী, একাত্তর যার জীবন ছারখার করে দিয়েছে, যুদ্ধ শিশুকে কোলে নিয়ে দেশান্তরি হয়েছেন যার ধর্ষিতা স্ত্রী, আর কিছু না পেয়ে ৮১ বছরের অশীতিপর বৃদ্ধের অপরাধ শনাক্তের চেষ্টা হয়েছে, তিনি বয়স্ক ভাতা নেন! যার জীবন-সংসারের বিনিময়ে এই দেশ, যেখানে আমরা নানাভাবে হোমরা-চোমরা, তাকে আমাদের কি দেবার দরকার ছিল, আর দিচ্ছি কয় টাকার বয়স্ক ভাতা?
বাংলাদেশের সংবিধান মানলেওতো পঁয়ষট্টি বয়ষোর্ধ্ব প্রতিটি নাগরিককে রাষ্ট্রের বয়স্ক ভাতা দেওয়ার কথা। মধুসূধন ঘরামীকে মাসে কয় টাকা দেয় রাষ্ট্র? এই বিচারের কাজকর্ম যতো এগোচ্ছে, ততো এখানকার কিছু ধৃষ্ঠ লোকজনের চেহারা-অপরাধসমূহ চিহ্নিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্মের কাছে এদের আজকাল ধরা পড়া শুরু হয়েছে। আগামীতেও এমন দুর্বৃত্ত পাকড়াও চলবে। এর মাধ্যমে হয়তো সামান্য উসুল হবে মধুসূদন ঘরামীদের আত্মত্যাগের ঋণ।
এই এমন একজন লাঞ্ছিত জীবনের মধুসূদন ঘরামীর বাকি জীবনের সব দায়িত্ব নেবার জন্য রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাই। রাষ্ট্র বা কেউ এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে আমরাও এ ব্যাপারে হাত বাড়াবো। মুক্তিযুদ্ধের কারণেই তো দেশ-বিদেশে আমরা গর্বিত বাংলাদেশি।
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১২